চটকলের শ্রমিক মুনতাসিরের সাথে পরিচয় হয়েছিল আহমদ ছফার ‘নিহত নক্ষত্র’ গল্পে। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে মনীষা, আন্তরিকতা আর প্রীতির সেতুবন্ধনে সে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল মানুষকে। মালিকের শ্রম চুরি বন্ধ করতে চাইলে শ্রমিকের সাথে মিশে গিয়ে তাদের শেখাতে হবে মুক্তির ভাষা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব ছেড়ে মুনতাসির শ্রমিকদের সাথে যোগ দিয়েছিল চটকলে। গল্পটা ১৯৬৯ সালের।
‘নিহত নক্ষত্র’ প্রকাশকালীন দেশে চলছিল গণঅভ্যুত্থান। ঢাকার রাজপথ তখন বাংলার আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতার হাতে। আইউব খান তখন উন্মত্ত জনতার হাতে পর্যুদস্ত। সে জনতার ভিড়ে জ্বলজ্বল করছিল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি আইউব খানের পতন নিশ্চিত করেই থেমে যাননি, একাত্তরে নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছেন আতশী বারুদের গোলার সামনে। লড়ে গিয়েছেন চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করবার পূর্ব পর্যন্ত। স্বাধীনতাকে বগলদাবা করেই তবে বাড়ি ফিরেছেন। তবে বাড়ি ফিরেই কি কাজ শেষ? তখনও পথ বাকি ছিল বহুদূর। অফুরন্ত সেই পথেরই পথিক হয়েছেন তিনি।
একাত্তরে দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের মানুষ ভেবেছিল তাদের দুঃখ-দুর্দশার দিন এই বুঝি শেষ হলো। মুক্ত বাতাসে বিচরণকারী প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখেই তখন প্রশান্তি, এবার তবে জীবন কাটবে নির্বিঘ্নে। যে সকল বৈষম্যের কারণে বাঙালি এতকাল পিছিয়ে ছিল এবার তার অবসান ঘটবে। কিন্তু খুব বেশিদিন নির্বিঘ্নে থাকার সুযোগ হয়নি। যে গণতন্ত্রের জন্য এতকিছু তা আবারও চলে গেল স্বৈরাচারের দখলে।
১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। স্বাদের গণতন্ত্র বেহাত হলো আবারও। প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ জনগণ বারংবার ফুঁসে উঠেছে ঢাকাসহ সমগ্র দেশের রাজপথে। মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই দেশের রাজপথ বেশ কয়েকবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ড. মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে স্মারকলিপি জমা দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
নক্ষত্রের আত্মোৎসর্গ
সে ঘটনার পরের বছরেই নিজের ক্ষমতা দখলকরণকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টায় উপজেলা পরিষদ গঠন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উদ্দেশ্য উপজেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তবে এসব চিন্তা-ভাবনার আগে থেকেই এরশাদের বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন। ইতোমধ্যেই ৮ ও ১৫ দলীয় জোট এরশাদের পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছিল। থেমে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর তাদের সাথে পূর্বেই যুক্ত হয়েছে ১১টি শ্রমিক ফেডারেশনের জোট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। সেই শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তাজুল ইসলাম। কাজ করতেন এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীতে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন রুখে দিতে সে বছরের পয়লা মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেয় ৮ ও ১৫ দলীয় জোট। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ (শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ পরবর্তীতে স্কপ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে) একই দিনে বেশ কিছু দফার ভিত্তিতে সারাদেশের কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে হরতালের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘট ডাকে।
হরতাল ও ধর্মঘট পালনের জন্য প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে। এরশাদের শাসনামলে একবারও বন্ধ না হওয়া আদমজীর চাকা যে এবার বন্ধ করতেই হবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসে ততই মিটিং মিছিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমবর্ধমান হারে। হরতালের আগমুহূর্তে ২৮ ফেব্রুয়ারির এক মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ারের ওপর ট্রাক তুলে দেয় সরকারের অনুগত পুলিশবাহিনী। ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় সেদিনই নিহত হন সেলিম ও দেলোয়ার। তাদের মৃত্যুর ফলে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আরও দ্বিগুণ রোষে ফেটে পড়ে এরশাদের বিরুদ্ধে। হরতাল ও ধর্মঘট পালনে চলে সব রকমের প্রস্তুতি।
১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি ছিল অধিবর্ষ। অতিরিক্ত একটা দিন সময় পাওয়া গিয়েছিল প্রচার-প্রচারণা চালাবার জন্য। তাই শেষবারের মতো সঙ্গীদের নিয়ে মিছিলে নেমেছিলেন তাজুল ইসলাম। হরতাল ও ধর্মঘট সফল করার উদ্দেশ্যে মিছিল শেষে শ্রমিকরা যার যার বাড়ি ফিরে যাবে এমনটাই কথা ছিল। হয়তো তাজুল ইসলামও ভেবেছিলেন বাড়ি গিয়ে আরাম করে একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু তাজুল ইসলামের এই অতি জনপ্রিয়তা বরদাস্ত করতে পারেনি শাসকগোষ্ঠী। বহুদিনের শত্রুকে তাই তারা শেষ করতে চেয়েছে নিমিষে। মিছিলের মধ্যেই শাসকের অনুচরেরা সশস্ত্র হামলা চালায় শ্রমিকনেতা তাজুল ইসলামের ওপর। ছুরিকাঘাত ও রড দিয়ে পিটিয়ে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলে রেখে যায়। অন্যদের সহায়তায় তাকে আহত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
