বিশ্বের মানচিত্রে নবীনতম দেশ দক্ষিণ সুদান। স্বাধীনতার ছয় বছর পর আর দশটি স্বাধীন দেশের মতো জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের শরণার্থী সংকটে সিরিয়া ও আফগানিস্তানের পর তৃতীয় বৃহত্তম শরণার্থী দক্ষিণ সুদানের। মাটির নিচে প্রচুর খনিজ তেল থাকলেও, দশকের পর দশক ব্যাপী যুদ্ধ বিদ্যমান থাকায় অবস্থার উন্নতি হয়নি মোটেও। মাত্র ১৫% নাগরিক হাতে মোবাইল ফোন পেয়েছে। পাকা সড়কও হয়েছে অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০১৮ সালের মার্চ মাস নাগাদ পঞ্চাশ লক্ষেরও অধিক নাগরিক খাদ্যাভাবের সম্মুখীন হবে।
সংকটের সূচনা যেভাবে হলো
২০১১ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়। কিন্তু নাগরিকদের ভাগ্যে কষ্টার্জিত বিজয়ের উদযাপন বেশি দিন ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দ্য সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট। কিন্তু স্বাধীন হবার পর ক্ষমতার প্রশ্নে তারা দুই ভাগ হয়ে গেল। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি সালভা কির, উপ-রাষ্ট্রপতি রিক মাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের পর প্রধান সংকটের সূত্রপাত হয়।
রাজধানী জুবার রাস্তায় সরকার দলের দুই অংশ নিজেদের বিরোধকে সহিংসতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। তারা দুজন ছিলেন দুই জাতিগোষ্ঠীর। সালভা কির ছিলেন ডিংকা জাতির আর রিক ছিলেন ন্যুয়ের জাতির। ফলাফল, কিছুদিনের মাঝেই জাতিগত বিদ্বেষও সংঘর্ষের রূপ নেয়। জুবার পর এ বিদ্রোহ বোর আর বেনিতোতেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম মাসেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতার শিকার হয়ে ঘর ছাড়ে ৪ লক্ষ ১৩ হাজার মানুষ। দশ হাজারের বেশি মানুষ জাতিসংঘের বিভিন্ন ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। ঘাঁটিগুলো অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশাল শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়। পুরো একটি জাতিকে সংকটের দিকে ঠেলে দিয়ে দিন দিন বাড়তে থাকে সহিংসতা। ২০১৫ সালে কির ১০টি রাজ্য বিলুপ্ত করে ২৮টি নতুন রাজ্য গঠন করেন। এতে আবারো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে থাকে।
এখন যা হচ্ছে
গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কয়েকটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। সর্বশেষটি হয়েছিল ২০১৫ সালের আগস্টে। কিন্তু কোনো চুক্তিই ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি জোট সরকার গঠিত হলেও জুলাইয়ে জুবার সংঘর্ষের পর রিক মাচার দেশ ছেড়ে পালান। এরপর প্রেসিডেন্ট কির নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। এটা যেন মাচারের অনুসারীদের আবারো যুদ্ধে টেনে আনা। দক্ষিণ সুদানের বর্তমান পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল। অলিগলিতে ওঁৎ পেতে থাকে সন্ত্রাসের সমূহ সম্ভাবনা।
২০১৭ সালে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আরো দক্ষিণে। ফলে সে স্থানগুলোতে খাদ্যের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এখানকার অঞ্চলগুলো থেকেই আসতো খাদ্যের বেশিরভাগ যোগান। ফলাফল, ২০১৬ সালের তুলনায় দ্বিগুণ মানুষ জরুরি অবস্থায় ছিল ২০১৭ সালে। দুটি ফসল তোলার মধ্যবর্তী সময়ে যখন খাদ্যের অভাব চলে, তার চেয়েও কম খাদ্য মজুদ আছে গুদামগুলোতে।
