দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিশরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে বেশ জোরেসোরে৷ এর পেছনে আমেরিকারও ভূমিকা ছিল৷ ১৯৫৩ সালের দিকেও সুয়েজ খালের পাশে ব্রিটিশ সেনারা ঘাঁটি গেড়েই অবস্থান করছিল৷ কিন্তু দেশটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফল হিসেবে মনে হচ্ছিল একসময় ব্রিটিশরা দেশত্যাগে বাধ্য হবে, যেটি ইসরায়েলের জন্য স্বস্তির ব্যাপার ছিল না। ইসরায়েলের অনুমান ছিল যে ব্রিটিশরা মিশর থেকে চলে গেলে হয়তো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে মিশর৷ সেজন্য আমেরিকা যখন মিশরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পালে হাওয়া দিচ্ছিল, তখন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করতে থাকে আমেরিকাকে সেই নীতি থেকে সরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। এবার তারা ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়।
তখনও মিশরে আমেরিকা ও ব্রিটেনের অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ভবন ছিল। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা চেয়েছিল তারা অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও আমেরিকান স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তারা এসব আক্রমণের দ্বারা এমন একটি আবহ তৈরি করতে চেয়েছিল, যেটি আমেরিকা ও ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ভীতি তৈরি করবে। ফলে একপর্যায়ে তারা তাদের নীতি থেকে সরে আসবে, ব্রিটেনের সেনাবাহিনী মিশরেই অবস্থান করতে থাকবে। ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন বিদেশি স্থাপনায় বোমাবর্ষণ ও অন্যান্য হামলা পরিচালনা করে সেগুলোর দোষ মিশরের সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের কাঁধে চাপানো। এতে পশ্চিমাদের মনে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি আত্মবিশ্বাসহীনতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ১৯৫৪ সালে কর্নেল বিনিয়ামিন গিবলি, যিনি সেই সময়ের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আমান’ এর প্রধান ছিলেন, তিনি এর বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এই অভিযান পরিচালনার জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দারা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেন। বেশ কয়েক বছর আগেই ‘জন ডারলিং’ নামধারী ব্রিটিশ নাগরিকের ছদ্মবেশে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা আব্রাহাম দার মিশরে আগমন করেছিলেন। তিনি ‘ইউনিট-১৩১’ নামের একটি দল গঠন করেন। এই দলের সদস্যরা জাতিতে ছিল মিশরীয় ইহুদি। তারা ইসরায়েলের স্বার্থে তাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক অভিযানে সম্মতি প্রদান করেন। এই মিশরীয় ইহুদি ব্যক্তিরা এর আগে আরও বেশ কিছু গোপন অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছিল। ফলে অভিজ্ঞতা একেবারেই শূন্য ছিল না তাদের৷ তবে ইউনিট-১৩১ এর নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়।
১৯৫৪ সালের জুলাই মাসে অপারেশন শুরু হয়। মিশরীয় ইহুদিদের দ্বারাই এই অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়৷ কারণ যদি ইসরায়েলের গুপ্তচররা এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে কোনোভাবে মিশরীয়দের হাতে ধরা পড়ত, তাহলে মিশরে ইসরায়েলবিদ্বেষ চরমে রূপ নিতো।
প্রথমে আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি পোস্ট অফিসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর দুই সপ্তাহ পরে আলেকজান্দ্রিয়া ও কায়রোর আরও বেশ কয়েকটি স্থাপনায় বোমা হামলা চালানো হয়। একটি স্থাপনার মালিকানা ছিল একজন ব্রিটিশ ব্যক্তির হাতে। এই অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা বেছে বেছে সেসব স্থাপনায় বোমা হামলা চালাচ্ছিল যেগুলোতে হামলা হলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হতে পারে। একটি লাইব্রেরিতে গোপনে বইয়ের ভেতরে বোমা ভরে তাকে রাখা হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা পরে সেই লাইব্রেরিতে বোমা বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু কেউই সেই বোমা বিস্ফোরণে হতাহত হননি। সবগুলো বোমা বিস্ফোরণের একটিতেও মিশরীয় বা বিদেশি কেউ হতাহতের শিকার হয়েছে, এরকমটা শোনা যায়নি।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই অভিযান প্রত্যক্ষ করার জন্য আব্রাহাম সেইডেনবার্গ নামের এক ব্যক্তিকে ছদ্মবেশে পাঠানো হয়। ধারণা করা হয়, তার মাধ্যমেই মিশরীয়রা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিল৷ রিও থিয়েটারে বোমা হামলায় সময় দেখা গিয়েছিল আগে থেকেই মিশরের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। অর্থাৎ মিশরীয়রা প্রস্তুত হয়েই ছিল এই আক্রমণের জন্য। আক্রমণের আগেই ত্রুটির ফলে হামলার মূল ব্যক্তি ফিলিপ ন্যাটানসনের পকেটে বোমা আংশিক বিস্ফোরিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। মিশরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত তার বাড়িতে অনুসন্ধান চালায় এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে পায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এই গোপন অন্তর্ঘাতমূলক অভিযানের বাকি সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর শুরু হয় বিচার।
১৯৫৪ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচার চলে। মোশে মারজৌক ও স্যামুয়েল আজার– এই দুজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। বাকি অভিযুক্তদের মাঝে দুজনকে মুক্তি দেয়া হলেও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। ইসরায়েল জনসমক্ষে এই অভিযানের কথা প্রকাশ না করলেও কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করেছিল যাতে শাস্তিপ্রাপ্তদের শাস্তি কমিয়ে আনা হয়। তারা এই বিচারকে ‘সাজানো বিচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং ওয়ার্ল্ড জ্যুইশ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মরিস অরবাখ নামের একজন ব্যক্তি মিশরের নেতা নাসেরকে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা না হয়।
প্রেসিডেন্ট নাসের বিভিন্ন স্থান থেকে চাপ আসার পরও মৃত্যুদন্ড কার্যকর রাখেন এবং শেষপর্যন্ত তাদেরকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। তবে আব্রাহাম সেইডেনবার্গ ও জন ডারলিংয়ের ছদ্মবেশে আব্রাহাম দার ধরা পড়ার পূর্বেই মিশর থেকে পালাতে সক্ষম হয়।
এই অভিযানটি ছিল ‘ব্যর্থ’। কারণ একে তো হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী মিশরীয় ইহুদিরা ধরা পড়ে গুরুতর শাস্তির সম্মুখীন হয়। অপরদিকে ইসরায়েলিরা যে লক্ষ্য নিয়ে এই হামলা পরিচালনা করেছিল, সেটাও ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ সেনারা অল্প কিছুদিন পরেই সুয়েজ খাল থেকে চলে যায়। ইসরায়েলেও এই ঘটনার প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিনহাস ল্যাভন এই ঘটনার কারণে পদত্যাগ করেন। এজন্য এই ঘটনাকে ‘ল্যাভন অ্যাফেয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।