প্রাথমিকভাবে স্টুডিও সেট তৈরি করা হয়েছে। প্রাচীন রোমান সভ্যতার অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে বিশাল গ্ল্যাডিয়েটর স্কুল। হার্ডবোর্ডে তৈরি প্রাচীরের সামনে কয়েক বস্তা বালু ফেলে সেখানে অস্থায়ী যুদ্ধ ময়দান তৈরি করা হলো। কিছুক্ষণ পর পরিচালক নিজে এসে সবকিছু পরীক্ষা করে গেলেন। অনেক কিছুই তার পছন্দমতো না হওয়ায় ফের নতুন করে তৈরি করা হবে অধিকাংশ সেট। তার একটাই কথা, “স্টুডিও সেট দেখেই যেন অভিনেতারা নিজেদেরকে সত্যিকারের গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে ভাবতে শুরু করে। নায়কের গায়ের রক্ত এই সেটের দিকে তাকিয়ে এক অদম্য বিপ্লবী চেতনায় টগবগ করতে থাকবে।”
বেশ কয়েকবার ভাঙাগড়ার পরে পরিচালক সেট পছন্দ করলেন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবার পর এবার শুরু হলো আসল কাজ। বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর স্টুডিও সেট বেশ ভারিক্কি হলিউডি কায়দায় সজ্জিত হলো। একে একে সব অভিনেতা সেটের ভেতর প্রবেশ করলেন। সবার পরে ধীরগতিতে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছেন কালজয়ী অভিনেতা কার্ক ডগলাস। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের বেশে কার্ক ডগলাসকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি আর কার্ক নন, সাক্ষাত বিপ্লবী ক্রীতদাস স্পার্টাকাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এই চরিত্রের উপর তিনি তার সেরাটা দিতে আগ্রহী।
পরিচালকের সংকেত পাওয়ামাত্র অভিনয় শুরু হলো। ক্যামেরার রূপালী রিলে অঙ্কিত হতে থাকল ইতিহাসের অন্যতম বীর ক্রীতদাস স্পার্টাকাসের অবিস্মরণীয় সংগ্রামের গল্প। কার্ক ডগলাস ওরফে স্পার্টাকাসের অসাধারণ অভিনয়ে একটি চমৎকার সিনেমা তৈরি করতে সক্ষম হলেন পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিক। প্রায় ১৯৮ মিনিটের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষ পরিচিত হলো রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম বিদ্রোহী স্পার্টাকাসের সাথে।
বিভিন্ন সিনেমা এবং নাটকের বীর স্পার্টাকাসের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। তবে নাটক এবং সিনেমার গল্পের প্রয়োজনে সংলাপ নির্মাতাগণ নিজেদের মতো বদলে দিয়েছেন স্পার্টাকাসকে। ইতিহাসের পাতায় সুপ্ত রয়ে গেছে স্পার্টাকাসের বহু অজানা ইতিহাস। এ প্রবন্ধে রোমান ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে উঠে আসবে বাস্তবের বীর স্পার্টাকাসের জীবন।
স্পার্টাকাস পরিচিতি
ইতিহাসের পাতায় বীর হিসেবে আবির্ভূত স্পার্টাকাস ছিলেন মূলত একজন রোমান ক্রীতদাস। ইতিহাসের পাতায় তার শৈশব জীবন সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাই তার বিদ্রোহপূর্ব জীবনের অধিকাংশ তথ্যই অজানা। ইতিহাসবিদগণের মতে, স্পার্টাকাসের জন্ম রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত থ্রেস অঞ্চলের এক গ্রামে, আধুনিক মানচিত্রের বুকে যার অবস্থান বলকান অঞ্চলে। ধারণা করা হয়, তরুণ স্পার্টাকাস তার শক্তিশালী গড়নের কারণে রোমান সেনাবাহিনীতে চাকরি লাভ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অজানা কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল।
অনেকের মতে, তিনি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে ডাকাত দলের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তাই তাকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি রোমান সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। চাকরিচ্যুত স্পার্টাকাসের ঠাঁই মিললো দাস বিক্রির হাটে। খুব দ্রুত তিনি এক দিনমজুর ঠিকাদারের নিকট বিক্রি হয়ে যান। বেশ কয়েক বছর ক্রীতদাস হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করেন তিনি।
