সেই রাতের কথা হয়তো এখনো ভুলতে পারেন না রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন। ৪০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে সেই রাতের পর। কিন্তু সেই রাতের ঘটনাকেই জীবনের সকল ধ্যান-জ্ঞান মেনে অনেকটা জীবন অতিবাহিত করে এসেছেন জয়নাল। তার স্বপ্ন ছিল একটাই, যেভাবেই হোক সে রাতের মতো কষ্ট যেন আর কাউকে সহ্য করতে না হয়। চিকিৎসার অভাবে স্বজন হারানোর আর্ত চিৎকার যেন আর কাউকে শুনতে না হয়।
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. দূরের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম টান হাসাদিয়া। সেই গ্রামে ছিল না কোনো সরকারী সুযোগ সুবিধা। চিকিৎসার জন্য গ্রামের লোকদের পাশের সিরতা বাজারের একমাত্র ওষুধের দোকানের উপর নির্ভর করতে হতো। অন্যথায় সদরের থানা হাসপাতাল ছিল শেষ ভরসা, যা ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। জয়নাল আবেদীনের বৃদ্ধ পিতা আবদুল গনি এক দুর্যোগ রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জয়নাল দৌড়ে ছুটে যান সিরতা বাজারে ঔষধের খোঁজে। কিন্তু ভাগ্যদেবতা খুব সুপ্রসন্ন ছিলেন না জয়নালের জন্য। দোকান বন্ধ পেয়ে ফিরে আসলেন অসুস্থ পিতার কাছে।
ভাইদের সহযোগিতায় পিতাকে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর জয়নাল বুঝতে পারলেন ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তার পিতা। বিশ বছরের যুবক জয়নাল তার পিতার জন্যে কিছুই করতে পারলেন না, এই চিন্তা বারবার মনে আঘাত করছিল তাকে। পিতাকে যে খুব বেশি ভালোবাসতেন জয়নাল। বিনা চিকিৎসায় পিতার এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। সেই মুহুর্তেই নিজের সবকিছু ভুলে গিয়ে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করলেন। যে করেই হোক হাসাদিয়া গ্রামের জন্যে একটি হাসপাতাল তিনি নির্মাণ করবেনই। গ্রামের আর কোনো গরীব লোককে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেবেন না।
স্বপ্ন যত বড় হোক না কেন, বাস্তবতা ছিল নিতান্তই কঠিন। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায়িত্ব উঠে আসে বড় ভাই জয়নালের কাঁধে। এদিকে সংসারের জন্য কিছু করতে হবে, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা। অভাবের সংসারে কারো লেখাপড়া করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। গ্রামে সচ্ছল হওয়ার জন্য তেমন কাজের সুযোগও ছিল না। স্বপ্ন পূরণ করতে হলে তার অর্থের প্রয়োজন আর সেই অর্থ আসতে হবে সৎ পথের উপার্জন থেকে। অনেক ভেবে ঢাকায় আসার মনঃস্থির করলেন জয়নাল। স্ত্রী ও শিশুকন্যা মমতাজকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন জয়নাল, সাথী করে নেন এক দুর্নিবার স্বপ্ন পূরণের আশা।
এরপর শুরু হয় তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কঠিন সংগ্রাম। ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন জয়নাল। নিজের বউকে কিছু না জানিয়ে সোনালী ব্যাংকে দুটি একাউন্ট করেন তিনি। সেখানে অল্প অল্প করে টাকা জমাতে থাকেন। অনেক কষ্ট করে সংসার চলতে থাকে। বিপদের দিনেও জমানো টাকায় হাত দেননি। এভাবে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রিক্সা চালিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা জমান জয়নাল। ধীরে ধীরে আশার মুখ দেখতে থাকে জয়নালের স্বপ্ন।
২০০১ সালের দিকে জয়নাল তার জমানো টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে যান এবং পরিবার ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারে পরামর্শ করেন। কিন্তু তার এমন প্রস্তাব শুনে সকলেই ব্যাপারটিকে হাসি-ঠাট্টায় উড়িয়ে দিতে থাকেন। কিন্তু অদম্য উৎসাহী জয়নাল হাল ছাড়েন না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও পাশের গ্রামের যুবক পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন তার পাশে এসে দাঁড়ান। আলী হোসেনের সাহস এবং সহযোগিতায় ২৪ শতক জমি কিনে শুরু করে দেন হাসপাতাল তৈরির কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই আধাপাকা টিনশেড ঘর তৈরি হয়ে যায়। আর চোখের সামনে সত্যি হয়ে ধরা দেয়ার অপেক্ষার দিন গুনতে থাকে জয়নালের স্বপ্নের হাসপাতাল।
