ব্যারি লেভিনসনের অস্কারজয়ী মুভি রেইন ম্যানে ডাস্টিন হফম্যানকে তুখোড় মেধাবী একজন অটিস্টিক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। রেমন্ড ব্যাবিট নামের সেই লোক মুহূর্তে করে দিতে পারতেন যেকোনো হিসাব, এক নিমিষে গুণে ফেলতে পারতেন মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা টুথপিকগুলোকে। তবে রেইন ম্যান মুভিটি যত জনপ্রিয়ই হোক, অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে বাস্তবে আসলেই এরকম একজন মানুষ ছিলেন। তিনি হলেন লরেন্স কিম পিক, যার জীবনের কাহিনী মুভির গল্পটার থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর।
১৯৫১ সালের ১১ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের উতাহর সল্ট লেক সিটিতে কিম পিক জন্মগ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যবশত জন্মের সময় ম্যাক্রোসেফ্যালি নামক একধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হন কিম, যার কারণে মাথার খুলি কিংবা ক্রেনিয়াম হাড় শরীরের তুলনায় বড় হয়ে যায়। তার মগজের দুটি হেমিস্ফেয়ারকে জোড়া লাগানো স্নায়ুগুলোর বেশ কয়েকটা ছিল না। ধারণা করা হয়, মস্তিষ্কে কর্পাস ক্যালোসামের অনুপস্থিতিতে তার নিউরনগুলো স্বাভাবিক যেকোনো মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। এভাবেই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিটা অভিশাপের বদলে আশীর্বাদ হয়ে আসে কিম পিকের জন্য।
কিমের বাবা ফ্র্যান (ফ্র্যান্সিস) পিক জানিয়েছেন, মাত্র ষোল মাস বয়স থেকেই কিম যেকোনো জিনিস মনে রাখতে পারতেন। শেলফের যেকোনো বই পড়ে সেটাকে উল্টো করে সাজিয়ে রাখতেন, যাতে বোঝা যায় যে সেই বইগুলো পড়া হয়ে গেছে। এই অভ্যাস তিনি সারাজীবন পালন করে গেছেন। তিনি একঘন্টার কমে যেকোনো বই পড়ে শেষ করে ফেলতেন এবং নিখুঁতভাবে সকল তথ্য মনে রাখতে পারতেন। ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে গান-বাজনা, খেলাধুলা কোনো ব্যাপারেই তার জ্ঞানের ঘাটতি ছিল না।
তার আরেকটি অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা হলো দু’চোখ দিয়ে দুটি ভিন্ন জিনিস পড়তে পারা। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে আর কারো এই ক্ষমতা নেই। বাম চোখ দিয়ে বইয়ের বাম পৃষ্ঠা আর ডান চোখ দিয়ে ডান পৃষ্ঠা পড়তে পারার কারণে বড় বড় বইও অল্প সময়ে শেষ করে ফেলা কোনো ব্যাপার ছিল না তার জন্য।
হিসাব অনুযায়ী, তিনি প্রায় ১২,০০০ বইয়ের জ্ঞান মগজে ধারণ করে রেখেছিলেন। এমনিভাবে তিনি পরিণত হন এক চলমান জ্ঞানকোষে। মূলত সল্ট লেক সিটিতেই জীবন কাটানো কিমের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটতো সল্ট লেক সিটি লাইব্রেরিতে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও ১৮ বছর বয়সী কিম একটি কোম্পানির ১৬০ জনের পে-রোলের হিসাব করার চাকরি করতেন। এতে তার মাত্র কয়েক ঘন্টা লাগত, আর পুরো হিসাবটাই তিনি করতেন মুখে মুখে।
