দেশবিভাগ অপরিহার্য ছিলো কিনা, সে প্রশ্নে না গিয়েও এটা স্পষ্টতই বলা যায়, রাজনীতিবিদ ও ব্রিটিশদের টেবিলে মানচিত্রের এ কাটাকুটিতে তৃণমূল মানুষের মতের প্রতিফলন ঘটেছিলো সামান্যই। তবে একটি অঞ্চলের মানুষ কিন্তু নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতেই পারেন। কেননা তারা নিজেরাই গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ পেয়েছিলেন পছন্দসই দেশটি বেছে নেবার। অঞ্চলটির নাম সিলেট। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে আসাম ত্যাগ করে তারা যোগ দিয়েছিলো পূর্ববঙ্গে।
ভারতের ইতিহাসচর্চায় দেশভাগ অধিকতর জীবন্ত স্বাভাবিক কারণেই। বাংলার কোটি বাঙালি আর পাঞ্জাবের কোটি পাঞ্জাবিদের অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে বাংলা ও পাঞ্জাবভাগের স্মৃতি। কিন্তু ঐ একই আবেগ নিয়ে সিলেটের আসাম থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে বলবার মত সিলেটি বা অহমিয়াই বা কোথায় ভারতে?
অন্যদিকে দেশভাগের সরাসরি ভুক্তভোগী ছিলো আজকের বাংলাদেশও। তবু একাত্তরের স্মৃতি রোমন্থনের একচ্ছত্রপনায় আমাদের দেশভাগের অনেক স্মৃতিতেই জমে গেছে বিস্মরণের ধুলো।
ফলে সীমান্তের দু’পারেই দুই প্রান্তেই ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি অনেকটাই অবহেলিত। যা-ই হোক, ‘৪৭ এর সেই ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে সিলেট কীভাবে বাংলাদেশের হলো, তা নিয়েই আজকের এই লেখা।
সিলেটের পূর্ব পরিচয়
ঐতিহাসিকভাবে পূর্ববঙ্গের সাথে সিলেটের যোগ থাকলেও ১৮৭৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ অহমিয়া ভাষীদের নিয়ে গঠিত আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিলেটকে। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশে অহমিয়া, বোড়ো আদিবাসী ছাড়াও বাঙালি, নাগা, মণিপুরীসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটেছে।
আসামে চা শিল্পসমৃদ্ধ সিলেট অঞ্চল অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল এক প্রদেশ গঠন। কিন্তু অব্যবহিত পরেই সিলেটি হিন্দুরা চেয়েছিলো তুলনামূলক ‘সমৃদ্ধ’ বাংলায় ফিরতে। ওদিকে সিলেটি মুসলিমরা ততদিনে আসামে বেশ সুদৃঢ় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নিশ্চিত করে। যার ফলে দেশভাগ অবধি দক্ষিণ-পশ্চিম আসামের অংশই থেকে যায় সিলেট।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ‘কল্যাণে’ পূর্ববঙ্গের সাথে আসাম মিলে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। কিন্তু ৬ বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ববঙ্গের সাথে আবার বিচ্ছেদ ঘটে সিলেটের, আবারও স্বতন্ত্র আসামের প্রাদেশিকতায় বিলীন হয় সিলেট।
ভারত হবে ভাগ, সিলেট যাবে কোথায়?
বাংলার গভর্নর ফ্রেডেরিক বুরোর চাওয়া, মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও জিন্নাহ’র সম্মতি সত্ত্বেও মূলত নেহরু ও কংগ্রেসের বাধার ফলে অখণ্ড বাংলার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনারও বেশ আগেই অখণ্ড ভারতের প্রায় সকল সম্ভাবনা ভেস্তে যায়।
এ দু’য়েরই অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ নেতাদের সাথে আলাপ শেষে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ভারতভাগ ও স্বাধীনতা প্রদানের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। ফলশ্রুতিতে পাঞ্জাবের মতো বাংলাকেও ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত হয়।
৩ জুনের সেই রূপরেখা অনুযায়ী, পাঞ্জাব ও বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যাবে পাকিস্তানে, বাকিটা ভারতে। অন্যদিকে আসামের পুরোটা যাবে ভারতে, কেবলমাত্র আসামের একটি জেলা সিলেটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে তার জনগণ।
আসামের গভর্নর জেনারেলের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৭ সালের ৩ জুলাই সিলেটে গণভোট আয়োজনের চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তাতে বলা হলো যে, ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে সিলেট আসামের সাথে থেকে গিয়ে ভারতের অংশ হবে, নাকি পূর্ববঙ্গের অংশ হয়ে পাকিস্তানভুক্ত হবে। সেই সাথে সিলেট যদি পাকিস্তানের অংশ হতে চায়, তবে কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমাসহ সিলেট-সন্নিহিত মুসলিম অঞ্চলগুলোও পূর্ববঙ্গের অধিভুক্ত হবে।
কেবল সিলেটই কেন পেলো গণভোটের সুযোগ?