পয়লা মার্চে আদমজি পাটকলের সবকটি মেশিন বন্ধ থাকে। হরতাল এবং ধর্মঘট পালিত হয় সফলভাবে। আর সফলতার মজুরি না নিয়েই মহাকাশ থেকে খসে পড়ে সকলের প্রিয় নক্ষত্র শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলাম। জীবন দিয়ে সফল করেন শ্রমিকদের দাবি আদায়ের ধর্মঘট। তার স্মরণে পয়লা মার্চকে ‘তাজুল দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
নক্ষত্রের উত্থান
কুমিল্লার মতলব থানার ইছাখালি গ্রামের অতিশয় দরিদ্র এক পরিবারে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিয়েছিলেন তাজুল ইসলাম। সাধারণ আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাননি কখনো। খুব অল্প বয়সেই তার মাতৃবিয়োগ ঘটেছিল। সংসারে মাতৃহীন শিশুর চাইতে নিরাধার কেউ পৃথিবীতে থাকে না। অদম্য তাজুল স্রোতের জলে ভেসে যাননি, সিনা টান করে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী জীবনের গল্প লিখেছেন অবিরত।
টুকটাক খুচরা হরেক রকমের কাজ করে শৈশব কেটেছে তাজুলের। কখনো মানুষের বাসায় কাজ করেছেন গৃহভৃত্য হিসেবে, কখনো রাজপথে ছুটে বেড়িয়েছেন আইসক্রিমের ডালা হাতে নিয়ে। জীবন তাকে কষাঘাত করেছে প্রতিনিয়ত। অস্তিত্বের সমরে টিকে থাকতে অবিরত তাকে নিদারূণ অধ্যবসায়ের তপস্যা করে যেতে হয়েছে। কঠিন সময়গুলোতেও জীবনের হাল ধরেছিলেন শক্তহাতেই।
পড়াশোনার প্রতি প্রগাঢ় অভিপ্রায় তাকে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করেছে প্রবলভাবেই। মতলবেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সমগ্র কুমিল্লা অঞ্চলে প্রথম হয়েছিলেন। এসএসসিতে পেয়েছিলেন তিনটি লেটার। কলেজে ভর্তি হবার বাসনায় প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকা কলেজে। কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে (ফার্স্ট ক্লাস), ১৯৬৮ সালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র
তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মেধাবীরা অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করার সুযোগ পেত। জীবন যুদ্ধের নিরত সৈনিক তাজুলের জীবন ছিল অনিশ্চিত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে নানান পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রতিবারই উতরে গেছেন সম্মানের সাথে। এত পরীক্ষা ছাপিয়ে ছিল না মেধার কমতি, সেই সাথে ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার এক বিশাল ভাণ্ডার। ভর্তি হয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন, নিজে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সর্বদা রাজপথে সরব ছিলেন। একাত্তরে তার বহু সহপাঠী যখন গর্তে লুকাতে ব্যস্ত তখন তিনি অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে লিপ্ত। দেশ স্বাধীন করে আবারও পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম।
তাজুল ইসলাম জানতেন, শ্রমিকদের হয়ে লড়তে হলে তাদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়েই লড়তে হবে। দূর থেকে আস্ফালন করে গেলে চলবে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিভাগের সেরা ডিগ্রির জ্ঞানটাকে পুঁজি করে তিনি ছুটে যান মেহনতি মানুষের পাশে। কাজ নেন আদমজী জুটমিলের শ্রমিক হিসেবে।
১৯৭৫ এবং তার পরবর্তী সময়ে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিযুক্ত করেন তাজুল। বসবাস শুরু করেন আদমজী জুট মিলের শ্রমিকদের কলোনিতে, ঠিক যেমনটা করেছিল মুনতাসির। প্রচণ্ড একাগ্রতা নিয়ে মানুষের পক্ষে লড়বার অদম্য, নির্মল শক্তি নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন তাজুল ইসলাম। চাইলে বিলাসী জীবন-যাপন করতে পারতেন। হতে পারতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা সরকারি যেকোনো বড় কর্মকর্তা। হয়তো বেঁচে থাকতে পারতেন এখনো, ঘুরতে পারতেন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে। কিন্তু বিলাসী জীবনের চাইতেও মানুষের দুর্দশা তাকে অতিমাত্রায় ভাবায়, ফলে আদমজীর শ্রমিক কলোনি হয়ে ওঠে তার আপন নিবাস।
কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মই নেয় ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করে। যতদূর পর্যন্ত ক্ষুধার্ত মানুষের কান্নার শব্দ শোনা যায়, ততদুর পর্যন্ত তারা মানুষের পক্ষে কাজ করে যেতে চায়। কেউ হয়তো কখনো সফল হয়, পৃথিবীতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আর কেউ কেউ নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে আর বাকি দায়িত্বটুকু অর্পণ করে যায় আগামীর তরুণদের হতে। তরুণ আসে, তরুণ যায়; কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য কি বদলায়? প্রশ্নটা থেকেই যায়।
তাজুল মুনতাসির সম্পর্কে জানতেন কিনা তা জানা যায় না, তবে আহমদ ছফা কিন্তু তাজুল সম্পর্কে ঠিকই জানতেন। তাই ঊনসত্তরের গল্পই পূর্ণতা লাভ করেছিল পচাত্তর হয়ে চুরাশিতে। তাজুলের আত্মা তার দেহ ত্যাগ করলেও তার আদর্শ এখনো মিইয়ে যায়নি। যেখানে সে কাজ শেষ করেছিল সেখান থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আর এগিয়ে আসতে হবে এই প্রজন্মের তরুণদেরই, যেভাবে এগিয়ে এসেছিল শহীদ তাজুল ইসলাম।
ফিচার ইমেজ – এডিটেড বাই রাইটার