অবশেষে ২০০১ সালের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে মমতাজ হাসপাতাল। নিজের মেয়ের নামেই নাম রাখেন হাসপাতালের। প্রতিদিন অসুস্থ মানুষদের বিনামূল্যে সকাল-বিকাল চিকিৎসা শুরু করেন পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। শুধু তা-ই নয়, রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধও প্রদান করা শুরু করেন জয়নাল। হাসপাতালের মূল লক্ষ্য ছিল যেন প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে না হয়। রোগী খুব গুরুতর হলে থানার সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
এভাবেই স্বপ্নকে সত্যিতে রূপান্তরের গল্প শুরু জয়নালের। সামান্য রিকশাচালক থেকে নিজের ইচ্ছা, আগ্রহ ও কষ্টের ফলস্বরূপ এই মমতাজ হাসপাতাল। তবে শুধু হাসপাতাল শুরু করেই থেমে থাকেননি জয়নাল। ষাট বছর বয়সেও ঢাকায় এসে় রিক্সা চালান আর সেই কষ্টের টাকা নিয়ে ওষুধ কিনে ফিরে যান তার হাসপাতালে। হাসপাতালে কয়েকটি গাভীর দেখাশুনা করা হয়, যার দুধ বিক্রি করে বিভিন্ন খরচ মেটানো হয়।
যারা একসময় তার হাসপাতাল করার চিন্তাকে কটুক্তি ও অবাস্তব ভেবেছিল তারাও এই হাসপাতালের সুবিধা গ্রহণ করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ জনেরও বেশি রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসে এই হাসপাতালে। ছোট এই হাসপাতালটিতে শয্যা রয়েছে ৬টি। এর সাথে রয়েছে একটি ঔষধালয়, যেখানে প্রয়োজনীয় নানা ঔষধ পাওয়া যায়।
২০১১ সালের দিকে পত্রপত্রিকায় জয়নালের এই হাসপাতাল বেশ আলোচিত হয়। ধীরে ধীরে প্রচার পেতে শুরু করে জয়নালের ‘মমতাজ হাসপাতাল’। তখন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও সংগঠন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে হাসপাতালের পরিধি। নতুন করে হাসপাতালের ঘর তৈরি করা হয়। ভবিষ্যতে আরো বড় করে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে পরিণত করার ইচ্ছা জয়নালের। চ্যানেল একাত্তরকে দেয়া জয়নালের একটি সাক্ষাৎকার নিচে যুক্ত করা হলো।
তবে রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন শুধু হাসপাতাল বানিয়েই ক্ষান্ত হয়ে থাকেননি। তার মতো অনেক সংসারের শিশুরা পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত। ব্যাপারটি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন জয়নাল। শিক্ষার অভাবে তাকে অনেক জায়গায় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। নিজে একটি গণশিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেছিলেন। আর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২০০৭ সালে নির্মাণ করেন ‘টান হাসাদিয়া বেসরকারি শিশু স্কুল’। শুধুমাত্র ১০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে কয়েকশ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শুধুমাত্র বিনা বেতনেই নয়, বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম, এমনকি ব্যাগসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয় এই বিদ্যালয়ে।
আকারে ছোট হলেও হাসপাতালটির সাথে মিশে রয়েছে অনেক প্রেম, ভালোবাসা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, পরিশ্রম, শপথের আগুন এবং অন্যের জন্য কিছু করার দুর্দমনীয় আবেগ। অদম্য ইচ্ছা এবং সাহসের কাছে মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই। কিছু পাওয়ার একাগ্রতা এবং তা অর্জন করার যে অক্লান্ত পরিশ্রম সেটুকু দিতে পারলেই সব প্রতিবন্ধকতাই পেরোনো সম্ভব। আমাদের সমাজে অনেক সভ্য, প্রতিভাশীল, সম্পদশালী বিত্তবান মানুষজন ছড়িয়ে রয়েছেন যারা সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন শুধুমাত্র নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের আশায়। অন্যের জন্য ভাবার তাদের সময় নেই। তাই জয়নাল নামের মানুষগুলো সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বিদ্রূপ এঁকে দেয় আমাদের নীরব অপারগতার।
ফিচার ইমেজ- indiegogo.com