বিশ্বজুড়েই জলবায়ু পরিবর্তন একটি প্রধান সমস্যা, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা দেশগুলো এর প্রধান ভুক্তভোগী। কোথাও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, কোথাও লবণাক্ততা বাড়ছে, কোথাও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুসংস্থান, এবং সেটি পুষিয়ে উঠার আগেই আবার তাকে আরেকটি দুর্যোগ আঘাত করছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ লবণাক্ততার কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে, সময়ের সাথে তা আরো বাড়বে বলেই গবেষকদের ধারণা। তবে লবণাক্ততার ভয়াল থাবা শুধু কৃষিজমিতেই সীমাবদ্ধ নেই, তা সৃষ্টি করছে স্বাস্থ্য সমস্যারও।
বিশ্বের নানান আলোচনা সভা আর রাজনীতির টেবিলে যখন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন আর লবণাক্ততা বৃদ্ধি নিয়ে আলাপ চলছে, তখন বাংলাদেশের মানুষ ভুগছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা স্বাস্থ্য সমস্যায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। সেই পানি পান করার ফলে মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়ছে, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা শিকার হচ্ছেন নানান জটিলতার। দীর্ঘদিন খাদ্য পানিয়ে উচ্চমাত্রার লবণ গ্রহণের প্রভাব পড়তে পারে মানুষের গড় আয়ুতেও। অনেক গবেষকই বলছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা বিশাল আকার ধারণ করার আগেই এটি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।
লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, খাবার এবং পানীয় মিলিয়ে একজন ব্যক্তি একদিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার মিলিগ্রামের কাছাকাছি সোডিয়াম গ্রহণ করবেন। এরচেয়ে বেশি সোডিয়াম দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ, বিশেষ করে অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ করলে তাতে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়, আমাদের রেচনকাজের সাথে জড়িত অঙ্গ কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই খাদ্য পানীয় কিংবা কোমল পানীয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ যাতে দেহে প্রবেশ না করে সে ব্যাপারটি মাথায় রাখা জরুরি।
অতিরিক্ত লবণের উৎস
তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় পানির উৎসগুলো অনুসন্ধান করে দেখা যায় সেখানে খাবার পানিতে গড় সোডিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটারে ৭০০ মিলিগ্রাম, কোথাও কোথাও তা লিটারে ১৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। যেখানে আমাদের সাধারণ খাবার পানিতে সোডিয়ামের মাত্রা হওয়া উচিত লিটারে বিশ থেকে ত্রিশ মিলিগ্রাম। মূলত রান্না করা খাদ্য থেকেই আমরা সোডিয়ামের বেশিরভাগ অংশ গ্রহণ করে থাকি।
তবে উপকূলীয় এলাকার পানিতে সোডিয়ামের যে মাত্রা, খাদ্য বাদেই কোনো ব্যক্তি যদি গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনি লিটার পানি পান করে তাহলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিরাপদ মাত্রা সে অতিক্রম করে যাচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে এই কাজ করে যাওয়ার পরে তার দেখা দিচ্ছে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা।
তৈরি করছে সামাজিক সমস্যা
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিটি বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি দৃশ্যমান। কৃষি, মানুষের ভূমি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এমনকি আচার আচরণে প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। অন্য দশটা পরিবর্তনের মতোই লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি প্রথমে আঘাত করছে সমাজের নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে, তৈরি করছে সামাজিক বৈষম্য।
লবণাক্ততার কারণে জমিতে আগের মতো ফসল ফলছে না, বিশেষ করে ধান এবং সবজির আবাদ মাটির লবণাক্ততার উপর নির্ভরশীল। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন জাত নিয়ে গবেষণা চললেও চাষিদের কাছে সহজলভ্য হয়নি এখনো সেগুলো। ফলে প্রান্তিক কৃষক যাদের জমি চাষ করে বেঁচে থাকাই একমাত্র সম্বল তারা পাড়ি জমাচ্ছে শহরগুলোতে, ভাসমান কিংবা ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করছে। কাগজে কলমে এরাই জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে পরিচিত।
আবার যাদের হাতে বিনিয়োগের পুঁজি আছে, অর্থাৎ সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ তারা অনেকেই ঝুঁকছেন চিংড়ি চাষের দিকে। অনেকে উচ্চমাত্রার সার ব্যবহার করে ফসল আবাদের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উপকূলীয় এলাকায় সামাজিক বৈষম্যও বাড়িয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন করে তৈরি হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষ।
