দীর্ঘ তিন বছর বিস্তীর্ণ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও বর্তমানে জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট, আইসিস, আইসিল, দায়েশ নামেও পরিচিত) মোটামুটি পরাজিত একটি শক্তি। ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী বিচ্ছিন্ন মরুময় কিছু অঞ্চল ছাড়া তাদের দখলে উল্লেখযোগ্য কোনো এলাকা নেই বললেই চলে। অথচ ২০১৫-২০১৬ সালে ইরাক-সিরিয়ার পাশাপাশি লিবিয়া এবং নাইজেরিয়ারও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তারা তাদের তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার আয়তন ছিল ইংল্যান্ডের চেয়েও বড়। তাদের শাসনাধীন এলাকায় বাস করত অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ।
Coming this weekend in @nytimes print edition: a special section for The ISIS Files, a 15-month investigative narrative by @rcallimachi https://t.co/u5DPGlfjsU pic.twitter.com/irTjbTHcMh
— Sam Dolnick (@samdolnick) April 5, 2018
- কীভাবে আইএস এত বিপুল জনসংখ্যার বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে?
- কীভাবে বিশ্বের সবগুলো শক্তির বিরুদ্ধে গিয়েও দীর্ঘ সময় জুড়ে তারা টিকে ছিল?
- তার চেয়েও বড় কথা, কী ছিল তাদের অর্থের উৎস?
বিভিন্ন সময়ই অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি এ প্রশ্নগুলোর অনেকগুলোরই আংশিক উত্তর উঠে এসেছে নিউইয়র্ক টাইমস সাংবাদিক রুকমিনি ক্যালিমাকির একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনে, যা তিনি প্রস্তুত করেছেন তার হস্তগত হওয়া আইএসের প্রায় ১৫,০০০ গোপন ফাইলের উপর দীর্ঘ ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণার পর।
রুকমিনি ক্যালিমাকি একজন রুমানিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক, যিনি দীর্ঘদিন যাবত নিউইয়র্ক টাইমসের হয়ে কাজ করছেন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের মধ্যে তাকে সেরাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং আইএসের দখলে থাকা সর্ববৃহৎ শহর মসুল মুক্ত করার অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই রুকমিনি মসুলে ছুটে যান। তার আশা ছিল, মসুলে আইএসের পরিত্যক্ত হেডকোয়ার্টারগুলো থেকে তাদের বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। ঠিক যেমনটা করেছিলেন ২০১৩ সালে মালিতে আল-কায়েদার পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে।
The ISIS Files – Part 1 – How we found the documents:https://t.co/BZ3VxcQx4V
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 6, 2018
How ISIS Makes Money – https://t.co/xZUDsQjlx1
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 7, 2018
প্রথমে অবশ্য রুকমিনির অভিযান ব্যর্থ হয়। মসুলের মুক্ত হওয়া অংশগুলোর সরকারি ভবনগুলোতে এবং আইএসের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যালয় হিসাবে পরিচিত ভবনগুলোতে গিয়ে তিনি তেমন কিছুই পাননি। হয়তো আইএস সেগুলো আগেই নষ্ট করে ফেলে, অথবা গোয়েন্দাবাহিনীর সদস্যরা তার আগেই সেগুলো উদ্ধার করে ফেলেছিল। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে রুকমিনি যখন নিউইয়র্কে ফিরে আসবেন, তখন তিনি এক স্থানীয় ইরাকির পরামর্শ অনুযায়ী শহর থেকে দূরে পরিত্যক্ত একটি সাধারণ বাড়িতে অনুসন্ধান চালান এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়িটির একটি কক্ষের মেঝেতে আইএসের কয়েকশ প্রশাসনিক নথি পেয়ে যান।
সেইবারের মতো রুকমিনি এবং তার সহকর্মীরা তাদের পিকআপ ট্রাক বোঝাই করে ফাইলগুলো নিয়ে ফেরত আসেন। কিন্তু এরপরেও তিনি আরো চারবার ইরাকে যান এবং ১১টি শহর থেকে সর্বমোট ১৫,০০০ ফাইল সংগ্রহ করেন। এরপর গত ১৫ মাস ধরে তিনি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো কয়েকজন গবেষক মিলে সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত শেষে ফাইলগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা অনুবাদ এবং বিশ্লেষণ করে অবশেষে গত সপ্তাহ থেকে ধারাবাহিকভাবে সেগুলোর উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেন। বর্তমানে তারা ফাইলগুলো সকল গবেষকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সাংবাদিকদের সাথে কাজ করছেন, যেন গবেষকরা জঙ্গি সংগঠনটির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আরো ভালো ধারণা পেতে পারে।
