১৯৬০ এর এক সাইক্লোনে সীতাকুণ্ডের কাছে বিকল হয়ে পড়ে এক গ্রীক জাহাজ নাম “এমভি আলপাইন”। পড়ে ছিলো অনেকদিন, মরচে পড়ছিলো লোহা লক্কড়ে। চিটাগং স্টীল হাউজ সেই জাহাজটিকে কিনে এক বছরের মাথায় শুরু করেছিলো সেই জাহাজ ভাঙ্গার কাজ, উদ্দেশ্য ছিলো জাহাজের লোহা লক্কড়গুলো পুনরায় ব্যবহার করা।
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে তখন চলছে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের বিপ্লব। সুলভ শ্রমিক আর দীর্ঘ সমুদ্রসীমার সুবিধা নিয়ে এ ১৯৬০ জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে হাতেখড়ি হয় বাংলাদেশের। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জাহাজ “আল আব্বাস” ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জাহাজ বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কিনে নেয় কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস। এই জাহাজ ঘিরেই ফৌজদারহাট এলাকার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরু হয়। মূলত স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস নিয়মিত দেশী-বিদেশী জাহাজ ভাঙার কাজ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করে। ২০১৪ সালে চিটাগাং শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড এলাকাতেই ধারণ করা হয় Avengers: Age of Ultron সিনেমার একটি দৃশ্য। গুটি গুটি পায়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এগিয়ে চলা এই শিল্প কিভাবে পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ জাহাজভাঙ্গা শিল্পে?
জাহাজভাঙ্গা শিল্পের প্রেক্ষাপট
প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরেই পরে জলপথে তাণ্ডব চালানো বিশাল সব অকেজো জাহাজ দিয়েই বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়। যদিও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে তা শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে পরিবেশগত আন্দোলন এবং এই শিল্প সংশ্লিষ্ট শ্রমের খরচ অনেক বেড়ে যাবার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই শিল্প বিস্তার লাভ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুলভ শ্রমিকের আশীর্বাদ হয়ে আসা এই শিল্প এই অঞ্চলে দ্রুত বিস্তার করে । যদিও এ শিল্পের জন্য দরকারি উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি এ অঞ্চলে।
এশিয়ায় এ শিল্পের ঘাঁটি
১৯৭৭ এ তাইওয়ান একাই সারা বিশ্বের জাহাজ ভাঙা শিল্পের অর্ধেকের নিয়ন্ত্রক ছিলো। বাকি অর্ধেক ছিলো স্পেন আর পাকিস্তানের দখলে। ১৯৮০ র দশকে এসে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা হয় “গান্দানি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড”। এটি ছিলো তৎকালীন সময়ের এককভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড। একসাথে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করতে পারে এই ইয়ার্ডে। এই গান্দানি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ১৩২টি জাহাজ ভাঙার প্লট রয়েছে। তাইওয়ানের চেয়ে অনেক কম সময়ে আর কম খরচে জাহাজ ভাঙা শুরু করে পাকিস্তানের এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। আর তাই এই শিল্পের সিংহভাগ দখল করে নেয় তারা।
ভারতে শাখা-প্রশাখা মেলে এই শিল্প
আন্তর্জাতিক রাজনীতির সুবিধা আর বাণিজ্যিক প্রণোদনা পেয়ে ক্রমপরিবর্তিত এই শিল্প ভারতের উপকূলীয় এলাকায়ও বিস্তার লাভ করে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের এক নাম্বারের জায়গাটি দখল করে নেয় ভারতের আলাং (Alang) শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। ভারতের গুজরাট রাজ্যের শিল্প প্রণোদনা পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গান্দানি শিপ ব্রেকিং-কে ছাড়িয়ে যায় আলাং শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড, পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল জাহাজ ভাঙার কেন্দ্রে।
১৯৯৮ সালে আলাং শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে প্রায় সাড়ে তিনশ জাহাজ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে, যা থেকে ১৩৩ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক লাভ হয় এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের। আলাং এর সাফল্যের পেছনে হাত আছে ভারতের বিশাল দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকের। বছর ঘুরে তাই এই আলাং এলাকায় এই জাহাজ ভাঙা শিল্পের আকারটা ও চক্রবৃদ্ধি হারে বড় হচ্ছে। মূলত জাহাজের প্রতিটা অংশকে খুলে ফেলে একে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয় এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে। এই কাজটি করার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যেরও একটি বিশাল বাজার তৈরি করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে এই শিল্প।
