পেঁয়াজ বর্তমান পৃথিবীতে রান্নায় ব্যবহৃত অন্যতম জনপ্রিয় একটি মসলা। নানা মজাদার রান্নায় ব্যবহারের পাশাপাশি পেঁয়াজের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। তাই পৃথিবীর প্রায় সব স্থানেই রয়েছে পেঁয়াজের আলাদা কদর। আমাদের দেশেও পেঁয়াজের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই তো ক’দিন আগেও আমাদের দেশে পেঁয়াজ ছিল উচ্চমূল্য। অনেকেই সেসময় পেঁয়াজের সাথে অর্থের তুলনা কিংবা উপহার হিসেবে পেঁয়াজ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে মজা করেছিলেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কিন্তু এই পেঁয়াজ সত্যই অর্থের বিকল্প ও লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মানুষ নানা উপলক্ষে একে অন্যকে উপহার দিত পেঁয়াজ! কী? বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন আজকে জেনে নেই পেঁয়াজের এই অদ্ভুত ইতিহাস সম্পর্কে।
পেঁয়াজ ছিলতে গিয়ে অনেকের চোখের জল নাকের জল এক হলেও পেঁয়াজের উপকারী গুণ ও আরোগ্য ক্ষমতা কিন্তু অবিশ্বাস্য! আর মসলা হিসাবে পেঁয়াজের গুরুত্ব তো বলাই বাহুল্য। পেঁয়াজ প্রাচীন মসলা। সেই প্রাচীন রোমের এক বিখ্যাত খাদ্যরসিক এপিসিয়াসের লেখাতে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নার মেনুতেও ছিল পেঁয়াজ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে ঠিক কবে থেকে এই পেঁয়াজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল কিংবা ঠিক কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রচলন ঘটে তা সঠিক জানা যায়নি। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতো।
এসব কারণে পেঁয়াজ যে খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য ছিল তা কিন্তু বলাই যায়। সেই সুদূর পূর্ব থেকে প্রাচীন মিশর অব্দি, পৃথিবীর বহু দেশে বহু সংস্কৃতিতে পেঁয়াজের ব্যবহারের বহু দলিল ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যায়। সেই সাথে মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর বহু স্থানে এই পেঁয়াজকেই অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসাবে দেখা হতো। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি ও এর সমকেন্দ্রিক একটির উপর আরেকটি চক্রাকার রিং থেকে এই ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়।
শুধু তাই নয়, প্রাচীনকালে মানুষের কাছে পেঁয়াজের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পেঁয়াজ ছিল পূজনীয় বস্তু। তারা মনে করতো মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখতো। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে। এই সমাধি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষু কোটরে ভরে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি স্থানে পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিসরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মে পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বহু মিশরীয় যাজকদেরকেও ছবিতে পেঁয়াজ হাতে দেখা গিয়েছে।
পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ কি আপনার অপছন্দ? তবে জেনে রাখুন, কিছু মিশরীয়দের ধারণা ছিল পেঁয়াজের এই ঝাঁঝালো গন্ধ ও তার জাদুকরী ক্ষমতায় মৃত মানুষ আবার নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করে। গবেষকদের মতে, এমন ধারণার পিছে কারণ হলো, পেঁয়াজের ঔষধি গুণ। পেঁয়াজের ঔষধি গুণের কারণে নানা অসুখ ভালো হতো। ফলে মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। বাইবেলেও ইসরাইলীদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখে হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ ঠিক মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নার প্রধান তিন উপাদান ছিল শিম, পেঁয়াজ ও বাঁধাকপি। ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করতো।
ইতিহাসে ওষুধ হিসাবেও পেঁয়াজের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ষোড়শ শতাব্দীতে ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের কিছু অদ্ভুত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। যেসব মহিলার সন্তান জন্ম দিতে সমস্যা দেখা যেত কিংবা যাদের কোনো ছেলেমেয়ে হতো না তাদেরকে বিশেষভাবে পেঁয়াজ খেতে দেওয়া হতো। মাথাব্যথা উপশমের জন্য পেঁয়াজের ব্যবহার ছিল বহু প্রচলিত। এছাড়া সাপের কামড় ও চুল পড়া রোধে পেঁয়াজ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতো।
ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষ যখন আটলান্টিকের অন্য পাশের উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায় পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে পাড়ি জমালো, তখন তারা তাদের সাথে করে কিছু পেঁয়াজ নিয়ে আসতে ভোলেনি। তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা যায়, আমেরিকায় সেই ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমেই প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয়। উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমানো প্রথম ঔপনিবেশিকদের প্রথম চাষ করা ফসল ছিল পেঁয়াজ। তবে, ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার চালু ছিল। তারা নানা সিরাপ, রঙ ও ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। কাঁচা কিংবা রান্না করে এবং বিভিন্ন রান্নার মশলা হিসাবেও তারা ব্যবহার করতো পেঁয়াজ।
ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থ চক্র সংহিতাতেও ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হৃদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর প্রাচীনকালের এসব বর্ণনার সত্যতা মিলছে বর্তমানের আধুনিক নানা গবেষণায়। বর্তমানে পেঁয়াজের নানা ওষধি গুণ কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পেঁয়াজ থেকে নানা ওষুধও তৈরি হয় এখন।
তাই পেঁয়াজ যদি আপনার অপছন্দের তালিকায় থেকে থাকে কিংবা পেঁয়াজকে যদি আপনার তুচ্ছ কোনো মশলা বলে মনে হয়, তবে আশা করা যায় আজকের এই লেখা পড়ার পর আপনার ধারনা হয়তো কিছুটা হলেও বদলাবে।
ফিচার ইমেজ – জেরামিয়াহ জে. হোয়াইটের আকাঁনো পেঁয়াজের একটি তৈলচিত্র