বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি জেলা, বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন শহরগুলোর একটি । সকলে যেখানে ঘুরে বেড়াতে কক্সবাজার, বান্দরবান, কুমিল্লা, নাটোর ইত্যাদি স্থানে যায়, সেখানে পর্যটকদের কাছে এক অনন্য আকর্ষণের নাম যশোর। আর যা-ই হোক, ঘুরতে গিয়ে নিরাশ হবেন না। খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এই জেলাটি প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রকাশের অপেক্ষা রাখে না। খুলনাকে বিভাগ করার আগে যশোর এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে একত্রে বৃহত্তর যশোর বলা হতো। এর থেকেই বোঝা যায় কতটা গুরুত্ব বহন করে এই যশোর।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১২ জন আউলিয়া সহ পীর খান জাহান আলী আসেন যশোরের মুড়লীতে। সেখানেই তাঁরা তাদের কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাদের আগমনের পর ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে উঠতে থাকে একটি শহর। নতুন শহরটি তখন মুড়লী কসবা নামে পরিচিত পেয়েছিল। এর প্রায় এক শতাব্দী পর ১৫৫৫ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর রাজ্য। সেই যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যশোর-খুলনা-বনগাঁ এবং ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া জেলার কিছু অংশ। যশোর রাজ্য আবার নাটোরের রানী ভবানীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৭৪৭ সালে।
শেষ পর্যন্ত ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর জেলা। যশোর পৌরসভা গঠিত ১৮৬৪ সালে। ১৯৪৭ সালে এটি ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে যে অংশটুকু রয়েছে তা এখন খুলনা বিভাগের অংশ আর এর বাকি অংশ এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা নামে পরিচিত। বর্তমানে যশোর জেলার মোট ৮টি উপজেলা রয়েছে। বলতে গেলে প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে পর্যটক আকর্ষণ।
যশোর জেলার বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রসমূহ
যশোর জেলা ভ্রমণে গিয়ে কম করে হলেও অর্ধশতাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেগুলো ঘুরে না দেখলে আফসোস করতে হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক যশোর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্পর্কে।
১) অভয়নগর
যশোর জেলার অন্তর্গত অভয়নগর উপজেলাটি বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে এমন সব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে যা না দেখলে ভ্রমণ সার্থক হবে না।
পুড়াখালি বাওড়
অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজারঘাট পার হয়ে শংকরপাশা গ্রামে পৌঁছে সেখান থেকে ১০ টাকা ভ্যান ভাড়া দিয়েই পৌঁছে যাবেন দিয়াপাড়া নতুনবাজার। আর সেখানেই চোখে পড়বে সুবিশাল বৃত্তাকার নান্দনিক পুড়াখালি বাওড়। পদ্ম আর শালুকের মেলার কালো টলটলে অথৈ পানির চারপাশ ঘিরে অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ২০০০ সালের আগপর্যন্তও পরিত্যক্ত ছিল এই বাওড়। ২০০০ সালে পর এটি সংস্কার করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
এই শীতকালে ঘুরতে গেলে দেখতে পারেন অজস্র অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর এই বাওড় অঞ্চল। শুধু তাই নয়, গোধূলি লগ্নে লালচে আভায় স্বর্গীয় রূপ লাভ করে এই বাওড়। তাই যশোর ভ্রমণে গিয়ে একবার অন্তত এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য অনুভব করে আসতেই পারেন।
ভাটপাড়ার জগন্নাথধাম
