অস্ট্রিয়ার গোড়াপত্তন ঘটে ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। ১২৭৬ সালে হাব্সবুর্গ রাজবংশের রাজা প্রথম রুডলফ দেশটির সিংহাসনে বসেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটলে ১৯১৯ সালে অস্ট্রিয়া প্রজাতন্ত্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলারের নাৎসি বাহিনী অস্ট্রিয়া অধিকার করে নেয়। তখন অস্ট্রিয়াতে বসবাসকারী ইহুদীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। নির্বিচারে ইহুদীদের হত্যা করা হয়। ১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের পর মিত্রশক্তি অস্ট্রিয়াকে চারভাগে বিভক্ত করে। নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর ১৯৫৫ সালের ২৫ মে অস্ট্রিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
অস্ট্রিয়া দেশটিকে বুঝতে হলে এর তিনটি শহর ভিয়েনা, সালসবার্গ এবং ইন্সব্রুক দেখলেই একজন পর্যটক দেশটির বিশাল ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজকীয়তা, তার রোমাঞ্চকর দর্শনীয় অভিজ্ঞতা এবং রহস্যময়তায় ঘেরা নাগরিক বৈচিত্র্যময়তার স্বাদ নিতে পারেন।
ভিয়েনা
ভিয়েনা অস্ট্রিয়ার রাজধানী। ভিয়েন শহরবাসীর দেয়া শহরটির আদুরে নাম। শহরের সর্বত্র রাজকীয় উচ্ছ্বাসে মোড়া। সঙ্গীতের শহর, স্থাপত্যশৈলীর শহর এই ভিয়েনা। শহরের মধ্যে বয়ে চলেছে দুর্নিবার দানিয়ুব নদী। মোজার্ট, বেঠোফোন আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সুরের ঐকতানে সমৃদ্ধ শহর ভিয়েনা, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর অন্যতম।
ভিয়েনা বিশ্বের অন্যতম কসমোপলিটন শহর। শহরের বিভিন্ন স্থাপনা আধুনিক এবং মধ্যযুগীয় দুই স্থাপত্যেরই এক অপূর্ব মিশেলে তৈরি হয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব দেশের স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে ভিয়েনায়। এখানকার প্রাসাদ, জাদুঘর, অপেরা হাউস থেকে ক্যাথেড্রাল, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরিসহ প্রশাসনিক অফিসগুলোতেও ডিজাইন- সবখানে নান্দনিক স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
ভিয়েনা স্টেট অপেরা
অপেরা ও মিউজিক্যাল থিয়েটারের প্রাণকেন্দ্র ভিয়েনা। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিয়েনা স্টেট অপেরা। মোজার্ট তার কর্মজীবন সালসবার্গে শুরু করলেও ভিয়েনায় জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন। এই সময়েই তৈরি করেছেন তার অসামান্য সব সুর সৃষ্টি। প্রতি সন্ধ্যায় ভিয়েনা স্টেট অপেরায় অর্কেস্ট্রার আয়োজন করা হয়।
স্টেট অপেরায় কোনো অপেরা বা অর্কেস্ট্রার সাক্ষী থাকা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। এই স্টেট অপেরার স্থাপনা ডিজাইনে নিও রেনেসাঁ যুগের চেক ও জার্মান স্থাপত্যই মূলত প্রাধান্য পেয়েছে।
সেন্ট স্টিফেন ক্যাথেড্রাল
ভিয়েনার এই ক্যাথেড্রালটি রোমান ও গথিক স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। ক্যাথেড্রালের ভিতরের ফ্রেসকো পেন্টিং থেকে শুরু করে এর স্ট্রাকচারাল দর্শন সবকিছুই দেখার মতো। এর প্রাচীন নানা কালেকশন সবদিক থেকেই অনন্য।
স্কনব্রান প্যালেস
