সিরিয়াল কিলিং বা ক্রমিক খুন বিশ্বের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা ভাবে সংগঠিত হয়েছে এই নৃশংস অপরাধ। কখনো মানসিক সমস্যা আবার কখনো অন্যান্য কারণে সিরিয়াল কিলার তথা ক্রমিক খুনি একের পর এক চালিয়ে যায় হত্যা। রাগ, নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ, অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবার জন্যও সিরিয়াল কিলাররা মানুষ হত্যা করে। এদের কেউ একসময় ধরা পড়ে, আবার কেউ এতই চালাক হয় যে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। বাংলাদেশের এমনি কিছু খুনিকে নিয়ে লেখা হয়েছে ‘বাংলাদেশি সিরিয়াল কিলার’ লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব।
অজ্ঞাতনামা খুনি
এখন পর্যন্ত রাজধানীর দক্ষিণখানেই দেখা গেছে এই খুনিকে। ফর্সা, প্রায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, সুদর্শন এই যুবককে দেখলে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ হবে না সে একজন ক্রমিক খুনি। শিক্ষিত ও মার্জিত বাচনভঙ্গির এই যুবক শিকার হিসেবে বেছে নেয় মধ্যবয়সী ধনাঢ্য নারীদের। বাসা ভাড়া নেবার অজুহাতে সে তার শিকারের বাড়িতে আসে। গৃহকর্ত্রী তাকে ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে গেলে সে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করে। তবে আশেপাশে লোকজন থাকলে সে কিছুই না করে সরে আসে। এখন পর্যন্ত তিনজনকে খুন ও দুজনকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে সে। রুচিশীল পোশাক পরিহিত, কাঁধে ব্যাগ নেয়া এই যুবককে দেখে ঠাহর করা কঠিন যে সে খুনের মতো কাজও করতে পারে।
এই অজ্ঞাতনামা খুনি তার কাজ শুরু করে ২০১৬ সালের ২৪শে জুলাই থেকে। সেদিন দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইর এর এক বাসায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার উছিলায় হাজির হয় এই খুনি। গৃহকর্ত্রী শাহিদা বেগম (৫০) বাসা দেখাতে নিয়ে গেলে সে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। পরদিন অর্থাৎ ২৫শে জুলাই দক্ষিণখানের আশকোনা মেডিকেল রোডের ২৩৫ নং বাসার গৃহকর্ত্রী মাহিরা বেগমকে (৫০) কুপিয়ে জখম করে সে। মাহিরা বেগমের স্বামী সুলতান আহমেদ বাসায় সাবলেট ভাড়া দেবার জন্য নোটিশ টানান। বেলা সাড়ে ১১ টার সময় ঐ যুবক ৪র্থ তলায় উঠে এসে মাহিরা বেগমের সাথে ভাড়ার ব্যাপারে আলাপ করতে থাকে। এরপর ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে মাহিরা বেগমের মাথায় দুটি ও গলার পেছনে একটি কোপ দিয়ে পালিয়ে যায় এই খুনি। রক্তাক্ত ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
২১শে আগস্ট পূর্ব মোল্লারটেকে তার পরবর্তী শিকার হতে যাচ্ছিলেন সুরাইয়া আক্তার (৫২)। একই পদ্ধতিতে খুন হন তেঁতুলতলা ইয়াসিন রোডের এই নারী। স্থানীয়দের তথ্যমতে, নিহত এই নারী বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে পরিবারসহ থাকতেন। বাড়ীটির ৩য় তলায় ফ্ল্যাট খালি ছিল এবং সেটি দেখাতে গিয়েই এই নারী খুন হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঐ ফ্ল্যাটেই তার রক্তাক্ত নিথর দেহ পাওয়া যায়।
