দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আমাদের জানার আগ্রহের শেষ নেই। থাকবেই না বা কেন? এই এক যুদ্ধে যে পুরো পৃথিবীর দৃশ্যপটই পাল্টে গিয়েছিল। বাস্তবিক অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনীর বিস্তৃতিও অনেক ব্যাপক। অল্প পড়া বা জানায় এই ইতিহাসের সমাপ্তি টানা দুষ্কর। আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কোনো আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে এমন দুটি স্থানের উপর আলোকপাত করতে যাচ্ছি যা অনেক বছর ধরেই এই ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে আছে।
বাংলাদেশ তখন ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। সেই সময়কার যুদ্ধে নিহত অনেক সৈনিকের সম্মানার্থে ব্রিটিশ সৈন্যদের অধীনে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি সমাধিস্থল তৈরি করা হয় যা ‘ওয়ার সিমেট্রি’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার ময়নামতিতে দুটি ওয়ার সিমেট্রি রয়েছে। কমনওয়েলথ গ্রেভ কমিশনের বাংলাদেশ শাখার ব্যবস্থাপনায় সিমেট্রি দুটির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক এলাকা চট্টগ্রামের মেহেদীবাগের ১৯ নং বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে এ ওয়ার সিমেট্রিটি অবস্থিত। চট্টগ্রামের মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, চট্টেশ্বরী সড়কের চারুকলা ইনস্টিটিউটের কাছাকাছি এবং ফিনলে গেস্ট হাউসের নিকটবর্তী পাহাড়ি রাস্তার কিছুটা ঢালু আর কিছুটা সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে এই সমাধি। সিমেট্রির চারপাশ অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সবুজের সমারোহ আর নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ যে কারও মনে এনে দিতে পারে অনাবিল ভালো লাগা।
এবার ঢোকা যাক ওয়ার সিমেট্রির ভেতরের অংশে, যেখানে প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতেই সমাধিস্থলের মাঝ বরাবর একটি অপূর্ব ক্রুশ চিহ্নিত বেদি চোখে পড়ে। দক্ষিণ দিকের একটি ঘরে রাখা আছে ‘মেমোরিয়াল বুক’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাণিজ্যিক নৌবহরে সাড়ে ছয় হাজার নাবিক মারা যায় যাদের লাশের হদিস মেলেনি কখনো। তাদের নাম ও পদবি এই মেমোরিয়াল বুকে সংরক্ষিত আছে। পাশের ঘরে আরেকটি রেজিস্টারে ৭৫৫ জন সৈনিকের নাম, পদবী ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
যুদ্ধ চলাকালীন সময় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং ১৫২ নং ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতালের সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনী চতুর্দশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। হাসপাতালটি ডিসেম্বর ১৯৪৪ থেকে অক্টোবর ১৯৪৫ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলো। সেই সময়ে এই ক্যাম্পে প্রচুর সৈন্যকে আহত অবস্থা থেকে সুস্থ করে দেশে পাঠানো হয়েছিল। আর যারা সেই জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তাদের সম্মানার্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দল এই সমাধিসেৌধ প্রতিষ্ঠা করে।
প্রাথমিকভাবে এই সমাধিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০০ মৃতদেহ সমাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও যুদ্ধ শেষে অতিরিক্ত মৃতদেহ লুসাই, ঢাকা, খুলনা, যশোর, কক্সবাজার, ধোয়া পালং, দোহাজারি, রাঙ্গামাটি, পটিয়া এবং অন্যান্য অস্থায়ী সমাধিস্থান থেকে এই সমাধিস্থানে স্থানান্তর করা হয়। তবে বর্তমানে এখানে ৭৩১টি সমাধি বিদ্যমান যার মধ্যে ১৭ জনের কোনো পরিচয় মেলেনি। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জাতীয় বিদেশী সৈন্যদের প্রায় ২০টি (১জন ওলন্দাজ এবং ১৯জন জাপানি) সমাধি বিদ্যমান। এছাড়াও এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) চট্টগ্রাম-বোম্বের একটি স্মারকও রয়েছে।