চলমান সহিংসতার কারণে দেশটির অর্থনীতিও সংকটের মুখে রয়েছে। নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও সেবার মূল্য আকাশচুম্বী। একইভাবে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮৩৫ শতাংশ, যা মুদ্রাস্ফীতির তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে। ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানের বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ মানুষ। বর্তমানে দুর্ভিক্ষ না থাকার দাবি করা হলেও মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশের বিভিন্ন ধরনের মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে।
দক্ষিণ সুদানবাসীর সাথে যা ঘটছে
সংঘর্ষ শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত দেশের এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক স্থানান্তরিত হয়েছে। তাদের ভেতর ৩.৭ মিলিয়ন লোক বাধ্য হয়ে গৃহত্যাগ করেছে। প্রতিবেশী দেশ সুদান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও উগান্ডাতে আশ্রয় নিয়েছে ২.১ মিলিয়ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় আটকা পড়েছে ১.৮ মিলিয়ন। হারিয়েছে প্রিয়জন, জমি-জমা ও জীবিকা।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ নাগরিক। লিঙ্গভিত্তিক সন্ত্রাস, অপহরণ, খুন, নাগরিকদের বসতবাড়ি পুড়ানো ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন বেড়েই চলছে। নাগরিকদের সাথে ঘটা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বললেই ভাগ্যে জুটছে গুম, খুন অথবা জেল। প্রেসিডেন্ট কির একজন প্রতিবাদী গভর্নরকে আটক করার পর পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়েছে। নামকরা সাংবাদিকদের অপহরণের পর অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে। সৈনিকেরা নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিপরীত মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। খাদ্য, ওষুধসহ দৈনন্দিন চাহিদার বিভিন্ন জিনিস পাচ্ছে না নাগরিকেরা। আন্তর্জাতিক সংগঠনের আনা ত্রাণ ও সাহায্যের বহরে সন্ত্রাসী হামলা চলার ফলে অভাবী পরিবারদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চেষ্টায় চালু আছে বাচ্চাদের কিছু স্কুল। কিন্তু এ সংকটময় অবস্থায় শিক্ষার গুরুত্ব পরাজিত হচ্ছে জীবনের প্রয়োজনীয়তার কাছে। শিশুরা যুদ্ধময় পরিবেশে বেড়ে উঠছে সহজাত সৈনিক হয়ে। দুটি দলই শিশু সৈনিক নিয়োগ করেছে ইচ্ছেমতো।
খাদ্যাভাব ঠিক কতটা?
২০১৪ সালের খাদ্যাভাব থেকে রক্ষা করেছিল বড় একটি মানবিক সাহায্য। কিন্তু অবস্থার অবনতি হয়েছে আবারো। কৃষকেরা জমিতে চাষ করতে পারছে না, বাজার ধ্বংস করা হচ্ছে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাধারণ নাগরিকদের নাগালের বাইরে। ৬ মিলিয়ন নাগরিককে নিয়ে নিজের আগমন জানান দিতে শুরু করেছে দুর্ভিক্ষ। না খেয়ে মরছে মানুষ।
খাদ্য এত কম কেন?
এখানকার মাটি কৃষি উপযোগী হলেও সেখানে রয়েছে কৃষি প্রযুক্তির অভাব। এরকম সীমাবদ্ধতা কৃষিতে সবসময় বড় একটি বাধা। দশকের পর দশক ব্যাপী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জনের দুই বছরের মাথায়, ২০১৩ সালে তাদের খাদ্যের উৎপাদন অন্যান্য যেকোনো সময় থেকে ভালো ছিল। কিন্তু তারপর সংঘর্ষের সূচনায় কৃষকদের জীবন বিপর্যস্ত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যের মজুদ কমতে থাকে।
নাগরিকেরা কি খাদ্য কিনতে পারছে?
না, কারণ খাদ্যের মজুদ দিন দিন তলানির দিকে। অনেকগুলো বাজারে কিছুই নেই। ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের ভয়ে নিরাপদ এলাকা থেকে খাবার এনে যোগান দিতে পারছে না। মুদ্রাস্ফীতির কারণে কোনো কিছু কেনা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি, আর গৃহহীন পরিবারগুলোর হাতে টাকাও নেই। ২০১৫ সালের তুলনায় তাদের কোনো কোনো প্রধান খাদ্যের দাম বেড়েছে ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত!
