গুপ্তচর শব্দটির সমাস করলে হয় গুপ্ত যে চর; অর্থাৎ- যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে। প্রাচীন গ্রিস ও রোম এবং ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠীর রাজ্য পরিচালনার কাজে এই চরদের সাহায্য নেওয়ার অনেক নজির পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বলুন, সান জু-র দ্য আর্ট অব ওয়ার অথবা বেদব্যাসের মহাভারত- সবখানেই চর বা গুপ্তচর শব্দটির উল্লেখ বারবার এসেছে। অর্থশাস্ত্রে এভাবে বলা হয়েছে-
রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজাকে গুপ্তচর বা গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্য নিতে হবে।
শক্তিশালী প্রতিবেশীকে প্রতিহত করতে দুর্বল রাজ্য সর্বদা ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যার তথ্য যোগাবে অনুগত চরগণ।
৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সান জু রচিত দ্য আর্ট অব ওয়ার যুদ্ধকলার উপরে একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এত বছর পরেও বইটির জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৩ অধ্যায়ের বইটির সর্বশেষ অধ্যায়ে গুপ্তচর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অধ্যায়টির নাম গুপ্তচর নিয়োগ। এখানে সান জু পাঁচ প্রকারের গুপ্তচর নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই পাঁচ ধরনের চর যখন একত্রে কাজ করবে, সান জু তাদের বলেন মহান রেশমের গুটি।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রত্যেকটি দেশেরই গোয়েন্দা বিভাগ বা সংস্থা রয়েছে।
আমেরিকার আছে সিআইএ, রাশিয়ার কেজিবি, ব্রিটিশদের এমআই-৬, ইসরাইলের মোসাদ, ভারতের র, পাকিস্তানের আইএসআই, ফ্রান্সের ডিজিএসই, অস্ট্রেলিয়ার এএসআইএস ইত্যাদি। সিআইএ এবং মোসাদকে বলা হয় সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা। এদের অনেক গোপন মিশনের ব্যাপারে পৃথিবীবাসী এখন ওয়াকিবহাল।
সিআইএ ছাড়া আর যে সংস্থাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি তাদের গোপন তৎপরতা চালিয়েছে, সেটি ‘র’। পুরো নাম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাংলাদেশের অনেক অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ‘র’ এর সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়।
‘র’ এর গঠন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়
ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরপরই ‘র’ গঠন করা হয়নি। ভারতে ইন্টেলিজেন্ট কার্যক্রমের সূচনা হয় মূলত ১৯৩৩ সালে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আদিবাসীদের সাথে যুদ্ধবিগ্রহ এবং সীমান্তের ওপারে রাশিয়া ও জাপানের উপর নজরদারির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর একটি ইউনিটকে ভারতে সক্রিয় করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই এজেন্টরা ব্রিটিশদের পক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি সংগ্রহ করে। এগুলো ছাড়াও স্থানীয় রাজা-মহারাজাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক তথ্য জোগাড় করা হতো, যেগুলো ব্যবহার করে তাদের হুমকি দেওয়া হতো। এভাবে মহারাজাদের ব্রিটিশরা চাপে রাখত।
যখন ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন সিমলায় যেটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী, সেখানে গোয়েন্দা বিভাগের সব নথিপত্র ধ্বংসের এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়। টানা তিনদিন ধরে সেগুলো পোড়ানো হয়। মুছে ফেলা হয় সব প্রমাণ। এর সাথে সাথে হারিয়ে যায় ইংরেজ সরকারের অনুগত দালাল ও এজেন্টদের তাবৎ তথ্যও। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর নতুন দেশ পাকিস্তানে মুসলমানরা যাওয়া শুরু করে। অনেক মুসলিম ব্রিটিশ-ভারতীয় এজেন্টও এসময় পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ।
তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় এজেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও চৌকস। গোলাম মোহাম্মদের চলে যাওয়ার পর সঞ্জীব পিল্লাইকে আইবি-র (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) পরিচালক নিয়োগ করা হয়। তিনি এমআই-৬ এর আদলে আইবি-কে ঢেলে সাজানো শুরু করেন। দেশভাগের দু’বছর পর পিল্লাই পাকিস্তান, জার্মান ও ফ্রান্সের দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি পদ সৃষ্টির জন্য দেন-দরবার করেন। পিল্লাইয়ের সাথে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আর এন ব্যানার্জির সুসম্পর্ক ছিল না। এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় ইন্দো-চীন যুদ্ধ। ১৯৬২ সালের এ যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের পর সবাই প্রবলভাবে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার অভাব বোধ করে। পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৬৫-তে। এবার পাকিস্তানের সাথে।