6. We reached the building hours before my overnight flight back to NY. The building was empty. On the way out, I stopped at what I thought was an outhouse. It wasn’t. The floor was covered with stacks of yellow folders like this one, held together with twine: pic.twitter.com/w3vt3AVpT3
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 5, 2018
ফাইলগুলো এমনিতে বিচ্ছিন্ন দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যাবলীকে নির্দেশ করে। যেমন- প্রতিবেশীর কাছ থেকে জমির মালিকানা হস্তান্তরের দলিল, ১ টন গম উৎপাদন বা বিক্রয়ের অনুমতি, নামাজ না পড়ার জন্য বা নারীদের ক্ষেত্রে অশোভন পোশাক পরিধান করার জন্য শাস্তির রায়। কিন্তু এরকম হাজার হাজার ফাইল একত্রে আইএসের জটিল প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত চিত্র ফুটিয়ে তোলে। ফাইলগুলো থেকে আবারো পরিষ্কার হয়, তারা আর দশটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে নির্দয় এবং অমানবিক হলেও তারা শুধুই সন্ত্রাস কায়েম করেনি, একই সাথে দীর্ঘ সময় জুড়ে সফলভাবে একটি রাষ্ট্রও পরিচালনা করেছিল।
রুকমিনির মতে, আইএস যে সফলভাবে এত বিশাল এলাকা পরিচালনা করতে পেরেছিল, তার একটি বড় কারণ, তারা মার্কিন বাহিনীর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করার পর মার্কিন দখলদার বাহিনী ক্ষমতাসীন বাথ পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং সম্পূর্ণ প্রশাসন ও সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে নতুন করে সাজাতে চেয়েছিল। তাদের ঐ পদক্ষেপের ফলে অযোগ্য, অনভিজ্ঞ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা দায়িত্ব নেওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়, দেশ নতুন করে গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয় এবং আল-কায়েদা, আইএস সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী সে শূন্যস্থান গ্রহণ করার সুযোগ পায়।
আইএস তাই মসুল দখল করার কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্ববর্তী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরকেই তাদের নিজেদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা ইরাকের বহাল রাখা প্রতিষ্ঠান এবং দক্ষ কর্মকর্তাদের পরিশ্রমের উপর দিয়েই তাদের তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে। আইএসের অধীনে ইরাকের কৃষিকাজ, রাস্তা নির্মাণ, শহরের বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা প্রভৃতি বিষয়ে আগের নীতিমালা যে বহাল ছিল, শুধু তা-ই না, তাদের কঠোর নিয়মাবলী এবং শাস্তির ভয়ে পূর্ববর্তী ইরাক সরকারের চেয়েও সেগুলো দক্ষভাবে কাজ করছিল।
কিন্তু যে প্রশ্নটা সবার মাথায় আসে, এত বড় একটি এলাকা পরিচালনা করার জন্য আইএস অর্থ পেত কোথা থেকে? রুকমিনি তার উত্তর দেন এভাবে- ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোনো রাষ্ট্র যেভাবে অর্থ পায়, আইএসও সেভাবেই অর্থ পেত। তারা জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করত এবং সেই ট্যাক্স সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত কার্যকর। বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স ছাড়াও সম্পত্তির ২.৫% এবং উৎপন্ন ফসলের ১০% হিসেবে তারা জাকাত সংগ্রহ করত এবং সেগুলো থেকেই তাদের সৈন্যদের খরচ চালাতো। আর এই ১০% ফসলের ট্যাক্সের জন্য তারা ফসল উৎপাদনের প্রতি প্রচণ্ড গুরুত্ব দিত।
6. This is one of 100s of revenue intake forms that I recovered from ISIS’ Ministry of Agriculture. It shows that on a single day in late 2016, an ISIS accountant received $70,000 from one trader for the sale of grain and over $80,000 at today’s exchange rate from a second: pic.twitter.com/x8U12Sj3qx
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 6, 2018