অতঃপর ঐ মাসের ৩১ তারিখ সে উত্তরার দক্ষিণ আজমপুর এলাকায় খুঁজে নেয় পরবর্তী শিকার। আজমপুরের মুন্সি মার্কেট এলাকার ৮১/৩৯ নম্বর বাড়ির কাজী মজিবুর রহমানের স্ত্রী জেবুন্নেসা চৌধুরীকে (৫৬) কুপিয়ে আহত করে। তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আঘাতের জন্য তার দুটো চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নেবার অজুহাতের আশ্রয় নেয় এই খুনি। চতুর্থ তলায় ফ্ল্যাট দেখাতে গেলে তার উপর আক্রমণ হয় বলে জানা গেছে। আহতের মতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কোপানো শুরু হয়। তার দেয়া বর্ণনার সাথে অন্যদের দেয়া খুনির চেহারার বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি স্কুল ব্যাগ এবং লোহার চাপাতি জব্দ করে পুলিশ।
এই ধূর্ত খুনির এখন পর্যন্ত সর্বশেষ শিকার দক্ষিণখানের আশকোনার গাওয়াইরের দক্ষিণ পাড়ার ৭১৫ নম্বর বাড়ির ওয়াহিদা আক্তার সীমা (৪৪)। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নীল-কালো শার্ট ও কালো প্যান্ট পরিহিত এক যুবক বাড়ির নিচে আসে। যুবকের হাতে ব্যাগ ছিল। নিহতের মেয়ে শারমিন আক্তার (২২) ঐ ব্যক্তির কাছে আসার কারণ জানতে চাইলে সে বাসা ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলবে বলে জানায়। ব্যাচেলর ভাড়া দেয়া হয় না বলার পর পরিবার নিয়ে থাকবে বলে জানায় ঐ ব্যক্তি। তিনতলা থেকে চাবি নিচে ফেলে ঐ যুবককে কাঁচিগেট খুলে উপরে আসতে বলেন তিনি। এরপর ওয়াহিদা তাকে ষষ্ঠতলায় ফ্ল্যাট দেখানোর জন্য নিয়ে যান। এর ১৫ মিনিট পর শারমিন আক্তার সেখানে গেলে রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝেতে মায়ের মৃতদেহ দেখতে পান।
খুনির অন্য শিকারের মতো এখানেও গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মেঝেতে পানি পাওয়া যাওয়ায় ধারণা করা হয় খুনের পর নিজের শরীর থেকে রক্ত মুছতে ও জুতোতে রক্তের দাগ লাগা ও তার ছাপ রুখতে সে পানি ব্যবহার করে। এই ঘটনার আগেরদিনও পাশের একটি বাড়িতে গিয়েছিল এই খুনি। কিন্তু তাকে যে ফ্ল্যাটটি দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয় সেটির আগের ভাড়াটিয়া তখনও না চলে যাওয়ায় সে তার উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয় এবং ফ্ল্যাট না দেখেই সেখান থেকে চলে যায়। যাবার আগে বলে যায়- সে যে কাজের জন্য এসেছিল তার লাভ হয়নি। কি কাজ জিজ্ঞাসা করা হলে সে “কোনো কাজ হলো না” বলে চলে যায়। পার্শ্ববর্তী বিল্ডিঙয়ের সিসিটিভি ফুটেজে তার গমনদৃশ্য দেখা যায়, যদিও তাতে চেহারা অস্পষ্ট।
র্যাব-এর আঁকিয়েদের দিয়ে তার একটি চিত্র প্রস্তুত করা হলেও সে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। অত্যন্ত ধূর্ত এই খুনি বাসা ভাড়ার অজুহাতে নানা বাসায় হাজির হলেও কখনোই ভাড়ার জন্য দেয়া ফোন নম্বরে ফোন করে না। সে চাপাতি চালানোতে বিশেষভাবে দক্ষ। মাঝবয়সী সম্পদশালী নারীদের উপর তার কোনো কারণে ক্ষোভ রয়েছে। এসব ঘটনার কারণে দরজায় বেল বাজলেই আঁতকে উঠছে দক্ষিণখানবাসী।
পিচ্চি বাবু
পিচ্চি বাবু ওরফে বাবু ওরফে মোমিন আরেকজন সিরিয়াল কিলার। সর্বমোট ৭টি খুন করা এই ক্রমিক খুনি ঢাকার নানা এলাকা থেকে মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে বগুড়া এনে খুন করে। তার খুন করা ৭ জনের মধ্যে ৫ জনই নারী।
ঢাকার যাত্রাবাড়িতে থাকাকালীন ২০০৫ সালে তরমুজ ব্যবসায়ী সামাদের (৪০) সাথে পরিচয় ঘটে পিচ্চি বাবুর। ব্যবসায়ের কথা তুলে তাকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গা নিয়ে যায়। এরপর ৫০,০০০ টাকা সামাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, তাকে খুন করে লাশ একটি সেফটি ট্যাঙ্কে গুম করে ফেলে সে। পরবর্তীতে সে মাদক ও দেহব্যবসা এবং সোনা চোরাচালানের অপরাধে জড়িয়ে যায়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ঢাকার মিরপুর থেকে সোনিয়া (২০) নামক এক নারীকে শিবগঞ্জের মেঘাখদ্দে নিয়ে আসে সে এবং গণধর্ষণ করে তাকে হত্যা করা হয়। পরদিন গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ভুট্টাক্ষেত থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