অবস্থা এত দ্রুত খারাপ হয়ে গেল কেন?
দীর্ঘ ২৫ বছরের নির্মম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সুদানের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছিল দক্ষিণ সুদান। দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে শুরু থেকেই সবদিক দিয়ে দুর্বল ছিল দেশটি। পৃথিবীর অন্যতম অনুন্নত এ দেশের অল্প কিছু শহরাঞ্চল বাদে পুরোটাই গ্রাম। সেখানকার মানুষদের বেশিরভাগই দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। স্বাধীনতার পর আবারো সংকট শুরু হলে সহজেই অর্থনীতি ও খাদ্যমজুদে ধ্বস নামে।
ক্যাম্পের জীবন কেমন?
জাতিসংঘের ছয়টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া নাগরিকেরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদে থাকলেও ক্যাম্পগুলোর অবস্থা হয়ে পড়েছে মানবেতর। কারণ এগুলো এত বেশি সংখ্যক মানুষের জন্য নির্মিত নয়। যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে সংক্রামক রোগের শিকার হচ্ছে ক্যাম্পের বাসিন্দারা। অনেক সময় বন্যার পানিতে টয়লেট ভেসে যায় এবং নোংরা পানিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় ক্যাম্প। মাঝে মাঝে সহিংস আক্রমণ ক্যাম্প পর্যন্তও চলে আসে।
রিক মাচার দেশত্যাগের পর বাড়তে থাকা সংঘর্ষে জাতিসংঘ ঘাঁটির একটি হাসপাতালে হামলা চালানো হয়। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সৈনিকদের দক্ষিন সুদানের ভেতর থাকা নিষিদ্ধ করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী।
ক্যাম্পের বাইরের জীবন কেমন?
অনেক নাগরিক ক্যাম্পের বাইরে বেঁচে আছে। এরা অন্য কোনো দেশে পালাতে পারেনি, ক্যাম্পে আশ্রয়ও নেয়নি। তাদের অনেকেরই ঠাই হয়েছে বনে-জঙ্গলে। সেখানে শেকড়বাকড়, শাপলা ইত্যাদি খেয়ে থাকতে হচ্ছে। কখনো এক বেলা খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছ। কেউ কেউ নির্জন গ্রাম খুঁজে নিচ্ছে , কিন্তু সেখানে খাবার খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। প্রতি মুহূর্তে তাদের ভয়ে থাকতে হয়, এই বুঝি আক্রমণকারীরা এসে পড়লো। তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়াও দুঃসাধ্য।
রোগবালাই
অনাহার ও অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগ তো আছেই, পাশাপাশি বন্যাকবলিত হবার পর পানিবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া, কলেরা ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শিশুরা সবসময় ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকে। অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে দূষিত পানিই পান করে ফেলে। ফলাফল পানিবাহিত রোগ। ২০১৭ সালে ১৩ হাজার কলেরা রোগের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
দক্ষিণ সুদান পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে কি?
না, ৭.৬ মিলিয়ন মানুষকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ ২০১৭ সালে ১.৬৪ বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের আবেদন করেছিল। তার ৭০ শতাংশ গৃহীত হয়। এছাড়া চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্য শান্তিচুক্তি করানোতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। জাতিসংঘের পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয় তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন দেশটিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেও সেসব সহায্য পর্যাপ্ত নয়। এদিকে সরকারও সাহায্যকারীদের ভালোভাবে গ্রহণ করছে না।
যুদ্ধ চলতে থাকলে কী ঘটবে?
যুদ্ধ আর পারস্পারিক আক্রমণ বন্ধ করা না গেলে শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। কৃষিপ্রধান দেশের কৃষকেরা চাষ করতে পারবে না। অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে না। দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়ে অন্যান্য জাতি ও সংগঠনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে দেশটিকে।
ফিচার ইমেজ- The Intercept