Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ এর আড়ালে মানুষের জন্য লুকিয়ে থাকা গোপনবার্তাটি কী?

হাতে আঁকা ছবিটা দেখতে অসাধারণ কিছু নয়। ইতালির ভেনিসে অবস্থিত ডেল অ্যাকাদেমিয়া জাদুঘরে ক্ষণিকের জন্য উন্মুক্ত করা হবে দর্শনার্থীদের কাছে। আর তাতেই উপচে পড়া ভিড়। কী এমন রহস্য উদঘাটন করেছিলেন লিওনার্দো, যা তাকে এই ছবিটি আঁকতে বাধ্য করেছিল? শুধু যে চিত্রকর নন, একাধারে গণিত, স্থাপত্যবিদ্যা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমান পারদর্শী তিনি। গণিতের প্রতি ভালোবাসা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, তিনি বলেই ফেলেছিলেন,

“যে ব্যক্তি গণিতের উচ্চজ্ঞানকে ঘৃণা করে সে বিভ্রান্ত, আর যে বিজ্ঞান সে জানে, তা হচ্ছে অবিশুদ্ধ বিজ্ঞান।”

গণিতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হয়তো মানবদেহ নিয়ে আগ্রহ জন্মায় ভিঞ্চির মনে, যার ফলাফল ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’।

লিওনার্দো সবসময় তার সাথে কিছু নোটবুক রাখতেন আর এই নোটবুকগুলোতে লেখা থাকতো তার গবেষণালব্ধ জ্ঞান। লিখতেন বেশ অদ্ভুত ভঙ্গিতে। ইতালীয় ভাষায়, কিন্তু লেখা থাকত উল্টো দিকে ঘুরানো, যার পাঠোদ্ধার করতে দরকার হতো আয়নার। এমন এক নোটবুকের পাতায় ছবিটি এঁকেছিলেন লিওনার্দো, ছবিটি জনসাধারণের জন্য আঁকেননি তিনি, এঁকেছিলেন মানবদেহের প্রতি নিজের অদম্য কৌতূহল থেকে। কী ছিলো এই ছবিতে?

সাধারণ কাগজে সাধারণ কালিতে আঁকা ছবিটিতে মানুষকে দুটি পৃথক বিন্যাসে দেখানো হয়েছে, প্রথমক্ষেত্রে একটি বর্গের মাঝে এবং দ্বিতীয় বিন্যাসে একটি বৃত্তের মাঝে। ছবিটিতে বেশ কিছু অনুপাতও লিপিবদ্ধ করা ছিলো। আর এই অনুপাতগুলোকেই বলা হয় ‘মানবদেহের ঐশ্বরিক অনুপাত’ বা Divine Proportion।

লিওনার্দোর আঁকা ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’, source: matome.naver

ড্যান ব্রাউনের Da Vinci Code বইটি যারা পড়েছেন তাদের কাছে ওপরের ছবিটি বেশ পরিচিত লাগবে।

প্রশ্ন হচ্ছে ভিঞ্চি কেন ছবিটি এঁকেছিলেন বা কে তাকে ছবিটি আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন? প্রাচীনকাল থেকেই মানবদেহ নিয়ে গবেষণা চলে আসছে। তিনি আসলে বিশ্বাস করতেন, মানবদেহ নিয়ে কাজ করা মহাবিশ্ব নিয়ে কাজ করার অনুরূপ। প্রাচীন জ্ঞান অনুযায়ী মানবদেহ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নীল নকশা। আর এর কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আনুপাতিক সামঞ্জস্য বা প্রতিসমতা। তবে ১৪৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে আঁকা ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ এর ধারণাটি ভিঞ্চির নিজের নয়।

ভানিসের ডেল অ্যাকাদেমিয়া গ্যালারি, source: venicemuseumguide

লিওনার্দো যখন ছবিটি এঁকেছিলেন, তারও প্রায় ১,৫০০ বছর আগে ভিট্রুভিয়ান ধারণাটির জন্ম। ছবিটির নাম ভিট্রুভিয়ান করা হয়েছিলো যার নামে, তিনি হচ্ছেন প্রাচীন রোমের একজন স্থপতি, মার্কাস ভিট্রুভিয়ান পোলিও। একটা বই লিখেছিলেন তিনি- De Architecura। স্থাপত্য নিয়ে ১০ খণ্ডের লেখা এই বইটির বিভিন্ন খণ্ডে যন্ত্রকলা, নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্যের নানা জ্ঞান সন্নিবেশিত ছিলো। ১৫ থেকে ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝে লেখা এই বইটি লেখক তৎকালীন সম্রাট সিজার অগাস্টাসকে (৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ১৪ খ্রিস্টাব্দ) উৎসর্গ করেছিলেন। স্থাপত্যবিদ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত বইটি প্রাচীন রোমানদের সময় থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।