পেশা অনুসারে এই সমাধিস্থলে সৈনিক ৫২৪ জন, বৈমানিক ১৯৪ জন এবং নাবিক আছেন ১৩ জন। আবার দেশ হিসেবে দেখলে যুক্তরাজ্যের নিহত সৈনের সংখ্যাই বেশি। শুধু যুক্তরাজ্যের আছে ৩৭৮ এবং তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের আছে ২১৪ জন। এছাড়াও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, আফ্রিকা, মায়ানমার- এসব দেশের সৈন্যদেরও সমাধি রয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে নির্মিত এ সিমেট্রির বাইরের আংশে খোলা মাঠ রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্যে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত থাকে যা শীতকালীন ও রোজার সময় কিছুটা পরিবর্তন ঘটে থাকে।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
বাংলাদেশে অবস্থিত অন্য আরেকটি ওয়ার সিমেট্রি হলো ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি’ যেটি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ও ময়নামতি সাহেবের বাজারের মাঝামাঝি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাম পাশে অবস্থিত। প্রায় সাড়ে চার একর পাহাড়ি জমির উপর অবস্থিত এই সমাধিস্থলটি যেন প্রকৃতি এবং বিষণ্ণতাকে এক অন্য রূপে আবদ্ধ করে রেখেছে।
ময়নামতি ছিল তখনকার সময়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম। তৎকালীন মিত্রবাহিনীর সেনাবাহিনী কুমিল্লা অঞ্চলের গুরুত্ব অনুধাবন করে, কেননা কুমিল্লা ছিল যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র ও বিমান ঘাঁটি। এখানে স্থাপিত হয় বড় একটি হাসপাতাল। এই সমাধিক্ষেত্রের ৭৩৬টি কবরের অধিকাংশতে আছেন সে সময়কার হাসপাতালের মৃত সৈনিকরা। তাছাড়াও যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে রয়েছেন ৩ জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক।
সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি তোরণ ঘর যার ভিতরের দেয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে দেয়াল ফলক হিসেবে রাখা হয়েছে। একটু সামনে এগিয়ে গেলেই প্রশস্ত পথের দু’পাশে সারি সারি কবর ফলক দেখা যাবে। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক চিহ্নিত করা আছে। পুরো সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে প্রচুর গাছের সমারোহ। বিভিন্ন ফুলের সৌরভে চারপাশ মোহিত। সমাধিক্ষেত্রের সম্মুখ অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি মূলত ২৩ জন বিমান সৈনিকের একটি গণকবর।
চট্টগ্রামের মতো এখানেও যুক্তরাজ্যের সৈনিকদের সংখ্যায় বেশি। ৩৫৭ জন যুক্তরাজ্যের এবং ১৭৮ জন অবিভক্ত ভারতের সৈন্যের সমাধি রয়েছে। এছাড়াও কানাডা, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশের সৈনিকও শায়িত রয়েছেন এখানে। ঈদের দু’দিন ছাড়া বছরের প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ১টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ সমাধিস্থল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
ওয়ার সিমেট্রি দুটোতে প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সৈনিকের আত্মীয় পরিজনরাও তাদের প্রিয়জনের সমাধি দেখতে আসে। নিয়ে যায় ছবি, যা শুধু স্থির ক্যানভাসেই দৃশ্যমান। নিজের দেশের সেবায় নিয়োজিত থেকে হাজার মাইল দূরে এই যে শত শত সৈনিকদের সমাধি পড়ে রয়েছে, তা দেখে মনে কিছুটা ব্যথা অনুভব হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এই ওয়ার সিমেট্রিগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য এখানে ঘুরতে আসা অনেক দর্শনার্থীদের মাঝেই পাওয়া যায় না। অনেকেই আমরা ভুলে যাই এটি একটি কবরস্থান যার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং নীরবতা পালন আমাদের একান্ত দায়িত্ব। যুদ্ধ নয়, শান্তিই হোক এই ওয়ার সিমেট্রিগুলোর আলোক নির্দেশিকা।