২০১১ সালের অক্টোবরে আবাসিক হোটেল থেকে লাকি আক্তার (১৮) নামক এক তরুণীকে ধরে এনে অনুরূপ নির্যাতন করে হত্যা করে। ঐ নারীর মরদেহ অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে ঐ গ্রামের ঈদগাহের পাশ থেকে উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তানিয়া (২২) নাম্নী তরুণীকে পল্টন থেকে শিবগঞ্জের নন্দীপুরে নিয়ে যায় এবং পরদিন তারও লাশ পাওয়া যায়। পরবর্তী শিকার ঢাকার মহাখালীর লিপি (২০)। তাকে শিবগঞ্জ এনে তার সঙ্গে থাকা মালামাল কেড়ে নিয়ে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এবং লাশ হলুদ ক্ষেতে ফেলে দেয় খুনি। নভেম্বর মাসে শাপলা (২০) নামের অন্য এক তরুণীকে ঢাকার মালিবাগ থেকে ধরে এনে ধানক্ষেতে ধর্ষণের পর লাশ ফেলে যায় সে।
তার সর্বশেষ শিকার তার এক স্ত্রীর ভাগ্নে সুজন (১৬)। নিজের মিথ্যে অ্যাক্সিডেন্টের খবর দিয়ে স্ত্রী নিপাকে শিবগঞ্জের ময়দানহাটা ইউনিয়নের মহব্বত নন্দীপুর মাঠে কলাবাগানে আসতে বলে। নিপা ও সুজন সেখানে গেলে প্রায় রাত ১১টার সময় সে বাড়ি পৌঁছে দেবার নাম করে সুজনকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। এরপর নিপার ওপর বলপ্রয়োগ করে সে। তবে সুজনকে হত্যার পর তার মানসিক অবস্থা যথাযথ না থাকায় সে নিপাকে হত্যা করতে পারে না। ভোরে তাকে রেখে পালিয়ে যায় বাবু। সুজন হত্যার খবর জানাজানি হলে নিপা লাশ শনাক্ত করেন এবং তার সহায়তায় ঢাকার উত্তরখান থেকে গ্রেপ্তার হয় পিচ্চি বাবু ও তার সহযোগীরা। বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক পিপিএম এর ভাষ্য অনুযায়ী বাবু ৭টি খুনের কথা স্বীকার করলেও প্রকৃতপক্ষে সে ১৭টি খুন করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তরিকুল
কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার রসু খাঁর কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। নারীদের নানাভাবে পছন্দসই স্থানে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যাকারী সেই ক্রমিক খুনির পথেই হাটতে চেয়েছিল তরিকুল। রসু খাঁ হতে চাওয়াই তার ইচ্ছা ছিল বলে স্বীকার করেছে সে, যদিও রসুর মতো অতদূর সে যেতে পারেনি।
২০১৬ সালের ১২ই এপ্রিল মধ্যবাড্ডার এক বাসা থেকে শহিদা আক্তার সীমা নামক গার্মেন্টসকর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে খোঁজখবর করে ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কেরানীগঞ্জ থেকে তরিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তরিকুল ও সীমার মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। ২০১৫ সালে তারা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ঐ বাসা ভাড়া নেয়। তরিকুল মাঝে মাঝে সেখানে থাকতোও। এরপর একদিন সীমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তরিকুল। সীমা ছাড়াও তার তিন স্ত্রী ছিল ক্রমান্বয়ে তারা হলো- চম্পা, হনুফা ও বৃষ্টি। এছাড়া আরো চারজনের সাথে বিয়ের কথা চলছিল তার। পুলিশের ধারণা দ্বিতীয় স্ত্রী হনুফাকেও হত্যা করেছে তরিকুল।
নানান কারণে সিরিয়াল কিলিং এর নৃশংসতায় নাম লেখায় খুনি। খুনি খুন করে যায় নিজস্ব ঢঙে, স্বজনহারা হয় সাধারণ মানুষ। এদের কেউ কেউ ধরা পড়ে, কেউ বা অধরাই থেকে যায়। তবুও হয়তো একটু সাবধানতা অবলম্বনে জীবন বেঁচে যেতে পারে।