তৎকালীন রোমে শক্তিশালী ক্রীতদাসদের বাছাই করে বিভিন্ন যুদ্ধকৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ নামক যোদ্ধায় পরিণত করা হতো। এই গ্ল্যাডিয়েটরদের রোমের বিভিন্ন স্থানে মল্লযুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। সেই নৃশংস ক্রীড়ায় গ্ল্যাডিয়েটররা বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষায় অন্য গ্ল্যাডিয়েটরদের হত্যা করতো। খেলার শেষে একমাত্র জীবিত গ্ল্যাডিয়েটরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হতো। রোমের সভ্য নাগরিকগণ এই পাশবিকতাকে বিনোদন মাধ্যম হিসেবে উপভোগ করতেন। ভাগ্যক্রমে স্পার্টাকাসও একজন গ্ল্যাডিয়েটর দালালের নজরে পড়েন। এদের রোমানরা ‘ভাটিয়া‘ নামে ডাকতো। সেই ভাটিয়া স্পার্টাকাসকে ক্রয় করে ন্যাপলসের বিখ্যাত নেউস লেন্টুলুস গ্ল্যাডিয়েটর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে স্পার্টাকাস বনে গেলেন এক গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধা। ক্রীতদাসের শেকল থেকে মুক্ত স্পার্টাকাস জড়িয়ে পড়লেন রোমান পাশবিকতার ফাঁদে।
বিদ্রোহ করে বসলেন তিনি
গ্ল্যাডিয়েটর স্কুলের চার দেয়ালে বন্দি স্পার্টাকাস খুব দ্রুত হাঁপিয়ে উঠলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি বহু সৈনিককে হত্যা করেছেন, কিন্তু এই পাশবিক হত্যাযুদ্ধ তার কাছে সম্পূর্ণ অনৈতিক লাগলো। তার ভেতরে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে লাগলো। রোমানদের স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কোনো লাভ হবে না, এ কথা তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন। তৎকালীন বিভিন্ন সম্রাটরা শত চেষ্টা করেও রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেননি। তবে স্পার্টাকাস ভয় পেলেন না। তিনি অন্যান্য সহযোদ্ধাদের তার আক্রোশের ব্যাপারে অবহিত করলেন। প্রাথমিকভাবে কেউ সাড়া না দিলেও একদিন এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যোদ্ধাদের সাথে প্রশিক্ষকদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ঘটনা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। স্পার্টাকাস এই সুযোগে প্রায় ৭৮ জন গ্ল্যাডিয়েটরকে একতাবদ্ধ করে পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষকদের উপর হামলা করে বসেন। স্কুলের বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে স্পার্টাকাস তার দলবল নিয়ে ভিসুভিয়াস পর্বতের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যান।
বিখ্যাত দার্শনিক প্লুটার্কের মতে, স্পার্টাকাসের বিদ্রোহী গ্ল্যাডিয়েটররা অস্ত্র হিসেবে রান্নাঘরে ব্যবহৃত বিভিন্ন লোহার সরঞ্জামকে বেছে নিয়েছিলো। কিন্তু পথিমধ্যে তারা গ্ল্যাডিয়েটরদের অস্ত্র বোঝাই একটি গাড়ি আবিষ্কার করে। বুদ্ধিমান স্পার্টাকাস সেই অস্ত্র লুট করেন। এর ফলে বিদ্রোহীদের নিয়ে ছোটখাট সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন তিনি। স্পার্টাকাস নিজে একজন রোমান সেনা ছিলেন। তাই সেনাবাহিনীর আক্রমণের ধরন সম্পর্কে তিনি সম্যক ধারণা রাখতেন। এই পুরো ঘটনার সময়কাল ছিল ৭৩ খ্রিস্টপূর্ব।