বাঙালি, তামিল, সিন্ধি, পাঞ্জাবি নির্বিশেষে সকলেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দ্বৈরথের কাছে জিম্মি ছিলো। এ কারণে ভারত ভাগের সময় ভূ-সীমানা বা রাজনৈতিক পরিচয় বেছে নেবার ক্ষেত্রে আমজনতার মতকে ঐ অর্থে গোনায়ই ধরা হয়নি। তবে সিলেটের বাসিন্দারাই বা কেন পেয়েছিলেন নিজেদের ভৌগোলিক ভাগ্য নির্ধারণ করবার বিরল স্বাধিকার? উত্তরটি পেতে হলে তাকাতে হবে আসামের ইতিহাসের দিকে।
বর্তমান সময়েও আমরা আসামে বরাক বনাম ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বৈরিতা দেখতে পাই। বোড়ো আদিবাসীদের পৃথক বোড়োল্যান্ডের দাবির সাথে স্বাধীনতার পর থেকে এই আসামে চলে আসছে অহমিয়া জাত্যাভিমানী কর্তৃক ‘বাঙাল খেদা’র শোর।
জাতি সমস্যায় আদিকাল থেকেই পীড়িত আসাম ছিলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি প্রদেশ। অন্যদিকে আসামের সিলেট জেলা ছিলো বাঙালি ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘এক জাতি, এক ভাষা’- এ ধরনের সাংস্কৃতিক হেজেমনি ও স্বাজাত্যবাদী আসাম কায়েমের ব্যাপারে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু অহমিয়া নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলো। এ কারণে সিলেটকে সরিয়ে দিয়ে একাধিপত্যবাদ আরো শক্তিশালী করার ইচ্ছা ছিলো তাদের।
এমনকি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা মিশন পরিকল্পনার এক আলোচনায় ১৯৪৬ সালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলোই তো বলেই দেন, তারা সিলেটকে পূর্ববঙ্গের কাছে হস্তান্তর করতে চান।
ওদিকে সিলেটকে ধরে রাখবার ব্যাপারে আসামের এ ‘অনিচ্ছা’কে কাজে লাগিয়ে সিলেটকে পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের বাগে আনতে সেখানে তৎপরতা শুরু করে মুসলিম লীগ। এর অংশ হিসেবে ১৯৪৬ এর মার্চে সিলেটে সফর করেন জিন্নাহ। এসব কারণে সিলেটের ভৌগোলিকতা নির্ধারণে দ্বিধাগ্রস্থ ব্রিটিশরা সিলেটের জনগণের ইচ্ছার ওপরেই ছেড়ে দেন তাদের ভবিষ্যৎ।
অবশেষে নির্বাচন হলো চূড়ান্ত
৩ জুলাইয়ের ঘোষণার পর তড়িৎ সিদ্ধান্তে ৬ ও ৭ জুলাই ভোটগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। গণভোট পরিচালনার জন্য এইচ. সি স্টককে কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। ২৩৯টি কেন্দ্রের জন্য নিযুক্ত করা হয় ৪৭৮ জন প্রিজাইডিং অফিসার ও ১,৪৩৪ জন পোলিং অফিসার। পূর্ববঙ্গ তথা পাকিস্তানভুক্তির জন্য ভোটবাক্সের মার্কা নির্ধারিত হয় ‘কুড়াল’ ও আসামে থেকে যাবার জন্য ‘কুঁড়েঘর’। সমগ্র সিলেটে মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন।
নির্বাচনী প্রস্তুতি
এতকাল কংগ্রেসশাসিত প্রদেশাধীন থাকায় সিলেটের মুসলিমদের মধ্যে জমিয়তে উলামা পার্টিসহ একটা অংশ কংগ্রেস ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলো। এ কারণে মুসলিম লীগকেও বেশ জোরেশোরেই প্রচারণা চালাতে হয়েছিলো সেখানে। সরকারি ঘোষণার তিন দিনের মাথায় নির্বাচনের কারণে খুব বেশি সময় মুসলিম লীগ হাতে না পেলেও অল্প সময়েই বেশ সংগঠিত হয়ে পড়ে তারা।
‘কুড়াল’ মার্কার পক্ষে আবদুল মতিন চৌধুরীকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট আবদুল হাফিজকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি শক্তিশালী গণভোট পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, এই আবদুল হাফিজ হচ্ছেন বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাবা। ওদিকে মুসলিম লীগ মনোনীত মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কাজ করেছিলেন সিলেটি তফশীলি হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে।
