পৃথিবী নামক এই গ্রহটা প্রতিনিয়ত উষ্ণ হচ্ছে, আর তা ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি। ১৯০৬ সাল থেকে এখন অবধি বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১.৬ ডিগ্রী ফারেনহাইটের (০.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস) চাইতেও বেশি- আর মেরু অঞ্চলগুলোতে তো আরো বেশি।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবগুলো ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষায় নেই- বরং বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব এখন থেকেই দেখাতে শুরু করেছে। অতিরিক্ত উত্তাপে হিমবাহ এবং সমুদ্রের বরফের স্তর গলতে শুরু করেছে, বৃষ্টিপাত আর তুষারপাতের নমুনা বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এসবই সরাসরি প্রভাব ফেলছে প্রাণীজগতের উপর।
বর্তমান সময়ে উন্নয়নের পথে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। আর এও একদম স্পষ্ট যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলে দারিদ্র্য আর বৈষম্য দূর করা কখনোই সম্ভব নয়। আর তা বাংলাদেশের জন্য আরো বেশি গুরুত্ব বহন করে। কেননা, জলবায়ু সংকটের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে উপরের সারিতে। দারিদ্র্য আর বৈষম্যের পাশাপাশি ঘন ঘন দুর্যোগ, বাংলাদেশের পক্ষে জলবায়ু সংকট মোকাবেলাকে আরো বেশি কঠিন করে তুলছে।
বিশ্বের সবচাইতে বেশি দুর্যোগ আক্রান্ত দেশগুলোর তালিকায় আছে বাংলাদেশেরও নাম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং নদীভাঙনের মাধ্যমে জরুরি অবস্থায় প্রায়ই দিন কাটাতে হয় এদেশের উপকূলবর্তী মানুষজনদের। বাংলাদেশ হিমালয় এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর শাখা-নদী আর উপনদী দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটকে থাকা এক বৃহত্তম ব-দ্বীপ। উত্তর-পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের কিছু পাহাড়ি এলাকা বাদে পুরো বাংলাদেশই নিম্ন এবং সমতল ভূমিতে অবস্থিত। জনসংখ্যার ঘনত্বের মতো কঠিন সমস্যাকে মোকাবেলা করা আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠছে জলবায়ু সংকটের কারণে।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভাগের মতে, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান দুর্যোগের ঝুঁকিসমূহ হচ্ছে- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, আগুন, পাহাড় ধ্বস, ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা, মাটি আর জলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মহামারী এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ দূষণ।
অতী শীঘ্র বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে না উঠতে পারলে, জলবায়ু সংকট মোকাবেলা আরো বেশি কঠিন হয়ে যাবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, কৃষিজ আর মৎস্য, খাদ্যসুরক্ষা, খাদ্যবস্তুর উর্ধ্বমূল্য, রোগের প্রসারসহ সামগ্রিক বাংলাদেশ প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ। এই পরিবর্তনগুলোতে নজরদারি না করলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে, যা বাংলাদেশের জন্য আরো বেশি ধ্বংসাত্মক হবে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অনিয়মিত আর অনিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ার জন্য কয়েক লক্ষ মানুষ বাস্তুহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল অবধি দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ প্রায় ৭০টি ভয়ংকরী ঝড়ের আঘাত সহ্য করেছে।
এই বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ফণী এবং বুলবুলের মতো ঘূর্ণিঝড়ে লক্ষ-কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতিসহ গৃহহীন আর আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণহারে। এই বছরের এপ্রিল মাসের ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৬ লক্ষ শিশু এবং সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলই বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ু সংকটের বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধার এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে লক্ষ-কোটি টাকা।