স্পার্টাকাসের তত্ত্বাবধানে ভিসুভিয়াসের পাদদেশে ক্রীতদাসদের সামরিক প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ততদিনে সমগ্র রোমে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে ক্রীতদাস এবং গ্ল্যাডিয়েটররা গোপনে পালিয়ে এসে সেই দলে যোগ দিতে থাকে। দল ভারী হওয়ার পর স্পার্টাকাস তিনজন গ্ল্যাডিয়েটরকে নেতা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। স্পার্টাকাসের সাথে তার স্ত্রীও পলায়ন করেছিলো। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার নাম সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য লাভ করা যায়নি। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, স্পার্টাকাসের স্ত্রী একজন থ্রেসীয় ক্রীতদাসী ছিলো। প্রাচীন পুরোহিতদের ন্যায় সে বিভিন্ন লক্ষণ বিচার করে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতো। প্লুটার্ক তার পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ করেন,
“স্পার্টাকাসের স্ত্রী দেবী ডিওনিসাসের পূজা করতো। এর ফলে তার মাঝে কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতার লক্ষণ দেখা দেয়। একদিন স্পার্টাকাস ঘুম থেকে জেগে আবিষ্কার করেন, তার গলায় একটি সাপ পেঁচিয়ে রয়েছে। এই দৃশ্য দেখে তার স্ত্রী ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, এই সাপ স্পার্টাকাসের ধ্বংসের প্রতীক। এই বিদ্রোহে তার করুণ পরিণতি হবে।”
স্পার্টাকাস বধে রোমানদের ব্যর্থতা
স্পার্টাকাস এবং দাস বিদ্রোহীদের পলায়নের খবর রোমান সিনেটের কাছে পৌঁছে গেলো। কিন্তু তারা দাসদেরকে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে নারাজ ছিলেন। গুরুগম্ভীর রোমান সিনেটের নিকট তারা হাসির পাত্রে পরিণত হয়। ওদিকে স্পার্টাকাসের বাহিনী ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী কোহর্টের সমতুল্য হয়ে উঠলো। ঠিক সেই সময় রোমের বিখ্যাত সেনারা দুটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো। তাই রোমে অবস্থানরত সেনাসদস্যের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল। তবে সিনেটের বিশ্বাস ছিল রোমের সাধারণ যোদ্ধারাই পারবে স্পার্টাকাসকে বধ করতে। তারা গাইয়াস ক্লডিয়াস গ্লেবার নামক এক সেনাধ্যক্ষের অধীনে প্রায় তিন হাজার বৃদ্ধ এবং অপ্রশিক্ষিত সৈনিকের একটি দল প্রেরণ করে।
প্রাথমিক আক্রমণের ধাক্কায় নব্য প্রশিক্ষিত গ্ল্যাডিয়েটর এবং দাস বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। খণ্ড খণ্ড আক্রমণে বার বার পরাস্ত হতে থাকে দাসরা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্লেবার দাসদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কোণঠাসা করতে থাকেন। কিন্তু স্পার্টাকাস মনোবল হারালেন না। দিনের শেষে যুদ্ধ বিরতি পড়লো। স্পার্টাকাস এই সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। রাতের আঁধারে গোপনে আক্রমণ করে বসেন ঘুমন্ত সৈনিকদের ব্যারাকে। অতর্কিত হামলায় রোমান সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ওদিকে দাসরা ভিসুভিয়াসের বিভিন্ন গোপন স্থান থেকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করে রোমানদের ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্লেবার কিছু সৈনিকসহ প্রাণের ভয়ে পলায়ন করে। স্পার্টাকাস এবং তার বাহিনী রোমানদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র লুট করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। গ্লেবার রোমে ফিরে গিয়ে অন্যান্য সিনেটরদের স্পার্টাকাসের শক্তিবলের কথা জানান। কিন্তু সিনেটররা তার কথা বিশ্বাস করলো না। সিনেটে অনেকেই তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যা দেয়। রোম স্পার্টাকাস দমনের উদ্দেশ্যে এবার পাঠালেন সেনাধ্যক্ষ পাবলিয়াস ভ্যারিনিয়াসকে।