২০০০ বছর পূর্বে ‘মাগধ’ বা ‘ভাট’ সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করেছিল অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের জগন্নাথধামে। ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে যেমন পবিত্র স্থান, তেমনই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। এ স্থানকে ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক ঘটনার পরিব্যাপ্তি। অলৌকিক উপায়ে ভৈরব নদী দিয়ে ‘ভাটা’ হতে উজানের দিকে আসা নিমতরু (দারুবৃক্ষ) দিয়ে দয়ারাম গোস্বামীর আশ্রমে স্থাপিত জাগ্রত দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও মুভদ্রার মন্দির আনুমানিক ১৪৫০ খিষ্টাব্দে এ প্রতিষ্ঠিত বলে ধারণা করা হয়। দয়ারামের গৃহে এর আগে রাধা-কৃষ্ণের পূজো হতো বলে জানা যায়।
জগন্নাথধামের পাশেই রয়েছে আরেকটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরে শ্রী চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্যের মূর্তিগুলো দর্শককে যেন চৈতন্যযুগে নিয়ে যায়। ভাটপাড়া বাজারের পশ্চিমপ্রান্তে রথমন্দির অবস্থিত। প্রতিবছর অসংখ্য লোকের সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে ‘রথমেলা’। একসময় ভাটপাড়া রথমেলা লক্ষাধিক লোকের পদচারণায় লোকারণ্য হয়ে উঠত বলে জানা যায়। আগেকার অনেক কিছুই এখনো নেই, তব ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন এই নিদর্শন স্বচক্ষে অবলোকনে।
১১ শিব মন্দির
যশোরের চাঁচরার রাজা নীলকন্ঠ রায় আনুমানিক ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে এই ১১ শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে ইতিহাসে জানা যায়। রাজা তার মেয়ে অভয়ার অনুরোধে ১১টি কষ্টিপাথর দিয়ে ১১টি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে দেন এবং এই অভয়নগর নামটি রাজা নীলকণ্ঠের মেয়ের নামানুসারেই করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা সে ১১টি কষ্টি পাথরের মূর্তিই চুরি করে। মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে আছে একটি প্রধান প্রবেশপথ। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির দরজা ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফলকে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। মন্দিরের চারদিকই প্রাচীরবেষ্টিত। এর উত্তর-পশ্চিম কোণে নাকি একসময় পুকুর ছিল। মন্দিরটি সরকারি পদক্ষেপে সম্প্রতি সংস্কার করানো হয়েছে। যেতে পারেন সেই পুরাকীর্তি দর্শনেও।
২) সাগরদাঁড়ি
বাংলা কবিতায় সনেটের প্রবর্তক বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান এই সাগরদাঁড়িতে রয়েছে মধুপল্লী, তাঁর বাড়ি। যশোর বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে কেশবপুর ইউনিয়নে কপোতাক্ষ নদের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সেই মধুপল্লী। প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলে দেখা মিলবে কবির ভাস্কর্য, আর তার পরেই কবির সেই বাড়ি। বাড়িটি এখন জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার করা হয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শণার্থী যান এই সাগরদাঁড়িতে একবার মধুসূদনের বাসভূমিকে দেখতে। জানুয়ারিতে সেখানে মেলা বসে। প্রবেশমূল্য মাত্র ১০ টাকা। কবির বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি মোটেল, চাইলে সেখানে থাকতেও পারবেন।
৩) ইমামবাড়া
হাজী মোহাম্মদ মহসিন কর্তৃক ১৮০৫ সালে নির্মিত এই ইমামবাড়া মুরোলি ইমামবাড়া নামেও পরিচিত। এর ভেতরের পিলারে এবং দেয়ালে আল্লাহু, হাসান, হুসেইন লেখা অনেক ক্যালিগ্রাফি দেখতে পাওয়া যায়। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। যশোর সদরে ঢাকা-খুলনা হাইওয়েতেই এই ইমামবাড়া অবস্থিত।