কলকাতা থেকে পাঁচশ’র মতো কর্মী নিয়ে মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে সিলেটে এসেছিলেন তখনকার তরুণ নেতা ও সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এসব স্মৃতিচারণ বঙ্গবন্ধু করেছেন তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিতে। সোহরাওয়ার্দীর অপর ঘনিষ্ঠ ফজলুল কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরীর বাবা), নুরুল আমীন, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ নবীণ-প্রবীণ নেতাদের মিশেলে মুসলিম লীগ নির্বাচনী প্রচারণা দিয়েই যোজন যোজন এগিয়ে যায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে।
ভোটগ্রহণ ও ফলাফল
সিলেট জেলার উত্তর, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও দক্ষিণ (মৌলভীবাজার) মহকুমায় প্রায় ৭৭ ভাগ ভোটারের উপস্থিতিতে যথারীতি শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই হলো ভোটগ্রহণ। পাকিস্তানের পক্ষে কুড়াল মার্কায় এলো ২,৩৯,৬১৯ ভোট আর আসাম বা ভারতে থাকবার পক্ষে কুঁড়েঘরে এলো ১,৮৪,০৪১ ভোট। অর্থাৎ ৫৭ ভাগ ভোট নিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেওয়াই পেলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
আসামে প্রতিষ্ঠিত সিলেটি মুসলিমদের অনেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থক হওয়ায় ‘কুঁড়েঘরে’ ভোট দিলেও মুসলিম লীগের প্রচারণায় ‘যোগেন্দ্রনাথ’ ফাটকার সাফল্যে ২২ ভাগ হিন্দুর ভোট জয় করে নেয় ‘কুড়াল’। ফলাফল ১২ জুলাই দিল্লী পাঠানোর পর ১৮ জুলাই ভারত স্বাধীন আইনের তৃতীয় ধারায় গণভোট কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে ফলাফল কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিতর্কের নাম করিমগঞ্জ
ইতোপূর্বে ভারতে কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকা সিরিল জন র্যাডক্লিফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ধর্মীয় সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে ও কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দাবিসমূহের সামঞ্জস্যতা বিধান করে ভারত-পাকিস্তানের সীমানা নিরূপণের। ১২ আগস্ট সেই ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ প্রকাশিত হয়। র্যাডক্লিফ লাইনে আবার করিমগঞ্জকে ফেলা হয় ভারতের পরিসীমায়।
উল্লেখ্য, সিলেটের দক্ষিণ বা মৌলভীবাজার মহকুমায় নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও সিলেটের অংশ হিসেবে তা পূর্ববঙ্গের অঙ্গীভূত হয়। কিন্তু করিমগঞ্জ মহকুমায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেমন ছিলো, তেমনি ভোটগ্রহণেও পূর্ববঙ্গে যোগদানের পক্ষে জনরায় ছিলো। এতদসত্ত্বেও গণভোটের ফলাফল ও গণভোটের পূর্বপ্রতিশ্রুত ঘোষণাপত্রকে অবজ্ঞা করে করিমগঞ্জ মহকুমার চার থানা- করিমগঞ্জ, বদরপুর, পাথারকান্দি, রাতাবাড়ির মধ্যে তিনটির পুরোপুরি ও একটির অর্ধেক ভারতকে দিয়ে দেয় সীমানা কমিশন।
অর্থাৎ ভোটের রায়ে যেখানে গোটা সিলেট জিতে হাইলাকান্দিসহ সন্নিহিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পাবার কথা পূর্ববঙ্গ বা তৎকালীন পাকিস্তানের, সেখানে উল্টো ভারতের কাছেই করিমগঞ্জের প্রায় পুরোটা খোয়াতে হয়।
তবে করিমগঞ্জ ব্যতীত সিলেটের বাকি এলাকা সেই থেকে পূর্ববঙ্গের সাথে যুক্ত হলো এবং শাহজালালের পূণ্যভূমি ‘দু’টি পাতা, একটি কুঁড়ির’ অপরুপা সিলেটের গৌরবে গৌরবান্বিত হলাম আমরা। পূর্ববঙ্গে (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান) যোগদানের পর থেকেই চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে ছিলো সিলেট। একাত্তরে সিলেটের অঞ্চলগুলো ৩, ৪ ও ৫ নং সেক্টরে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয় সিলেট বিভাগ। ‘দেশি লন্ডন’ খ্যাত সিলেট এভাবেই আজ বাংলাদেশের।
ফিচার ইমেজ:policytransfer.metropolis.org