ভ্যারিনিয়াস একটু বোকা ছিলেন। তিনি এক অজানা কারণে নিজের দলকে দু’ভাগে ভাগ করলেন। স্পার্টাকাস পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলেন তার দলবল নিয়ে। ভ্যারিনিয়াস বাহিনী দাসদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। স্পার্টাকাস ছেলেখেলার মতো ভ্যারিনিয়াসকে এক ধাক্কায় ঘোড়া থেকে ফেলে অপমান করেন। তারপর স্পার্টাকাস বেশ কয়েকটি রোমান অধ্যুষিত অঞ্চল (নোরা, নুসেরিয়া, থুরি এবং মেটাপন্টিয়াম) আক্রমণ করে সিনেটরদের বাসস্থান ধ্বংস করে দেন। এসময়ে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস এবং রাখালরা স্পার্টাকাসের বাহিনীতে যোগ দেয়। এই জয়ের মাধ্যমে স্পার্টাকাসের বাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনীর সংযোজন হয়। ৭২ খ্রিস্টপূর্বের শেষে স্পার্টাকাসের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজারের কোঠায় গিয়ে ঠেকলো।
রোমানদের টনক নড়লো
রোমানদের অট্টহাসি এবং পরিহাস ধীরে ধীরে গুপ্ত আতঙ্কে পরিণত হলো। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন পুরো রোম স্পার্টাকাসের কব্জায় চলে আসবে। কিন্তু রোমান সিনেট এই পরিণতি রুখে দিতে সোচ্চার হলো। এবার সিনেটররা বেশ শক্তিশালী ফৌজ গঠন করলো। সেনাবাহিনীর সেরা যোদ্ধাদের সমন্বয়ে তৈরি হলো প্রায় বিশ হাজার সদস্যের এই ফৌজ। এবার এই ফৌজকে দু’ভাগ করে রোমান কন্সাল লুসিয়াস গেলিয়াস পাবলিকোলা এবং নেয়াস কর্নেলিয়াস ক্লডিয়ানাসের অধীনে ভিসুভিয়াসের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হলো।
তখন স্পার্টাকাস তার সহ-অধিনায়ক ক্রিক্সাসের সাথে পুরো বাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতমালা অভিমুখে সফররত ছিলেন। পথিমধ্যে তারা গেলিয়াস বাহিনীর সাথে মুখোমুখি হয়। কন্সাল গেলিয়াসের সুসজ্জিত বাহিনী দুদিক থেকে স্পার্টাকাসদের ঘিরে ধরে। যুদ্ধে ক্রিক্সাস মৃত্যুবরণ করলে স্পার্টাকাস কিছুটা ভয় পেয়ে যান। দক্ষিণ দিক থেকে গেলিয়াস বাহিনী স্পার্টাকাসদের পিছু হটাতে থাকে। কিন্তু বিধিবাম! পেছনে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ, উল্টো দিক থেকে ঘিরে রেখেছে লুসিয়াস। স্পার্টাকাস শেষ সম্বল হিসেবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। তার নির্দেশে দাসদের অশ্বারোহী বাহিনী পুরোদমে আক্রমণ শুরু করে। ইতিহাসের পাতায় থ্রেসীয়রা অশ্বারোহী হিসেবে সুপরিচিত। তাই তাদের অশ্বারোহীদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়লো রোমান প্রতিরোধ।
অশ্বারোহীদের পেছনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো পদাতিক বাহিনী। প্লুটার্কের পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী, “স্পার্টাকাস হঠাৎ করে অশ্বারোহীদের আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে রোমান বাহিনী পরাজয় বরণ করে নিলো। আর বিজেতা স্পার্টাকাস রোমানদের রসদ লুট করে নিলেন।” গেলিয়াস যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। বিজয়ী দল নিয়ে স্পার্টাকাস আল্পসের পানে যাত্রা শুরু করেন।
রহস্যময় স্পার্টাকাস এবং বিশ্বাসঘাতক জলদস্যু
একের পর এক রোমান সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দাসদের আত্মবিশ্বাস প্রবল হয়ে উঠলো। তাদের সামনে আর কোনো বাধা রইলো না। স্পার্টাকাসের পরিকল্পনা ছিল আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে গাউল প্রদেশে প্রত্যাবর্তন করা। গাউল প্রদেশ রোমান সাম্রাজ্যের বহির্ভূত হওয়ায় দাসরা সেখানে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু এই সহজ পরিকল্পনা কেন যেন স্পার্টাকাস বাহিনীর মনঃপুত হলো না। এক অজানা কারণে পুরো বাহিনী নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করে পুনরায় রোমে ফেরত আসলো।
