পরীক্ষা শেষ। এবার বই-খাতা, টেবিলের জাল থেকে বেরিয়ে ভ্রমণে যাওয়া যাক। কিন্তু কোনো দলের সাথে নয়, একাই। হাতে সময় মাত্র একদিন। আমরা ছিলাম দুজন। লক্ষ্য স্বল্প খরচে হাজারখানেক টাকার ভেতর ঢাকার বাইরে যাওয়া। যেমন বলা তেমন কাজ। দুজনে মিলে অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করে বাছাই করলাম এবং বাজেটের মধ্যে পছন্দ করলাম সীতাকুণ্ড। ঠিক একদিন পর আমাদের যাত্রা শুরু।
দিনটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২; রোজ রবিবার। ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে রেলপথ খুবই জনপ্রিয় হওয়ায় আমরাও সন্ধ্যার পর চলে আসলাম ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। একদিনের ভ্রমণ হিসেবে যারা চট্টগ্রাম বা সীতাকুণ্ড বেছে নেয়, তাদের অনেকেই যাওয়া-আসার সময়টুকু রাতে করতেই পছন্দ করে। এতে সকাল-সন্ধ্যা সারাদিন ঘোরার সুযোগ পাওয়া যায়।
কোনো আন্তঃনগর ট্রেনই সীতাকুণ্ডে থামে না, সোজা চট্টগ্রাম চলে যায়। তাই আমরা যাব লোকাল ট্রেন অর্থাৎ চট্টগ্রাম মেইলে চড়ে। মেইল ট্রেনগুলোর টিকেট কাটার নিয়ম হচ্ছে ট্রেন প্লাটফর্মে আসার ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট, এমনকি এক ঘন্টা আগে কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। তার আগে এসব ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় না। জনপ্রতি ১১০ টাকায় টিকেট সংগ্রহ করে অপেক্ষা করি ট্রেনের জন্য।
ওহ, হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো- মেইল ট্রেনগুলোতে একমাত্র কেবিন ছাড়া যাত্রীদের নির্দিষ্ট কোনো আসন থাকে না। ট্রেন প্লাটফর্মে এসেছে ১০টা বেজে ৪৫ কী ৫০ মিনিটে। দৌঁড়ে ট্রেনের কাছে গিয়ে দেখি কোনো আসন ফাঁকা নেই, এবং যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও হুড়াহুড়ি করে উঠে পড়লাম কামরায়। উঠেই আঁচ করতে পারলাম- আমাদের কামরায় সীতাকুণ্ডগামী কোনো এক ভ্রাম্যমান সংগীতদল আছে। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছে। আর আমরাও আমাদের ব্যাগগুলো রেখে দাঁড়িয়ে আছি ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায়। রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও প্লাটফর্মে আসতে এবং ছাড়তে কিছুটা বিলম্ব করে। রাত ১১টা বেজে ১৩ মিনিট, হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ঢাকা ছেড়ে যাত্রা করল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
কামরার প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে আছি, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের হিমশীতল হাওয়া গায়ে আছড়ে পড়ছে। ভ্রাম্যমান শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল দাঁড়িয়ে কিংবা বসে যেভাবেই যাই না কেন, খুব আনন্দের সাথেই যেতে পারব। কিন্তু দাঁড়ানোর জায়গাটা তেমন সুবিধার মনে হচ্ছিলো না, এবং নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে অনেক যাত্রী ওঠার সম্ভবনা থাকায় স্টেশনে পৌঁছানোর সাথে সাথেই কামরার একটু ভেতরে মাঝ বরাবর চলে যাই।
অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্টেশন ত্যাগ করে ছুটে চলছি পরবর্তী স্টেশনের দিকে। আমাদের ট্রেনটি লোকাল বা মেইল ট্রেন হওয়ায় কম-বেশি প্রায় সব স্টেশনেই থামছে। ভৈরব বাজার জংশন অতিক্রম করে আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশের মধ্য দিয়ে ট্রেন চট্টগ্রাম বিভাগের সীমানায় ঢুকে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনকে পেছনে ফেলে আখাউড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। জানতে পারি- আখাউড়া জংশন রেলওয়েতে ক্রসিং আছে। এই স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বমুহূর্তে একটি ফাঁকা আসন পেয়ে যাই, সেখানে চেপে চেপে দুজনই বসে পড়ি। হুইসেল বাজিয়ে আমাদের রেলগাড়ি জানান দিচ্ছে ক্রসিংয়ের পর্ব শেষ, ছেড়ে যাবে পরবর্তী স্টেশনের দিকে।
রাত গভীর থেকে গভীরে। ততক্ষণে সংগীতশিল্পীরা গান বন্ধ করে টুকটাক গল্প করছে। চলছে রেলগাড়ি। কামরাভর্তি মানুষ। কেউ আসনে বসে ঘুমাচ্ছে, কেউ মেঝেতে জুতা, কাপড় কিংবা কোনো কিছু ছাড়াই বসে পড়েছে। আবার কেউ দাঁড়িয়ে থেকে চোখ বুঝে ভাবছে- কখন বসার জায়গা হবে! সবার উদ্দেশ্য একই- একটু ঘুমিয়ে শরীরকে খানিকটা সতেজ করা। কারণ পূর্বাকাশে সূর্যের উদয় হলে ট্রেন থেকে নেমেই কেউ ছুটবে নিজ গ্রামে, কেউ দাপ্তরিক কাজে, কেউ বা পরিকল্পিত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। তবে আমাদের ট্রেনে থাকা সিংহভাগ যাত্রীই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসেছেন।
চোখ বুজে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি কোথায় ঘুরবো, কী করবো, আবার কোথা থেকে কীভাবে ফিরব এগুলো ভাবতে ভাবতেই আমাদের রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে জানান দিল- কসবা রেলওয়ে স্টেশন পেরিয়ে আমরা এখন কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে।
একসময় ট্রেন লাকসাম জংশন রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করে ফেনী জংশন রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাল। জানালা বন্ধ, বাইরের তীব্র কুয়াশা ভেদ করে ঠান্ডা বাতাস কামরার ফাঁকফোকর দিয়ে গায়ে লাগছে। সারা রাতের ক্লান্তি নিমিষেই মুছে গেল। আবারও চলছে ট্রেন। পরবর্তী স্টেশন সীতাকুণ্ড, আমরা নেমে যাবো সেখানেই। ভাবতেই মনটা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
ঘড়ি বলছে, এখন সময় সকাল ৬টা বেজে ৫৭ মিনিট রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে সীতাকুণ্ড রেলওয়ে স্টেশনে থামল। ব্যাগ হাতে নেমে দেখলাম- বহু মানুষ আমাদের সাথেই নেমেছে। বুঝতে পারলাম, তারা সবাই পর্যটক, ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসেছেন।
আমরা দুজন শীতের কুয়াশা সাথে নিয়েই সীতাকুণ্ড নামফলকের সাথে ছবি তুলে স্টেশন দিয়ে বের না হয়ে রেললাইন ধরে দুই মিনিট পায়ে হেঁটে সড়কে উঠি। সেখান থেকেই সিএনজিতে জনপ্রতি ৩০ টাকায় চলে গেলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সামনে। বলা বাহুল্য, সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা, তবে পুরো সিএনজিতে শুধু আমরা দুজন থাকায় অতিরিক্ত ২০ টাকা দাবি করেন চালক। সিএনজি থেকে নেমে মাথাপিছু ৩০ টাকায় লাঠি ভাড়া করে নিলাম। বলে রাখা ভালো, লাঠি ভাড়া ১০ টাকা, তবে তার সঙ্গে আরও ২০ টাকা যোগ করে মোট ৩০ টাকা জমা দিতে হবে। ফেরার পথে লাঠি ফেরত দিলে তারা আবার ২০ টাকা বুঝিয়ে দেয়।
সকাল ৭টা বেজে ৩৮ মিনিট; শুকনো খাবার খেয়ে আমরা দুজন পাহাড়ে ট্রেকিং শুরু করলাম। আমরা সকাল সকাল যাওয়ায় পাহাড়ে খুব বেশি মানুষ ছিল না। সবুজের মিতালী থেকে আসা শীতল হওয়া গায়ে মেখে আর ছোট ছোট প্রাণীদের খুনসুটি দেখতে দেখতে সোয়া এক ঘন্টা পর আমরা চন্দ্রনাথের চূড়ায় পৌঁছে যাই। চূড়া থেকে পুরো সীতাকুণ্ড শহর দু’চোখ ভরে দেখে রীতিমতো অবাক হলাম। সমস্ত ক্লান্তি শরীর থেকে উড়ে গেল।