স্কনব্রান প্যালেস ভিয়েনার জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এর বিশালত্বের কোনো তুলনা নেই। কারুকার্যময় প্যালেসের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক পরিখা, সাথে বিশাল উদ্যান। উদ্যানের মধ্যে শ্বেত পাথরের মার্বেলে তৈরি অসংখ্য রোমান ভাস্কর্য। প্যালেসের ভিতরের মিউজিয়ামও কম আকর্ষণীয় নয়।
বেলভেডেয়ার
ভিয়েনার ঐতিহাসিক এক বিল্ডিং কমপ্লেক্স এই বেলভেডেয়ার। এর আপার ও লোয়ার বেলভেডেয়ার নামে দুটি প্রাসাদ রয়েছে। এই প্যালেসগুলোর নির্মাণে ফরাসি স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানটিও বেশ সুন্দর। উদ্যানের মাঝে স্থাপিত পানির ফোয়ারার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক অপূর্ব রোমান ভাস্কর্য।
ভোকস থিয়েটার ও মিউজিয়াম কোয়ার্টার
একদিকে ভোকস থিয়েটার এবং অন্যদিকে রয়েছে মিউজিয়াম কোয়ার্টার। এই মিউজিয়াম চত্বরে শিল্পকলা থেকে সাহিত্য, ন্যাচারাল সায়েন্স থেকে শুরু করে টেকনোলজি সব ধরনের মিউজিয়াম রয়েছে। এখানে মর্ডান ও কনটেম্পোরারি আর্টের মিউজিয়াম আর তার নান্দনিক সব স্থাপত্য সত্যিই অতুলনীয়।
এছাড়া ভিয়েনার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ঐতিহাসিক সেইন্ট পিটার্স চার্চ, ভিয়েনার পুরাতন চিড়িয়াখানা, ভিয়েনা সিটি হল, ভিয়েনা ফাইন আর্ট মিউজিয়াম, ন্যাশনাল থিয়েটার, অস্ট্রিয়ান ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম অন্যতম।
ইন্সব্রুক
এই শহরের মাটিতে যেন ম্যাজিক আছে। একবার পা দিলেই মন যেন এক অদ্ভুত ভালো লাগায় পর্যটকের মন আবিষ্ট হয়ে থাকে। চারদিকে পুরোপুরি পাহাড় দিয়ে ঘেরা আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলে এক অদ্ভুত সুন্দর শহর ইন্সব্রুক। পুরো শহরটি হেঁটে দেখতে মাত্র দুদিন সময় লাগে। যেখানেই চোখ যায় না কেন, কিছু না কিছু দেখার মতো দৃশ্য রয়েছে। ইন্সব্রুকে বেশ কয়েকটি হিলটপ রয়েছে দেখার মতো। সবকটি জায়গা থেকে এই শহরকে সুন্দরভাবে আবিষ্কার করা যায়।
বার্জিসেল
ইন্সব্রুকের দক্ষিণে অবস্থিত বার্জিসেল জায়গাটি বিভিন্ন ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বিখ্যাত। ১৯৬৪ এবং ১৯৭৬ এ দুবার এখানে উইন্টার অলিম্পিকস আয়োজিত হয়েছে। বার্জিসেলের স্টেডিয়ামটি দেখার মতো।
তিরোলিয়ান স্টেট ও ফোক আর্ট মিউজিয়াম
বার্জিসেল থেকে একটু নিচের দিকে পাহাড়ের উপত্যকায় খুব সুন্দর করে সাজানো তিরোলিয়ান স্টেট মিউজিয়াম। মধ্যযুগীয় ইউরোপের যুদ্ধে ইতিহাস সমৃদ্ধ এখানকার মিউজিয়াম। এখানে সেসময়ের নানা অস্ত্র এখানকার প্রধান আকর্ষণ। তিরোলের ধাতুর কাজ, হাতের কাজ, ট্র্যাডিশনাল কস্টিউম এবং সেখানকার শিল্প আরো নির্দিষ্টভাবে দেখতে গেলে দেখা যেতে পারে তিরোলিয়ান ফোক আর্ট মিউজিয়ামটিও। এছাড়াও এখানে রয়েছে বিখ্যাত ক্রিস্টালের শো রুম, সারোভস্কি মিউজিয়াম ও আলপাইন ক্লাব মিউজিয়াম।
এছাড়া ইন্সব্রুক শহরের আর যেসব স্থানগুলো পর্যটকদের মন কেড়ে নেয় তাদের মধ্যে অ্যামব্রাস ক্যাসেল, হফবার্গ প্যালেস, আল্পাইন জু, ত্রিরোল প্যানেরামা, হফক্রিচ কোর্ট চার্চ প্রভৃতি অন্যতম।
সালসবার্গ