সম্প্রতি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আর সচেতনতায় এগিয়ে আসছেন সর্বস্তরের মানুষজন। শিল্পী সত্ত্বা থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ, সবাই অংশগ্রহণ করছেন। আর সেই চিন্তাধারা থেকেই এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রী জাকির হোসেন চৌধুরী। এই তরুণ আলোকচিত্রীর তোলা ছবি দিয়ে সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত গণ্যমাধ্যম আল জাজিরার ওয়েবসাইটে জলবায়ু সংকটে বাংলাদেশ শীর্ষক একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। আলোকচিত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে এই আলোকচিত্রগুলো নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের উলিপুরে বন্যার পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার পর লোকজনের শেষ আশ্রয় হয়েছে এই ভাসমান নৌকায়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে বন্যার পানিতে প্রায় ৬,৭৭,০০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে; ২৮টি জেলার প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ পানিবন্দী জীবনযাপন করেছে।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের তথ্যমতে, বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় বন্যার পানিতে ৭২,৪৮০টি পরিবারকে পানিবন্দী হয়ে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের উপকূলের সমুদ্রের পানির স্তর ০.৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১.৫ মিটারের পৌঁছে যাবে। যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশী গবেষকদের ২০১৫ সালের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ঝড় আর ভরা জোয়ারের মাধ্যমে সৃষ্ট অতি উচ্চ পানির স্রোত বৃদ্ধির ঘটনা সাধারণত এক দশকে একবারই হয়ে থাকে; তবে অতি শীঘ্রই শতাব্দীর শেষের দিকে প্রতি বছরে এটি ঘটবে ৩ থেকে ১৫ বারের মতো।
ঝড়ের কারণে বাড়িঘর হারানো এক নারী বসে আছেন সুন্দরবন এলাকায় নদীর তীরে গড়ে তোলা অস্থায়ী এক আশ্রয়কেন্দ্রে।
সুন্দরবনের কাছাকাছি উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার পূর্বেই একটি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় দ্রুত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়টি গত মে মাসে আঘাত হানে, যার ফলে প্রায় ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশ।
সুন্দরবনের কাছাকাছি উপকূল অঞ্চলের মানুষেরা ঘূর্ণিঝড় চলাকালীনই তাদের নৌকা বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে। কেননা, নদীতে মাছ ধরাই এ অঞ্চলের বেশিরভাগ লোকের আয়ের প্রধান উৎস।
৪৬ বছর বয়সী আফিয়া বেগম বসে আছেন তার অস্থায়ী বাড়ির সামনে, যেটি খুলনা জেলার শিবসা নদীর তীরবর্তী। দাকোপ উপজেলাতে ভূমিক্ষয় আর ঝড়ের কারণে তাকে পাঁচবার তার বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে।
“ঘূর্ণিঝড় ফণীতে আমি বাড়িঘর হারিয়েছি। এখন নদীর উপর বাঁশের নির্মিত অস্থায়ী বাড়িতে থাকি।”
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ফেনী বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানার পর এক নারী তার বাড়ি ফিরছেন। ১০ জেলায় অন্তত ১৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এতে।
নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ফসলের মাঠে বসে আছেন খুলনা জেলার এক নারী।
কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে জলমগ্ন নিজের বাড়ির সামনেই নৌকায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছেন একজন মা ও শিশু।
বাংলাদেশ বন বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবন এবং আশেপাশের উপকূল অঞ্চলের প্রায় ৪,৫৮৯টি গাছ গোড়া থেকে উপড়ে গিয়েছে।
খুলনা জেলায় ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার পর ৫৫ বছর বয়সী মজিদ নদীর পাড় মেরামত করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার পূর্বেই খুলনার জেলার ডাকোপ উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নেয় অনেক পরিবার।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার পর খুলনা জেলার রূপসা নদীর তীরের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে যায়। কর্মকর্তারা জানিয়েছে, প্রায় বিশ লাখ মানুষ ঝড়ের পূর্বেই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সুন্দরবন এবং এর আশেপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষজনদের প্রায়ই বাস্তুহারা হতে হয়। এক সমীক্ষার ধারণা অনুযায়ী, চলতি বছরে নদীভাঙনের কারণে ২,২৭০ হেক্টর জমি পানির তলে চিরতরে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/