কিম বিশ্বের যেকোনো শহরের যেকোনো রাস্তার দিক নির্দেশনা দিতে পারতেন। আজকালকার গুগল ম্যাপ হয়তো এখন তা পারে, কিন্তু কিম তার মস্তিষ্কের জোরে একে টেক্কা দিতেন সেই সত্তরের দশকে। তিনি যেকোনো পরিসংখ্যান তুলে ধরতে পারতেন নিমিষের মধ্যে। অসংখ্য সাহিত্যের বই পড়েছেন, তবে তার প্রিয় লেখক ছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। অন্য সকল বইয়ের মতোই শেক্সপিয়ারের প্রতিটি নাটক তিনি লাইনের পর লাইন মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শেক্সপিয়ারের কোনো নাটক মঞ্চস্থ হলে তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত না। কারণ কোনো অভিনেতা নিজেদের লাইনে সামান্য কোনো ভুল করলেও কিম নাটকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে সেই ভুল সংশোধন করে দিতেন।
তার আরেকটি অভাবনীয় ক্ষমতা ছিল ক্যালেন্ডারের যেকোনো তারিখ মনে মনে হিসাব করতে পারা। যেকোনো বছরের যেকোনো তারিখ সপ্তাহের কোন বারে পড়েছে, তা এক দেখাতেই বলে দিতে পারতেন তিনি। নিজের এই ক্ষমতা পরখ করে দেখার জন্য আগন্তুকদেরকে গিয়ে গিয়ে কিম তাদের জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করতেন এবং সেটা কোন বার তা নির্ভুলভাবে বলে তাক লাগিয়ে দিতেন। এমনকি ঐ দিনে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীও বলে দিতেন।
তবে জীবনটা খুব মধুর ছিল না কিম পিকের জন্য। মস্তিষ্কের এই অস্বাভাবিকতার কারণে তিনি হাঁটতে শেখেন চার বছর বয়সে, তা-ও আবার সোজাসুজি না, পাশাপাশি। মাথার অসাধারণ মগজটি তার মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করেছে। ঘরের বাতির সুইচটা চালানোর বুদ্ধি ছিল না তার। নিজের শার্টের বোতামটাও নিজে লাগাতে পারতেন না। ক্ষতিগ্রস্থ সেরিবেলামের কারণেই এ ধরনের বিভিন্ন মটর স্কিলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতেন। সাইকোলজিক্যাল টেস্টে তার আইকিউ ছিল মাত্র ৮৭, যা বয়সের তুলনায় অনেক কম। এ কারণে গণিত, বিজ্ঞান কিংবা যুক্তিবিদ্যায় কখনোই মাথা খাটাতে পারেননি।
শুরুতে কিম পিককে অটিজমে আক্রান্ত মনে করা হলেও পরে বোঝা যায়, তিনি আসলে এফজি সিনড্রোমে আক্রান্ত। মগজের হেমিস্ফেয়ার বিচ্ছিন্ন থাকার এই রোগে আক্রান্ত অন্যান্যদের তুলনায় কিম ছিলেন কিছুটা আলাদা। নইলে আশেপাশে আরো এরকম অনেক ব্রেইনিয়াককেই খুঁজে পাওয়া যেত। তার মগজের মধ্যে ভিন্ন ধরনের যোগসূত্র সৃষ্টি হবার কারণেই তিনি অতিমানবীয় এসব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শিশুবয়সে কিমকে মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তারেরা। কিন্তু কিমের মা এবং বাবা দুজনেই তাতে অসম্মতি জানান।
১৯৮৪ সালে টেক্সাসের আরলিংটনে রেইনম্যান মুভির লেখক ব্যারি মোরোর সাথে কিমের দেখা হয়। তবে মুভিতে রেমন্ড ব্যাবিটকে অটিস্টিক দেখানো হয়। ডাস্টিন হফম্যান তার চরিত্রের গভীরে ঢোকার জন্য মেথড অ্যাক্টিংয়ের অংশ হিসাবে কিম পিকের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করেন। মুভির একটি বিখ্যাত দৃশ্যে ছোট ভাইয়ের কথায় ক্যাসিনোতে গিয়ে রেমন্ডকে কার্ড গুনতে দেখা গেলেও বাস্তবে কিম কখনো এমন কিছু করেননি। তবে এরকম কিছু করার ক্ষমতা কিমের ঠিকই ছিল, এমনকি মুভির লেখকেরা একবার তাকে এ কাজ করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু অনৈতিক কাজ বলে কিম তাদেরকে না করে দেন।
মুভিটি মুক্তির পরে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা চিত্রনাট্যসহ চারটি অস্কার জিতে নেয়। সেরা অভিনেতার অস্কার পাবার পরে ডাস্টিন হফম্যান তার স্পিচে কিম পিকের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। ফলে কিম পিকের নাম ছড়িয়ে যায় দেশব্যাপী। তাকে বিভিন্ন টিভি শো-সহ বেশ কয়েক জায়গায় সাক্ষাৎকারের জন্যও ডাকা হয়। এসব জায়গায় দেখানোর জন্য ব্যারি মোরো তার অস্কারের মূর্তিটা কিম পিকের সাথে দিয়ে দেন। বিভিন্ন জায়গায় যাবার সময়ে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন বাবা ফ্র্যান পিক।