আইয়ুব খানের যুদ্ধনীতির সাথে ভারতীয় সেনারা ঠিক পেরে উঠতে পারে না। চীন সীমান্তেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। নাথুলায় চীন সেনা মোতায়েন করে। পুরো বিশ্ব এই যুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠে। ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আইবির দুর্বল বৈদেশিক ডেস্ক দিয়ে যুদ্ধ জেতা সম্ভব না।
“প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সহজলভ্য নয়”
‘৬৫-এর যুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন সেনাপ্রধানের একটি মন্তব্য আগুনে ঘি ঢালার ন্যায় কাজ করে। ভদ্রলোক স্বয়ং বলে বসেন,“প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সহজলভ্য নয়”। এ বক্তব্য পুরো প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। তার মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে দুই সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী সরকার প্রতিরক্ষা সচিব পি ভি আর রাও এবং স্বরাষ্ট্র সচিব এল পি সিংয়ের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করেন।
কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়, আইবির সফলতা ও ব্যর্থতার আলোকে নতুন সংস্থা গঠনের ও পরিচালনার একটি রিপোর্ট পেশ করতে। আইবির পাশাপাশি পৃথক একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত যখন বাস্তব রূপ লাভ করে, তখন স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একে অপরের ওপর দায় চাপানো শুরু করে। সংস্থাটি কার অধীনে থাকবে, এ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
কমিশন শঙ্কর নায়ারকে তলব করে নিয়ে আসে। তিনি ছিলেন আইবির পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ। তাকে ৬০টির অধিক গোয়েন্দা রিপোর্ট সঠিকভাবে সংকলন ও সন্নিবেশ করতে বলা হয়। কমিশন এক পর্যায়ে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে বলা হয়,
“আনীত অভিযোগগুলো ব্যাপক অর্থে সঠিক নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের কাজ ঠিকমতো করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো- ‘গোয়েন্দা তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না’।”
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সামনাসামনি প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে অপরকে দোষারোপ করলেও গোপনে দু’পক্ষই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তদবির চালাচ্ছিল, যাতে নবগঠিত সংস্থাকে তার অধীনে রাখা হয়।
কার অধীনে থাকবে ‘র’?
নতুন গোয়েন্দা সংস্থার গঠন যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন বারবার আলোচনায় আসে- সংস্থাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে নাকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। প্রাথমিক পর্যায়ে একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেনাবাহিনীর আওতায় পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই লক্ষ্যকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জেনারেল চৌধুরী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবনের তত্ত্বাবধানে ব্রিগেডিয়ার এম এন ভদ্রের পেশকৃত একটি রিপোর্টের পর্যালোচনা করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়।
এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে মন কষাকষি আরো চরমে পৌঁছায়। দুই মন্ত্রণালয়ই নিজেদের নতুন সংস্থার দাবিদার বলতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নবগঠিত সংস্থা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে।
সংসদকেও এটি জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নবগঠিত বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার স্থপতি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার মুখ্যসচিব পি এন হাকসার। তারা উভয়েই উদ্ভূত পরিস্থিতির জটিলতা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। নবগঠিত গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে জনগণের মাঝেও কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে একে ‘ইন্দিরা গান্ধীর গোপন পুলিশ বহর’ বলে প্রচার করতে থাকেন।
নামটি কে দিয়েছিল?
বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর আসে নাম খোঁজার পালা। ধারণা করা হয়, ক্যাবিনেট সচিবের দেওয়া নামের তালিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘র’ নামটি পছন্দ করেন।
শুরুতে এর নাম ছিল R&AW। পরে সাংবাদিকরা একে RAW বলে প্রচার করতে থাকে। ‘র’ এর শ্লোগান করা হয়- ধর্ম রক্ষতি রক্ষিত। এর অর্থ, ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্মও রক্ষা করে।
নায়ার ও কাও এর ভূমিকা
শঙ্কর নায়ারের নাম পূর্বে একবার উচ্চারিত হয়েছে। ‘র’ এর ইতিহাস লেখতে গেলে নায়ারের পাশাপাশি যার নাম নিতেই হবে, তিনি হলেন আর এন কাও; পুরো নাম রামেশ্বর নাথ কাও।
দুজনেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুলিশ সার্ভিস ইম্পেরিয়াল পুলিশ (আইপি) থেকে এসেছিলেন। দু’জনেই ছিলেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কাও নেহেরুর সময় ষাটের দশকের মাঝামাঝি মাঠ পর্যায়ে কাজ করছিলেন। তিনি নিজের গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য ঊর্ধ্বতন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন।
নেহেরুর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন তৎকালীন সদ্যস্বাধীন ঘানার প্রেসিডেন্ট কওমি নক্রুমা। নক্রুমা নেহেরুকে অনুরোধ করেন, তার দেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার জন্য। নেহেরু এ ব্যাপারে কাও ও নায়ারকে ঘানায় পাঠান। সেখানে তারা আট বছর অবস্থান করে ‘ঘানা গুপ্তচর সংস্থা’ গঠন করে একে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে তোলেন। তারপর তাদের মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়ের আওতায় নবগঠিত গোয়েন্দা সংস্থায় নিয়োগ করা হয়।
১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘র’ গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে। কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই শংকর নায়ার ও রামেশ্বর নাথ কাওয়ের অধীনে ২৫০ জন লোক ‘র’ এ নিয়োগ পায়, যারা সবাই আইবিতে ছিল। কাও-কে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দিল্লির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের উত্তর ব্লকে ‘র’ তার কার্যক্রম শুরু করে। দক্ষিণ ব্লকের স্পেশাল উইংয়ে কাও তার নিজের অফিস স্থাপন করেন। কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে কিছু সংস্কার করা হয়। ‘র’ এর জন্য আলাদা একটি ক্যাডার চালু করারও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ইতোপূর্বে ‘রাও ও সিং কমিশন’ এর দেওয়া রিপোর্টে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে যে সমন্বয়হীনতার কথা বলা হয়েছিল, নায়ার তার সুষ্ঠু সমাধান দেন।
পূর্বের চিন্তাধারা থেকে সরে এসে ‘র’-এ লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আইবি থেকে র-এ নিয়োগ বন্ধ করা হয়। এটি প্রচণ্ড রেষারেষির জন্ম দেয়। ‘র’ প্রাথমিক অবস্থায় দুটো সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। একটি হলো ব্রিগেডিয়ার ভদ্র পরিচালিত সেনা গোয়েন্দা অধিদপ্তর এবং অন্যটি হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরিরত বৈদেশিক সার্ভিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। এতসব প্রতিকূলতা ও বাধাকে অতিক্রম করে নায়ার ও কাও র-কে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত করতে সক্ষম হন।
বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন-
১) ইনসাইড র, মূল : অশোক রায়না, অনুবাদ : আবু রূশদ, চতুর্থ সংস্করণ – ২০১৪, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পাবলিশিং, ঢাকা।
২) র এর কাওবয়েরা, মূল : বি রমন, অনুবাদ : মাসুমুর রহমান খলীলী এবং মোঃ একরামুল্লাহীল কাফি, ২০০৮, প্রকাশক : রতন সরকার, প্রতীতি প্রকাশন, বাংলাবাজার, ঢাকা।
৩) বাংলাদেশে র, আবু রূশদ, দ্বিতীয় সংস্করণ -২০০১, প্রকাশক : জিনাফ।