তুরস্ক আর সিরিয়ায় পৃথিবী দেখছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশ দুটির লাগোয়া সীমান্তবর্তী এলাকায়া ধসে পড়েছে হাজারো ঘরবাড়ি, ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এই লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২২ হাজার; ৩০ হাজার ছাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তুরস্কে যখন মাতম, তখন সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের মনেও শোক, সাথে আতঙ্ক। ইস্ট ও নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইনের কারণে পৃথিবীর সর্বাধিক ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলোর একটি তুরস্ক। অনুরূপ, বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার নাম ডাউকি ফল্ট লাইন, যার পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশের অবস্থান।
২০২১ সালের ২৯ মে; সিলেট শহর যথারীতি প্রাণচঞ্চল। মধ্যগগনে যখন সূর্য, তখনই হঠাৎ পিলে চমকে দিয়ে দুলে উঠল ধরণী, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪.১। মৃদু এই ভূমিকম্প নিয়ে সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন পর্যালোচনা সবে শুরু হয়েছে, তখনই আরেক দফা কাঁপলো সিলেট। এবার মাত্রা ৪। এরপর সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়বার পূর্বে আরো ৩ দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয় সিলেটে, যেগুলোর সর্বনিম্ন মাত্রা ছিল ২.৮।
এরূপ মৃদু ভূমিকম্প দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেননা বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে- বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আগে বা পরে এরূপ দফায় দফায় মৃদু ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই আশঙ্কাকে আরো জোরালো করবে একই এলাকায় ২০১৯ এবং ২০২০ সালের ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো। এগুলোই কেবলই ইঙ্গিত করে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দিকে, যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানি ঘটাতে পারে বাংলাদেশে। কেন এই ঝুঁকি, তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে ফল্ট লাইন কী, ফিরে যেতে হবে অতীতের ভূমিকম্পের ইতিহাসেও।
ডাউকি ফল্ট ও অন্যান্য
৪০০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে কোনো মহাদেশ বিভাজন ছিল না, পুরো পৃথিবী ছিল একটি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড। কিন্তু ক্রমে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক কারণে মাটির অভ্যন্তরে শৈলস্তরে ফাটল ধরে, এবং পৃথিবীর ভূখণ্ড বৃহৎ বৃহৎ প্লেট বা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পরস্পর থেকে সরে যেতে শুরু করে। ভূ-অভ্যন্তরে এরূপ ৭টি বড় বড় প্লেট, এবং ১৫টি মাঝারি ও কিছু ক্ষুদ্র আকারের প্লেট রয়েছে। এই বড় প্লেটগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলে। এরূপ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলগুলোকে বলা হয় ‘ফল্ট সিস্টেম’, যেখানে দুটি প্লেটের ঘর্ষণে ভূমিকম্প তৈরি হয়।
বাংলাদেশে এরূপ বেশ কিছু ফল্ট বা চ্যুতি রয়েছে যেগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিপজ্জনকটির নাম ডাউকি ফল্ট। ৩০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই ফল্টের নামকরণ করা হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের শহর ডাউকি থেকে। পূর্বদিক এই ফল্ট ভারত থেকে বিস্তৃত হয়ে পশ্চিমে চলে এসেছে বাংলাদেশের দিকে। এই ডাউকি ফল্ট ছাড়াও যমুনা ফ্লাড প্লেইনের সংযোগস্থলে মধুপুর গড়ের পশ্চিম প্রান্তে ১০০ কিলোমিটার বিস্তৃত মধুপুর ফল্ট আছে যা জামালপুর থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে দক্ষিণ মিয়ানমার হয়ে আন্দামান পর্যন্ত চলে গেছে আরেকটি ফল্ট লাইন। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো- সবগুলো ফল্ট লাইনই সক্রিয়, যেকোনো সময় ভূমিকম্প ঘটাতে পারে দেশের তিন বৃহৎ শহরে। তবে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণটি হলো ডাউকি ফল্ট।
কেন ডাউকি অধিক ঝুকিপূর্ণ?
সিলেট, রংপুর, দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাগুলো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সিলেটের জৈন্তাপুর দেশে ভূমিকম্পের প্রধান উৎস এবং সম্ভাব্য বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক। এর পূর্ব প্রান্তে ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমপ্রান্তে, অর্থাৎ বাংলাদেশ ও সুনামগঞ্জের অবস্থান যে অঞ্চলে, সেখানে গত ৪০০ বছরে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। ফলে দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত শক্তি থেকে প্রবল ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের গবেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়ংকর তথ্য- ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা, মোট তিনটি সক্রিয় প্লেটের সংযোগস্থলের উপর বাংলাদেশের অবস্থান।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আখতার সম্ভাব্য দুটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকাশ করেন,
একটি হলো উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটি হলো আমাদের পূর্বে চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে আসলে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। উত্তর প্রান্তে ডাউকি ফল্টে সংকোচনের হার প্রতি একশ বছরে এক মিটার। গত ৫শ থেকে ৬শ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো রেকর্ড নেই। তার মানে ৫-৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। এটা যদি আমি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করি তাহলে এটা হচ্ছে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।
পরিণতি
প্রথমত, সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হলে সেসব অঞ্চল তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, সাথে ঢাকাও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। যদিও ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন বড় মাত্রার ভূমিকম্প তৈরির মতো না, কিন্তু ডাউকি ফল্ট থেকে গড়ে দেড়শো থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমাদের রাজধানী শহর সেখানকার ভূমিকম্প ভালো করেই টের পাবে।
বাংলাদেশ সরকারের কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি) ও বুয়েটের এক যৌথ সমীক্ষায় জানা যায় যে, ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজারের অধিক ভবন ধসে পড়তে পারে, তৈরি হতে পারে ৭ কোটি টন কংক্রিটের ধ্বংসস্তুপ। এছাড়াও বুয়েটের বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় উঠে আসা তথ্যমতে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে যথাক্রমে ১৩ লাখ, ৩ লাখ এবং ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে যার ৭৫ শতাংশই ছ’তলা বা তার অধিক উচ্চতার। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীলতা এদের অধিকাংশেরই নেই। এমনকি জাতিসংঘের আর্থকোয়াক ডিজাস্টার রিস্ক ইনডেক্সেও প্রবল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ২০টি শহরের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত, দেশ-বিদেশের গবেষণা ও পূর্বাপর তথ্যাদি থেকে বলা চলে- বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ যেন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য চাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা, প্রস্তুতি এবং সচেতনতা।