ব্রেইনম্যান, ইনসাইড দ্য রেইনম্যান, মেডিকেল ইনক্রেডিবল, হিউম্যান কম্পিউটার সহ ডিসকভারি চ্যানেলের বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে তাকে ঘিরে। এছাড়াও রিপ্লি’স বিলিভ ইট অর নট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের ডকুমেন্টারি ‘অ্যাক্সিডেন্টাল জিনিয়াস’, বিবিসির ডকুমেন্টারি ‘দ্য বয় উইথ দ্য ইনক্রেডিবল ব্রেইন’ এরকম অনেক কিছু দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
কিমের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তার বাবা ফ্র্যান পিক। মূলত সল্ট লেক সিটিতেই বসবাস করে যাওয়া কিমের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে সল্ট লেক সিটি লাইব্রেরিতে। ফ্র্যান পিক নিজেকে একজন সফল বিজনেস এক্সিকিউটিভ ছিলেন। কিন্তু কিমের বয়স যখন ৩০ বছর, তখন ফ্র্যান নিজেকে কিমের ফুলটাইম কেয়ারটেকার হিসেবে নিযুক্ত করেন। রেইন ম্যানের সাফল্যের পরে ব্যারি মোরো কিমকে পুরো বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে উৎসাহিত করেন ফ্র্যানকে।
ফ্র্যান আর কিম পিক বিভিন্ন স্কুল, প্রফেশনাল কনফারেন্স, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রিটায়ারমেন্ট হোমে পর্যন্ত বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এভাবে অগণিত মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। ফ্র্যান পিক কিমকে নিয়ে দুটি বই লিখেছেন- দ্য রিয়েল রেইন ম্যান এবং দ্য লাইফ অ্যান্ড মেসেজ অফ দ্য রিয়েল রেইন ম্যান: অ্যা জার্নি অফ অ্যা মেগা স্যাভ্যান্ট। এছাড়াও বাবা-ছেলে মিলে সেলিব্রেটিং ডাইভার্সিটি নামে একটি ভিডিও তৈরি করেছেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তারা দুজন লাখো মানুষের সাথে দেখা করেছেন, চ্যারিটির জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তুলেছেন। একসাথে পাড়ি দিয়েছেন ৩ মিলিয়ন মাইল।
২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন কিম পিক। এর পাঁচ বছর পর, ২০১৪ সালে ৫ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে ফ্র্যান পিক মৃত্যুবরণ করেন। ব্যারি মোরো তার অস্কারের মূর্তিটা পাকাপাকিভাবে সল্ট লেক সিটিকে দিয়ে দেন। অস্কার জিতে পাওয়া অর্থ দিয়ে কিম পিকের স্মরণে চালু করেন পিক অ্যাওয়ার্ড। যেসকল শিল্পী এবং মিডিয়াকর্মী তাদের কাজ দিয়ে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে অক্ষম মানুষদের কাজ দিয়ে সমাজে পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, উতাহ ফিল্ম সেন্টারের পক্ষ থেকে তাদেরকে এই অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। কিম প্রতিটি অনুষ্ঠান যে কথাটি বলে শেষ করতেন, সেই একই কথা তার কবরের ফলকেও লেখা আছে,
Learn to recognize differences in others and treat them like you would want them to treat you. It will make this a better world to live in. Care and share and do your best. You don’t have to be handicapped to be different—everybody is.
Feature image: Pinterest