চার-পাঁচ কদম এগিয়ে দেখতে পেলাম চন্দ্রনাথ মন্দির। চন্দ্রনাথ পাহাড় আর মন্দির দেখতেই সীতাকুণ্ডে ছুটে আসেন বহু দর্শনার্থী।
চূড়ায় অল্প কিছুক্ষণ থেকে মন্দিরের পাশে থাকা সিঁড়ি দিয়ে নামার প্রস্তুতি নিলাম। পাহাড়ে উঠতে যে পরিশ্রম হয়, নামতে তেমন একটা কষ্ট লাগে না। তবে নামার সময় সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয় বিধায় পায়ে খানিকটা কম্পন অনুভূত হয়।
ঘড়ি বলছে ৯টা বেজে ৪৫ মিনিট; আমরা নেমে এসেছি পাহাড় থেকে। তারপর পাহাড়ে যাওয়ার সড়ক ধরে থাকা বিভিন্ন মঠ-মন্দির দেখতে দেখতে চলে গেলাম সিএনজি স্ট্যান্ডে।
এবার লাঠি জমা দিয়ে সেখান থেকে ২০ টাকার বিনিময়ে রিকশায় চড়ে চলে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজারে। বাজার থেকে ১০ টাকার বিনিময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে সিএনজিতে চলে গেলাম ফকিরহাটে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্কে যাওয়ার মূল সড়কে।
সিএনজি থেকে নেমে হাতের বামপাশের সড়ক ধরে সোজা পাঁচ থেকে সাত মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্কে। জনপ্রতি ৩০ টাকার বিনিময়ে টিকেট সংগ্রহ করে আইসক্রিম খেতে খেতে সবুজে ঘেরা কিছু অংশ ঘুরে দেখলাম।
অল্প কিছুক্ষণ পার্কে ঘুরে বেরিয়ে এসে চলে গেলাম ইকো পার্কে যাওয়ার মূল সড়কে। সেখান থেকে স্থানীয় লোকাল বাসে জনপ্রতি ১০ টাকার বিনিময়ে চলে গেলাম বাঁশবাড়িয়া বাজারে। বাজার থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় জনপ্রতি ২০ টাকার বিনিময়ে চলে গেলাম বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে।
সৈকতের আশপাশ ঘোরাঘুরি করে সিএনজিতে জনপ্রতি ২০ টাকায় চলে গেলাম বাঁশবাড়িয়া বাজারে। সেখান থেকে কক্সবাজারগামী হানিফ পরিবহনে জনপ্রতি ৩০ টাকায় চলে গেলাম অলংকার মোড় নামক জায়গায়। বাস থেকে নেমে পেছন দিকে পাঁচ মিনিট পায়ে হেঁটে চলে গেলাম এ. কে. খান নামক জায়গায়। সময় তখন ভরদুপুর। সকালে শুকনো খাবারের পর আর কিছু খাওয়ার সুযোগ পাইনি। তাই ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। সেখানে থাকা এক রেঁস্তোরায় জনপ্রতি ৩০০ টাকায় চট্টগ্রামের বিখ্যাত মেজবান খেয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম।
খাবার সেরে দুজন মিলে ভাবছিলাম কোথায় যাব। যেহেতু সন্ধ্যা হতে মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি, সেহেতু দূরে কোথাও না গিয়ে এ. কে. খান মোড় থেকে লোকাল বাসে জনপ্রতি ১৫ টাকায় চলে গেলাম চট্টগ্রাম পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নতুন রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে জানতে পারলাম- রাত ১০টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে ঢাকা মেইল। বলা বাহুল্য, এখানেও ট্রেন আসার ঘন্টা দু-তিনেক আগে টিকেট সংগ্রহ করা যাবে। যা-ই হোক, যেহেতু মোটামুটি ভালো একটা সময় আমাদের হাতে আছে, তাই আমরা রেলওয়ে স্টেশনের পাশেই নিউ মার্কেট ও সদরঘাট এলাকায় ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেই।
নির্দেশনা
- চন্দ্রনাথ পাহাড় ট্রেকিংয়ের সময় সবসময় বামপাশের পথ ধরে উঠতে হবে। ডানপাশের পথ নামার জন্য। বিপরীতে উঠতে গেলে অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।