De architectura বইটি, ১৫৫২ সংস্করণ, Source: pinterest

এই বইয়ের তৃতীয় ভাগে ভিট্রুভিয়ান ধারণাটির সূত্রপাত ঘটে এবং এই খণ্ডের আলোচ্য বিষয় ছিলো মন্দির নির্মাণ শিল্প।

চিত্রকর্মে যা তুলে ধরা হয়েছে

  • শুরুতে যে ব্যপারটি চোখে পড়ে, তা হলো একজন মানুষ যদি ভূমির উপর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে হাতগুলোকে ভূমির সমান্তরালে আনুভূমিকভাবে দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়, তাহলে একটি বর্গক্ষেত্রের পরিধির সাথে মিলে যাবে।
  • পরের বিন্যাসে যদি হাত দুটো মাথার একটু ওপরে ছড়িয়ে দেয়, সাথে পা দুটোও ছড়ানো থাকে, তাহলে একটি বৃত্তের ভেতরে অবস্থান হবে মানুষটির। উভয়ক্ষেত্রেই মানুষটির নাভি থাকবে কেন্দ্র। অর্থাৎ নাভিবিন্দুকে কেন্দ্র করে কম্পাস দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকলে মানুষটি বৃত্তের পরিধির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।

Source: Faze Magazine

ছবিটি থেকে প্রাপ্ত আরো কিছু অনুপাত হচ্ছে-

  • দুদিকে সমানভাবে হাত প্রসারিত করলে এক হাতের শীর্ষ থেকে অপর হাতের শীর্ষ আসলে ঐ মানুষটির উচ্চতা
  • কনুই থেকে হাতের অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
  • লিঙ্গ মানুষের উচ্চতার প্রায় অর্ধেক বরাবর অবস্থান করে
  • মাথার অগ্রভাগ থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত দূরত্ব হলো একজন মানুষের উচ্চতার ৮ ভাগের ১ ভাগ
  • বুকের উপর থেকে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৬ ভাগের ১ ভাগ
  • বুকের উপর থেকে চুলের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৭ ভাগের ১ ভাগ
  • কাঁধের মাপ হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
  • স্তন থেকে মাথার অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
  • কনুই থেকে বোগল পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৮ ভাগের ১ ভাগ
  • কনুই থেকে আঙুলের শীর্ষ পর্যন্ত দূরত্ব উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
  • হাতের আঙুল থেকে কবজি পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ১০ ভাগের ১ ভাগ
  • পায়ের পাতা, মানুষের উচ্চতার ৬ ভাগের ১ ভাগ
  • পায়ের তলা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ
  • হাঁটুর নিচ থেকে লিঙ্গের গোড়া অবধি দূরত্ব হলো উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ

ভিট্রুভিয়াসের ধারণা অনুপাতকেন্দ্রিক হলেও ছবিটি লিওনার্দো অনেক নিখুঁত করে এঁকেছেন। রেখেছেন তার শৈল্পিক মন ও গণিত- জ্যামিতির প্রতি ভালোলাগার ছাপ।

কথা হচ্ছে, ছবিটির সাথে স্থাপত্যের সম্পর্ক কোথায়? প্রাচীনকালে গ্রিকরা যেকোনো কিছু মাপার ক্ষেত্রে তাদের আঙুল, হাত, পায়ের পাতা ব্যবহার করত। তাদের কাছে ১০ ছিলো একটি আদর্শ সংখ্যা, যেহেতু আমাদের দু’হাতে মোট আঙুল আছে ১০টি। তাদের ব্যবহৃত অন্য হিসেবগুলো হচ্ছে-

  • এক হাতের তালু বা বিঘত সমান ৪ আঙ্গুল
  • ৬ বিঘত সমান এক কিউবিট
  • মানুষের উচ্চতা ৪ কিউবিট