মোৎজার্টের জন্মস্থান এই সালসবার্গ। নিঃসন্দেহে সালসবার্গ রোমান্টিক, রহস্যময় এবং সঙ্গীতের শহর। এই তিনটে জিনিসের সাথে যুক্ত রয়েছে একটি দুর্গ, ফেটসুং হোহেনসালসবার্গ, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত দুর্গগুলোর মধ্যে একটি। সালসবার্গ ভ্রমণ শুরু হোক এই মধ্যযুগীয় দুর্গ দিয়েই।
হোহেনসালসবার্গ ক্যাসেল
ফেটসুংবার্গ শহরের সবচেয়ে উচ্চতম স্থানে অবস্থিত এই দুর্গ। ষোড়শ শতকে তৈরি স্থাপত্যটি ডোমের মতো আকৃতির, যা সে সময়ের পরিচয় বহন করে। এই দুর্গ থেকে সালসবার্গ শহরটি সম্পূর্ণভাবে দেখা যায়। এর অভ্যন্তর খুবই সুন্দর। পুরনো সংরক্ষিত প্রাসাদের মতোই ফার্নিশড, কাঠের ওপর সোনার কারুকার্য। দুর্গের মধ্যে রয়েছে সালসবার্গ বল, গোল্ডেন হল, চ্যাপেল অফ আর্চবিশপ, গোল্ডেন চেম্বার ও বেড চেম্বার। ক্যাসেলের পাউডার টাওয়ারের মধ্যে একটি বিশালাকার অর্গ্যান রাখা আছে, যাতে প্রায় ২০০টি পাইপ রয়েছে।
এটাই সালসবার্গ বল, পাম সানডে থেকে (ইস্টারের আগের রবিবার) ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন ৭টা, ১১টা এবং সন্ধ্যা ৬টায় এটা বাজে। প্রতি সন্ধ্যায় এই ক্যাসেলে মোজার্ট অর্কেস্ট্রার আয়োজন করা হয়। শিল্পীরা মোজার্টের বিখ্যাত সব সিম্ফনি বাজান। এখান থেকে পায়ে হেঁটে এই শহরের সেন্ট্রাল এরিয়া ঘুরে ফেলা যায়। অলিগলির মধ্যে পুরনো ইউরোপীয় স্থাপত্যের মার্কেট, রেস্তোরাঁ- সব মিলিয়ে এলাকাটি বেশ জমজমাট।
মিরাবেল প্যালেস
এই প্রাসাদটি আঠোরো শতকের তৈরি। প্রাসাদটি মধ্যযুগের ইতালিয়ান এবং ফরাসি স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। প্রাসাদের সামনে রয়েছে ডোয়ার্ফ গার্ডেন নামের এক দারুন সু্ন্দর বাগান। প্রাসাদের ভিতর এবং বাইরে সাদা ইতালিয়ান মার্বেলের ভাস্কর্য রোমান ভাস্কর্যের আদলে তৈরি।
মোজার্ট হাউস
দুটো বাড়ি। প্রথম বাড়িটি ছিল মার্কেটপ্লাটজে, যেখানে জমজমাট সংসার ছিল আমেদিউসের বাবা লেওপোল মোৎজার্টের। কিন্তু একসময়ে বাড়িটা ছোট হয়ে পড়ায় তারা হানিবলপ্লাটজে চলে যান। দ্বিতীয় বাড়িটি মোজার্টের নিজের, যেখানে মোজার্ট মিউজিয়ামটি রয়েছে। কিন্তু মার্কেটপ্লাটজের বাড়িটি এখন দর্শনীয় ট্যুরিস্ট স্পট। মোজার্ট মিউজিয়ামটিও দেখার মতো। এখানে মোজার্টের পারিবারিক সংগ্রহশালা রয়েছ। তার কর্মজীবন, সেই সাথে তার সমসাময়িক শিল্পীদের নানা তথ্য জানা যাবে মিউজিয়ামটিতে।
আন্টারসবার্গ
পাহাড় এবং স্থাপত্যের এক অদ্ভুত মিশেলে তৈরি আন্টারসবার্গ। শহরের একপ্রান্ত থেকে কেবল কারে চড়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় আল্পসের কোলে। চারদিকে সবুজ উপত্যকা। আর তার মধ্যে ছবির মতো প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য ভ্রমণার্থীদের মুগ্ধ করে।
এছাড়া সালসবার্গ শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রেসিড্যান্স স্কোয়ার, সালসবার্জার ডোম, ওল্ড টাইন অফ সালসবার্গ, জেল এম সী, সালসবার্গ ক্যাথেড্রাল, সালসবার্গ ফ্যাস্টিভ্যাল থিয়েটার, কেল্টিক মিউজিয়াম, হেলব্রান প্যালেস, সালসবার্গ ক্যাথেড্রাল, সেন্ট পিটার্স অ্যাবে সহ আরো কত কী! প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে আয়োজিত হয় সালসবার্গ ফেস্টিভ্যাল। তা দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে এখানে।
ফিচার ইমেজ- pinterest.com