পানির উৎস ব্যবহারেও সামাজিক বৈষম্য দেখা যায় বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। নিম্নবর্গের মানুষ সরাসরি পুকুর, কুয়া কিংবা সরকারি কিংবা অবস্থাসম্পন্ন মানুষের বাড়িতে থাকা গভীর কিংবা অগভীর টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করেন। তার খাবার পানির নিরাপত্তা নেই তবে ধনী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি পানি আহরণের দিক থেকে একটু স্বাধীনতা ভোগ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা গভীর নলকূপ কিংবা পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থা করতে পারে, যা নিম্নবর্গের মানুষেরা পারে না।
উপকূলীয় এলাকায় দেখা যাচ্ছে মাটির কাছাকাছি থাকা পানির স্তরে লবণাক্ততা বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত দশ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে ছোটবড় অনেক জ্বলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে, এবং এগুলো উপকূল থেকে অনেক ভেতরে থাকা পুকুর কিংবা খালের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। সামুদ্রিক পানি সমতলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট পকেট সৃষ্টি করেছে। এর ফলে অগভীর নলকূপগুলোতে লবণাক্ততার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। যেহেতু বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ পানি সংগ্রহের জন্য এসব উৎসের উপর নির্ভর করে, তাই লবণাক্ততার প্রথম থাবা পড়ছে তাদের ঘাড়ে।
স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা
বাংলাদেশের মানুষের মাঝে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তাই এই স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততা কতটা জড়িত তা নিয়ে কাজ করছেন অনেক বিজ্ঞানী। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ, স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিকাল মেডিসিন, বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি সহ বিশ্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। বিশেষ করে খুলনার দাকোপ, বাটিয়াঘাটা, পাইকগাছা এলাকার পানির বিভিন্ন উৎস, সেই উৎসে লবণের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
এখানে পানিতে লবণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। এবং গবেষকরা এই পানি পানের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক পেয়েছেন। পেশা, বয়স, লিঙ্গ, খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যের সাথে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ এবং বিভিন্ন মাত্রা মাথায় নিয়ে দেখা গেছে যারা এই এলাকার মানুষ তারা তুলনামূলকভাবে বেশি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে পানির মাধ্যমে লবণ অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করায়।
খাদ্যের সাথে ১.৯ গ্রাম অতিরিক্ত লবণ শরীরে ঢুকলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। গবেষক দলটি দেখিয়েছে এই অতিরিক্ত ১.৯ গ্রাম লবণ শুধু পানি থেকেই গ্রহণ করছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ। গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে উচ্চ রক্তচাপে পানীয়ের সাথে লবণ গ্রহণ করা খাদ্যের সাথে লবণ গ্রহণ করার চেয়ে ক্ষতিকর। মানুষ যেহেতু নিয়মিত ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে লবণাক্ত পানি গ্রহণ করে যাচ্ছে সুতরাং এখনই পদক্ষেপ না নিলে এটি দীর্ঘমেয়াদে এই এলাকার প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
কী করতে পারে বাংলাদেশ?
জনস্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিবেদন থেকে উঠে আসা চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করতে বাংলাদেশের বরাবরই দুর্বল। কারণ এই সমস্যাগুলো মহামারির মতো দৃশ্যমানভাবে মানুষের বিপর্যয় করে না, লবণাক্ততা থেকে উদ্ভূত উচ্চ রক্তচাপ অনেকটা আর্সেনিকের মতোই ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর সমাধান হতে পারে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানিতে লবণাক্ততাকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় পানির সংকট তৈরির সাথে সাথে মানুষ এই দিকগুলোতে মনোযোগ দিচ্ছেন, অনেকে সুফলও পাচ্ছেন। তবে সেই সুফলে অংশীদার করতে হবে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষকেও। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রাম ও মফস্বলের মানুষ, যারা পানির জন্য অন্য কারো উপর নির্ভরশীল, যাদের হাতে বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন ধরে রেখে ব্যবহার করার মতো পুঁজি নেই কিংবা লবণাক্ততা কমিয়ে আনার প্রযুক্তি বসানোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা যাদের নেই। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এবং এর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে বাস্তুসংস্থানকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের সুফল যাতে কৃষকের কাছে পৌঁছে সেই ব্যাপারটি লক্ষ্য রাখতে হবে।