আইএস কেবলমাত্র তাদের আদর্শ অনুসরণকারী সুন্নি ছাড়া বাকি সব ধর্মীয় সম্প্রদায়কে কাফের হিসাবে গণ্য করত। ফলে তাদের জমি এবং সম্পত্তি দখল করে নিয়ে সুন্নিদেরকে দিত চাষ করার জন্য। ফসল উৎপাদনের প্রতিটি ধাপ তারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করত, যে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে কণা পরিমাণ ফসলও কেউ উৎপাদন করতে পারত না। সংগ্রহ করা আইএসের কৃষি মন্ত্রণালয়ের ফাইল থেকে রুকমিনি দেখান যে, ২০১৫ সালের একদিনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শুধুমাত্র বার্লি এবং গম বিক্রয় থেকেই আইএসের আয় হয়েছিল ১.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের অর্থ।
আইএসের দখলে থাকা মসুল এলাকাটি ইরাকের সবচেয়ে উর্বর এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। তাদের দখলে থাকা অবস্থায় মসুলে গম উৎপন্ন হতো ইরাকের বার্ষিক চাহিদার চল্লিশ শতাংশ এবং বার্লি হতো বার্ষিক চাহিদার অর্ধেকের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে ভিন্ন এক গবেষণা অনুযায়ী, সিরিয়ার তুলা উৎপাদন ক্ষেত্রের শতকরা ৮০ ভাগই ছিল আইএসের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে। এসব কারণে শস্য থেকে আইএস বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারত।
11. You could argue the Nineveh Plains upon which Mosul sits are Iraq’s most fertile. So surely the receipts from ag will be higher there. But documents retrieved by @ajaltamimi in the oil-rich district in Syria show that even there the ratio of income from taxes vs oil was 6:1.
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 6, 2018
আইএসকে বিবেচনা করা হতো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। এক হিসাব অনুযায়ী, সে সময় তেল বিক্রি থেকেই আইএসের আয় হতো সপ্তাহে ২ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু রুকমিনির সংগৃহীত ফাইল থেকে দেখা যায়, এ আয় ছিল শস্য থেকে আয় হওয়া অর্থের চেয়ে অনেক কম। তবে এ ধরনের হিসাব অবশ্য এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ভিন্ন একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, তেল বিক্রয় লব্ধ অর্থের পরিমাণ ছিল আইএসের অন্যান্য আয়ের মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ।
তেলের উপর তুলনামূলকভাবে কম নির্ভরতার কারণেই রাশিয়া তুরস্কগামী আইএসের তেলবাহী ট্রাকগুলো ধ্বংস করার এবং পরবর্তীতে আমেরিকাও আইএসের তেল স্থাপনাগুলোর উপর আক্রমণ করার পরেও তাদের খুব বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়নি। রুকমিনির ভাষায়, শস্য ক্ষেত্রগুলোর উপর আক্রমণ করার উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরাজয়ের কয়েক সপ্তাহ পূর্ব পর্যন্তও আইএস শস্য উৎপাদন থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করে যেতে পেরেছিল।
22. Farmers explained to me that they didn’t own harvesting combines. ISIS called a meeting of the owners of combines and announced they now reported to ISIS. Their combines would be confiscated if they threshed a field without ISIS’ knowledge.
— Rukmini Callimachi (@rcallimachi) April 6, 2018
তবে রুকমিনির সংগৃহীত ফাইলগুলোতে উঠে না এলেও এর মানে এই না যে, আইএসের আর কোনো আয়ের উৎস ছিল না। সরাসরি প্রমাণ না থাকলেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইএসকে গোপনে সাহায্য করার অভিযোগ উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অভিযোগ আছে আইএস সৃষ্টির পরিস্থিতি সৃষ্টি করার এবং গোপনে ভিন্ন মাধ্যমে আইএসকে অস্ত্র সরবরাহ করার। তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সীমান্ত দিয়ে আইএস যোদ্ধাদেরকে বিনা বাধায় সিরিয়াতে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেওয়ায় এবং আইএসের কাছ থেকে তেল ক্রয় করে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সচল রাখার। সৌদি আরব এবং কাতারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে আইএসকে অস্ত্র এবং অর্থ সহযোগিতা দেওয়ার। সেসব অর্থের পরিমাণ হয়তো ট্যাক্সের চেয়ে কম হতে পারে, কিন্তু অগ্রাহ্য করার মতো না। হয়তো সেসব তথ্যও উঠে আসবে ভবিষ্যতে কোনো সময়, অন্য কোনো সাংবাদিকের ভিন্ন কোনো প্রতিবেদনে।
Featured Image Source- Newyork Times