৪) বেনাপোল বর্ডার গেট
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলের অবস্থানও কিন্তু যশোরেই। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত নির্দেশক এই স্থানে গিয়ে আপনিও দেখতে পারেন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ভারতকে। এই সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। শুধু বইয়ের জ্ঞানকে স্বচক্ষে দেখার মতো সুযোগ যশোর ভ্রমণে এসে নিশ্চয়ই হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
৫) চাঁচরা শিবমন্দির
ছবি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কতটা আকর্ষণীয় একটি মন্দির এটি। সপ্তদশ শতকে, আনুমানিক ১৬৯৫ সালে রাজা মনোহর রায় এই দবতল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। যশোর-বেনাপোল হাইওয়েতেই পড়বে এই মন্দিরটি। তাই বেনাপোল দর্শনে যাওয়ার পথে দেখে যেতে পারেন এই পুরাকীর্তিটি।
৬) ভরত দেউল
কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর তীরে ভরত ভায়না গ্রামে রয়েছে ভরত দেউল। দেউলটিকে একটি ছোটখাটো টিলার মতো দেখায়। এই দেউলটি খ্রিস্টীয় ২য় শতকের গুপ্তযুগের নিদর্শন বলে ধারণা করা হয়। ১৯২৩ সালে এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খননের কাজ চলে এই স্থানে। প্রায় ৯৪টি কক্ষ, একটি মঞ্চ, কয়েকটি মন্দিরের দেখা মিলেছে এই ভরত ভায়নায়, পাওয়া গিয়েছে নানা পোড়ামাটির ফলকে নারীর মুখমন্ডল এবং নানা নকশার বৃহদাকার টেরাকোটা। এমন একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা একবার হলেও দর্শনে যাওয়া উচিত সকলের।
৭) যশোর কালেক্টরেট ভবন
সেই ব্রিটিশ আমলে ১৮০১ সালে যশোর দরাটানা মোড়ে নিমিত হয় এই কালেক্টরেট ভবন। এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভবনটি।
৮) মির্জানগর হাম্মামখানা
সুবেদার শাহ সুজার শ্যালকপুত্র মীর্জা সফসিখানে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হবার পর তার নামানুসারেই এলাকাটির নাম হয় মির্জানগর, যেখানে একটি নবাববাড়ি ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে নুরলা খাঁ ফৌজদার নিযুক্ত হলে তিনি সেখানে সুবিস্তৃত পরিখা খনন করেছিলেন এবং একাংশে বানিয়েছিলেন একটি হাম্মাম যেটি এখনও সেই যুগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
৯) ঝিকরগাছার গদখালি
পৃথিবীর বিভিন্ন বাগানবিলাস দেখে যেতে না পারার আফসোস না করে আপনি ফুলের রাজধানী যশোর জেলার ঝিকরগাছার গদখালি থেকে একবার ঘুরে আসুন। বিশ্বের যেকোনো বাগানবিলাস উপভোগের চেয়ে অনেকটা বেশিই উপভোগ করতে পারবেন এই বাগানবিলাসে গিয়ে। যেদিকে তাকাবেন শুধু রঙের সমাহার, প্রজাপতির ডানার জৌলুস, মৌমাছির গুঞ্জন আর পাখ-পাখালির কলরবে মন ভরে যাবে। সেই ১৯৮৪ সাল থেকে এখানে ফুলের চাষ করা হচ্ছে। এখানকার ফুল রপ্তানিও করা হয়। শুধু ফুলই নয়, নানা ধরনের সবজির চাষও করা হয় এই গদখালিতে। এককথায় মনোরম দৃশ্যের দেখা মিলবে।
এছাড়াও যেতে পারেন যশোরের বধ্যভূমি, যশোর এয়ারপোর্ট, ইমাম বাড়ি, যশোর সার্কিট হাউজে। পরিবার নিয়ে বিনোদনের জন্য বিনোদিয়া পার্ক, জেস গার্ডেনের মতো আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্র। রয়েছে পুড়াখালি বাওড়ের মতো অনিন্দ্যসুন্দর আরও কিছু বাওড়। মোট কথা, যশোর ভ্রমণে গিয়ে বিন্দুমাত্র নিরাশ হবেন না। আসছে শীতে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়ে খেজুরের গুড়ের বিখ্যাত যশোর জেলা ভ্রমণের পরিকল্পনাটি তাহলে করেই ফেলুন।
ফিচার ইমেজ- bdjessore.wordpress.com