বাংলাদেশে এই শিল্পের বিস্তার
বাংলাদেশে তখনো চলছে এই শিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ। ক্রমপরিবর্তনশীল এই শিল্প বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে ধীরে ধীরে নোঙর ভিড়ায়। উপকূলীয় অঞ্চলের নিরক্ষর আর অদক্ষ শ্রমিকের কাঁধে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।
বাংলাদেশে সমুদ্রতটে ১৯৬০ জন্ম নেওয়া এই শিল্পের আকার আর শ্রমিক সংখ্যায় বিশাল আকার হতে থাকে আশির দশকে। ৯০ এর দশকে বিশ্বে জাহাজ ভাঙা শিল্পে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ। প্রতি বছর লোকবল আর শিল্পের আয়তন বাড়ছে চক্রগতিতে। ২০০৮ সালে ২৬টি জাহাজ ভাঙা হয়েছিল যা ২০০৯ সালে ৪০ এ দাঁড়ায়। ২০০৪ থেকে ২০০৮ এই ৪ বছরে আলাং আর গান্দাপি এই দুই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জাহাজ ভাঙার শিল্প হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ২০১২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঐ বছর পঞ্চম অবস্থানে নেমে আসে বাংলাদেশ। মূলত সাশ্রয়ী শ্রমিকের সহজলভ্যতা বাংলাদেশে এই শিল্পকে দ্রুত জনপ্রিয়তা দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রতিযোগী দেশগুলো যেখানে অটোমেশনের দিকে মন দিয়েছে, সেখানে এখনও হাতে চালিত যন্ত্রপাতি দিয়ে জাহাজ ভাঙ্গার মতো কঠিন শিল্পের শিখাকে জাগিয়ে রেখেছে আমাদের শ্রমিকেরা।
তবে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ছোট বড় দুর্ঘটনা এই শিল্পকে বিভিন্ন সময় ফেলেছে ভয়াবহ ভাবমূর্তি সংকটে। ২০০৯ সালের মার্চে হাইকোর্ট থেকে দেওয়া এক রায়ে এই শিল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আর উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশ এসেছিলো। কিন্তু কর্মপরিবেশ নিরীক্ষণ করার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় ঠিক রয়ে গেছে আগের মতোই। এই শিল্প স্থাপনের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই সাগরের কূলবর্তী অঞ্চলে চলছে একের পর এক ইয়ার্ড স্থাপন। ২০০৯ এ জাহাজভাঙা শিল্পের ইয়ার্ডের সংখ্যা ছিল ৬৮, ২০১০ এর মধ্যে তা বেড়ে হয়েছে ১২০।
বাংলাদেশে এই শিল্পের মানবেতর কর্মপরিবেশ নিয়ে “ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক” এর করা এক প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। গ্রীনপিস সহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশের জাহাজভাঙ্গা শিল্পের বর্জ্য নিষ্কাশন নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কারণ এই শিল্পের বর্জ্য হিসাবে ভারি ধাতু, তেল সহ ক্ষতিকারক সব রাসায়নিক সরাসরি সাগরে নিষ্কাশিত হয় বলে সাগরের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে। এখনই এই শিল্পের বর্জ্যে পরিবেশসমত উপায়ে নিষ্কাশনের দিকে মনোযোগ না দিলে এই শিল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে বঙ্গোপসাগর পরিণত হবে উন্নত দেশের ভাঙ্গা জাহাজের আস্তাকুড়ে।
জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন
বাংলাদেশসহ সাড়া পৃথিবীজুড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন প্রায় ১০০,০০০ শ্রমিক। প্রতি বছর পৃথিবীর সামুদ্রিক নেটওয়ার্কে চলাচলকারী প্রায় ৪৫,০০০ জাহাজের প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ জাহাজ অকেজো হয়ে পড়ে। সেই জাহাজগুলো তাদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে পৃথিবীব্যাপী ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে। মূলত একটি জাহাজ ব্যবহৃত লোহার ৯৫ শতাংশকে এই শিল্পের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা হয়। কিন্তু এই বিশাল শিল্পের চালিকাশক্তি যে শ্রমিক, তাদের নেই সঠিক কর্মপরিবেশ। বাংলাদেশে এই শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ১০০-১২০ টাকা দিনপ্রতি মুজুরীতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে যাচ্ছেন। এই ৩০ হাজার শ্রমিকের প্রায় ২০ শতাংশই আবার শিশুশ্রমিক।
মেয়াদোত্তীর্ণ এসব জাহাজে থাকা দাহ্য পদার্থের বিস্ফোরণে বিভিন্ন সময়ে বিকলাঙ্গ হয়েছেন কিংবা মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক শ্রমিক। এই সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তি আর দক্ষ শ্রমশক্তির মিশেল। তাই এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হতে হবে আর মনোযোগী।