ইতিহাসবিদদের নিকট আজ পর্যন্ত এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ অজ্ঞাত রয়েছে। নেতা স্পার্টাকাসের এই অদ্ভুত আচরণ সত্যিই রহস্যজনক ছিল। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেরি স্ট্রাউসের মতে, “স্পার্টাকাসের রোম পুনঃপ্রত্যাবর্তন নিয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব প্রদান করে হয়েছে। কিন্তু এর মাঝে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলো, স্পার্টাকাসের সহযোদ্ধারা গাউল যেতে রাজি ছিল না।” অনেকেই ধারণা করেন, দাসদের প্রবল আত্মবিশ্বাসের কারণে তারা পালিয়ে যেতে চায়নি। এমনকি রোমে ফিরে আসার সময় তারা বিভিন্ন রোমান প্রদেশে আক্রমণ করে এবং বিজয়ী হয়। স্পার্টাকাস এবার নতুন পরিকল্পনা করলেন। তিনি পুরো বাহিনী নিয়ে মেসিনা প্রণালী অঞ্চলে অবস্থান করলেন। সেখান থেকে জলপথ পাড়ি দিয়ে শ্যামল দ্বীপ সিসিলিতে দাসদের স্বপ্নভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। কিন্তু স্পার্টাকাসের এজন্য প্রয়োজন বেশ কিছু জাহাজ। জাহাজ পরিচালনার সুদক্ষ নাবিকেরও প্রয়োজন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে এতকিছু যোগাড় করা এককথায় দুঃসাধ্য।
স্পার্টাকাস এবার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি সিসিলির জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগ করলেন। লুট করা বিভিন্ন মূল্যবান অলংকার এবং মোহরের বিনিময়ে বেশ কিছু জাহাজ এবং নাবিক ক্রয় করলেন। জলদস্যুরা অল্প সময়ের মধ্যে স্পার্টাকাসকে জাহাজ এবং নাবিক প্রস্তুত করে দিবে বলে কথা দেয়। কিন্তু এক অজানা কারণে জলদস্যুরা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। এর ফলে বিপদে পড়ে যায় স্পার্টাকাস। রোমান সাম্রাজ্যের আবদ্ধ ভূমিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দাসদের ঐতিহাসিক বাহিনী।
ক্রেসাসের অভিযান
স্পার্টাকাস সিসিলি প্রত্যাবর্তন ব্যর্থ হওয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় পেছন দিক থেকে ধাবমান হাজার হাজার রোমান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ওদিকে রোমান সেনা নেতৃত্বে আবির্ভাব ঘটলো নতুন নেতা মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রেসাসের। স্পার্টাকাসের পরবর্তী প্রতিপক্ষ এই ক্রেসাস রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর সেনাপ্রধান হিসেবে পরিচিত। তিনি স্পার্টাকাসকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। এর পূর্বে স্পার্টাকাস তার অধীনস্ত দুই লিজিয়নকে পরাজিত করেছিলেন। সরাসরি নেতৃত্ব না দিলেও ক্রেসাস এই পরাজয়ে অপমানিত বোধ করেছিলেন। তাই তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উন্মুখ ছিলেন। শাস্তি হিসেবে নিজের পরাজিত দুই সেনাধ্যক্ষকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান ছাড়াও লিজিয়নের প্রতি দশজনের একজনকে জনসম্মুখে হত্যা করেছিলেন তিনি।