এরকম কিছু হিসাব থেকেই ৬:১০, ৬:১৬ এবং ১০:১৬ এর মতো অনুপাত প্রাচীন স্থাপত্যে শিল্পে ব্যবহৃত হতো। বাড়ির কক্ষ ডিজাইনের ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার পরিমাপ যদি ১৬:১০:৬ হয়, তাহলে বলা যায় যে কক্ষটির নকশা যথাযথ হয়েছে।

যে গাণিতিক সমস্যার সমাধান দিয়েছিল ছবিটি

ভিঞ্চির সকল শিল্পকর্মের পেছনে কোনো গোপন বার্তা থাকে।

প্রাচীন গণিতবিদগণের মাঝে এক অদ্ভুত জ্যামিতিক সমস্যা সমাধানের ভূত চাপে। সমস্যাটির নাম squaring a circle, অর্থাৎ কীভাবে একটি বর্গক্ষেত্রের মাঝে বৃত্তকে স্থাপন করা যায়? সরাসরি কোনো বৃত্তের ক্ষেত্রফল আমরা বের করতে পারি, তেমনি আলাদাভাবে বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল বের করার সূত্রও আমাদের জানা। কিন্তু যদি বলা হয়, এই দুটির একটিকে আরেকটির ভেতরে খাপে খাপে বসাতে হবে? এটি কি আদৌ সম্ভব?

প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ এটা সমাধান করতে গিয়ে দেখলেন- না, করা যাচ্ছে না।

অর্থাৎ কিছু্তেই সমান ক্ষেত্রফলের দুটি বৃত্ত আর বর্গক্ষেত্রের মধ্যে আঁঁটানো যাবে না। যদি কোনো কিছু বর্গক্ষেত্রে এঁটে যায়, তাহলে সেটা বৃত্ত হবে না আর উল্টোটাও প্রযোজ্য।

কিন্তু ভিট্রুভিয়ান ম্যানের এই ছবিটির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, একমাত্র মানুষ একইসাথে একটি বৃত্ত ও বর্গের মাঝে অবস্থান করতে পারে। মানবদেহকে ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভিঞ্চি এই জ্যামিতিক সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছিলেন, যদিও ধারণাটি পেয়েছিলেন ভিট্রুভিয়াস থেকে। এই ছবিটির পেছনে মর্ম হচ্ছে মানুষ সবকিছুর চেয়ে আলাদা। অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর সমসাময়িক ও প্ল্যাটোনিজমের যুগে বিজ্ঞানীগণ মনে করতেন, মহাবিশ্বের সবকিছুই একটা শেকলের মতো, যার শুরুতে আছেন ঈশ্বর। তারপর যত নিচে যাওয়া যায় পাওয়া যাবে ফেরেশতা, গ্রহ, নক্ষত্র এবং শেকলের সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থান হচ্ছে শয়তানের।

নিওপ্ল্যাটোনিক চেইন, source: 2truemushroom

তাহলে মানুষের অবস্থান কোথায়? মানুষের অবস্থান এই শেকলের ঠিক মাঝখানে, কেননা মানুষের আছে একটি মরণশীল দেহ এবং অমর আত্মা। অর্থাৎ শরীর ঠিকই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, কিন্তু আত্মা নয়। কিন্তু এই শেকলের বাকি যারা আছে, তাদের কারো কারো শুধু আত্মা আছে, কারো কারো শুধু দেহ।

কিন্তু বিজ্ঞানী পিকো ডেলা মিরানডোলা ভিন্ন মত পোষণ করলেন। তিনি বললেন,

“Humans have a unique ability to take any position they want”

অর্থাৎ মানুষ যে সবসময় মাঝেই থাকবে এমনটি নয়, এই শেকলের যেকোনো স্থান সে নিতে পারে। তিনি আরো বলেন, ঈশ্বর এমন কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা একসাথে জটিল হবে এবং সুন্দরও। তাই তিনি জটিলতা ও সৌন্দর্যের এক অদ্ভুত মিশ্রণে তৈরি করলেন মানুষ। আর এই মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে এই শিকলের যেকোনো অবস্থানে থাকতে পারে এবং চাইলে শেকলের নিচেও নামতে পারে।

এই একটি ছবিতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একসাথে গণিত, ধর্ম, দর্শন ও স্থাপত্যবিদ্যার সংযোগ দেখিয়েছিলেন এবং ছবিটি সারা বিশ্বের জন্য হয়ে ওঠে একটি আইকনিক শিল্পকর্ম।

Featured Image Source: Science Vibe

Related Articles