স্পার্টাকাস যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি জানতেন ক্রেসাস তার সবচেয়ে সেরা বাহিনী নিয়ে তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তাই তিনি প্রথমেই ক্রেসাসকে শান্তি চুক্তির আহ্বান করেন। কিন্তু ক্রেসাস জানতেন তিনি দাসদের থেকে শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে এসেছেন। তাই তিনি এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। উল্টো স্পার্টাকাস বাহিনীর সীমান্তের চারদিকে দেয়াল নির্মাণের নির্দেশ দেন। স্পার্টাকাস তাৎক্ষণিকভাবে সুড়ঙ্গের সাহায্যে পলায়ন করার চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে হাজার হাজার দাস সৈনিক পেছনে পড়ে যায়। এর ফলে স্পার্টাকাসের বাহিনী শক্তিতে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। দিনশেষে হতাশ স্পার্টাকাস গোধূলির রক্তাক্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। কিন্তু তিনি অশনি সংকেত ব্যতীত আর কিছুই ধরতে পারেন না। ওদিকে ক্রেসাস তৃপ্তির হাসি হেসে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
স্পার্টাকাস সমাপ্তি
স্পার্টাকাসের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি আর পালাতে রাজি হলেন না। যেহেতু তার রোম ত্যাগ করার কোনো পথ খোলা নেই, তাই তিনি ক্রেসাসের মুখোমুখি হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রায় ত্রিশ হাজার সৈনিক নিয়ে তিনি ক্রেসাসকে আক্রমণ করে বসেন। ক্যালেণ্ডারের হিসেবে সময় তখন ৭১ খ্রিস্টপূর্ব। স্পার্টাকাস দুই ধাপে আক্রমণ করার পরিকল্পনা দিলেন। প্রথম ধাপে অশ্বারোহীরা ক্রেসাসের তীরন্দাজদের আক্রমণ করবে। দ্বিতীয় ধাপে স্পার্টাকাস পদাতিক বাহিনী নিয়ে সরাসরি ক্রেসাসকে হত্যা করার চেষ্টা করবে। যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পার্টাকাস এবং ক্রেসাস। স্পার্টাকাস যুদ্ধের পূর্বে নিজের ঘোড়া থেকে অবতরণ করে সেটিকে নিজের বর্শা দিয়ে আঘাত করেন। এরপর মৃত ঘোড়ার দিকে নির্দেশ করে ঘোষণা দেন,
“আজ যদি আমরা জিতে যাই, তাহলে শত্রুপক্ষের বহু ঘোড়া আমাদের দখলে থাকবে। আর যদি আজকে পরাজিত হই, তাহলে এই ঘোড়ার কোনো মূল্যই আমার কাছে থাকবে না।”
কিন্তু যে উদ্যমে দাসরা যুদ্ধ শুরু করেছিলো, অচিরেই সেই উদ্যম হারিয়ে আহত সৈনিকদের আর্তনাদে পরিণত হলো। অশ্বারোহী বাহিনী তীরন্দাজদের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। ওদিকে স্পার্টাকাসের পদাতিক বাহিনী লিজিয়নদের মুহুর্মুহু আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়লো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্পার্টাকাস বাহিনী পরাজিত হলো। যুদ্ধে স্পার্টাকাস প্রাণ হারালেন। ঠিক কীভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অধিকাংশের মতে, তাকে শত্রুরা চারপাশ থেকে ঘিরে বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছিলো। অন্যান্য দাসদের রোমান আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম সাহসী সংগ্রামের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতিহাসবিদগণ স্পার্টাকাসের শেষ যুদ্ধকে ‘তৃতীয় সারভিল যুদ্ধ’ কিংবা ‘গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ’ নামে চিহ্নিত করেছেন।
স্পার্টাকাস পরাজিত হয়েছেন। একদিন যে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে গ্ল্যাডিয়েটর স্কুল থেকে পালিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবার পূর্বেই পতন ঘটে তার। কিন্তু তাকে কখনই ব্যর্থ বলা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসপ্রেমীদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তারা কয়জন ক্রেসাসকে চেনে? হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো তাকে চিনতে পারবে। কিন্তু স্পার্টাকাসকে প্রায় সবাই চেনে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, স্পার্টাকাস ব্যর্থ ছিলেন না। এরূপ হাজারো স্পার্টাকাসের সংগ্রামের ফলে একদিন পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে রোমান সাম্রাজ্য। ইতিহাস তাদের কখনো ভুলবে না।
ফিচার ইমেজ: History Monk