Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সালমা খাতুন: আঙিনার মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক শিরোপার অধিনায়ক

ছোট্ট একটা মাঠ। বাড়ির আঙিনায়। আকাশে কড়া রোদ প্রতি মুহূর্তে চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে সেদিকে তাকানোই দায়। কিন্তু সেসবে পাত্তা নেই মাঠের মাঝে উইকেটে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানের। চারপাশ থেকে সতর্ক ফিল্ডাররা ঘিরে ধরেছে। পাড়ার সবচেয়ে জোরে বল করতে পারা বোলারটা তার সামনে। বল হলো, ‘এ আর এমন কি’ ভঙ্গিতে ব্যাটও চালিয়ে দিলেন ব্যাটসম্যান। চার হলো।

পরের লাইনটাতে গল্পের মতো জয় মেলেনি। সে খবরও জানা নেই। কিন্তু যে ব্যাটসম্যানকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তাকে দেখে সবাই ভ্রু কুচকাচ্ছিলো। সেটা হবেই না বা কেন? এই বাংলার এক গ্রামের মাঠে এক তরুণী নিজের ওড়না পেঁচিয়ে খালি পায়ে থ্রি-পিস পরে ব্যাট করছেন। এটা দেখা তো স্বয়ং ভিনগ্রহের প্রাণী দেখার মতোই ব্যাপার-স্যাপার!

ব্যাটসম্যান সালমা খাতুন; Image Source: ICC

অবশ্য এসবে ওই ব্যাটসম্যান নিজেও পাত্তা দেননি। বরং আত্মবিশ্বাস নিয়েছেন। তাতে কী হয়েছে? তিনি হয়েছেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের কাণ্ডারি। তিনি দেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার যিনি কিনা বিশ্বজুড়ে সেরা অলরাউন্ডার হতে পেরেছেন। তিনি সালমা খাতুন। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের গর্বিত অধিনায়ক। মিডল অর্ডারে যার নির্ভার ব্যাটিং আর ডানহাতি অফস্পিন অনেক ম্যাচেই বাংলাদেশকে টেনে তুলেছে।

১.

ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন সালমা খাতুন। তারপর আর পড়াশোনাই করা হয়নি তার। ক্রিকেট খেলাটা তারপর শুরু। খুলনার মিলকী দেয়াড়া গ্রামে ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিনে জন্ম তার। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট।

বাবা-মায়ের নিষেধ ছিল অনেক। কিন্তু একেবারে যে উৎসাহ দেননি তা-ও নয়। সেসব অল্প অল্প উৎসাহই এগিয়ে নিয়েছে সালমাকে। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে প্রতিনিয়ত এগিয়েছেন একটু একটু করে। গ্রামে তো আর মেয়েদের ক্রিকেট সেভাবে ছিল না। তাই খেলতেন ছেলেদের সঙ্গে। পুরো ১১ জনের দলে সালমা কেবল নারী। তবে পুরুষদের সঙ্গে তার পারফরম্যান্সকে আলাদা করার কোনো উপায় ছিল না। টক্কর দিতেন সমানে সমানে।

অন্যান্য দেশের অধিনায়কদের সাথে আমাদের সালমা খাতুন; Image Source: ICC

একটি মেয়ে ক্রিকেট খেলছে, তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হতো। বাবা-মায়ের কাছেও অভিযোগ দিতো। কিন্তু লাভ হয়নি। সালমা মন খারাপ করতেন না একটুও। মামাদের পাশে পেয়েছিলেন। সেটা তার স্বপ্নের পথে অনেকটা পাথেয় হয়েছিলো।

সালমার ভাষায়, “মন খারাপ করতাম না আমি। অনেকে অনেক খারাপ কথা বলতো। মনে আছে, নারকেল চওড়া ডগাকে ব্যাট বানিয়ে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম। সেসব দিনের কথা খুব মনে হয়। যারা খারাপ কথা বলে, তারা আজ প্রশংসা করে। উৎসাহ দেয়।”

সালমার এমন সফলতা দেখে এখন তার কাছেই অনেকে পরামর্শ নিতে আসে। অর্থাৎ, নিন্দাকে প্রয়োজনে পরিণত করতে পেরেছেন সালমা। আজ তিনিই দেশের নারী ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তি। তার দেখানো পথেই হাঁটে দলের বাকি ক্রিকেটাররা। শ্রদ্ধা করে তাকে।

২.

কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলুর হাতে গড়া ক্রিকেটার সালমা খাতুন। তার হাতেই পেয়েছিলেন প্রথম ব্যাটটিও। এছাড়া এহসানুল হককেও পাশে পেয়েছেন পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়ে।

লাল-সবুজ জার্সিতে সালমা খাতুনের অভিষেক করেন ২০০৮ সালে। তখনও বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়নি। সে বছরই অধিনায়ক হন তিনি। তার নেতৃত্বেই ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। পরে একাধিকবার অধিনায়ক হয়েছেন। এখনও তিনি দলের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩১ ওয়ানডে ও ৪০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। ব্যাট হাতে ওয়ানডেতে রান করেছেন ৩৫৮, সর্বোচ্চ রানের ইনিংস অপরাজিত ৭৫। একটিই হাফ সেঞ্চুরি আছে তার। টি-টোয়েন্টিতে রয়েছে ৪৬৮ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪৯ রানের ইনিংস রয়েছে।

অফস্পিনে ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৩২ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ৩৬ উইকেট।

এই সালমার হাত ধরেই নারী দল দেশের প্রথম শিরোপা জিতেছে। ক’দিন আগে মালয়েশিয়ায় নারী টি-টোয়েণ্টি এশিয়া কাপে পাকিস্তান ও ভারতের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে শিরোপা জেতে সালমার দল। শেষ ১ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২ রান জাহানারা আলমের ব্যাটে এলেও অপরপ্রান্তে ছিলেন এই সালমা।

কোচ-ম্যানেজারের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে সালমা; Image Source: Daily Star

জয় নিশ্চিত হওয়ার পর খুব কেঁদেছিলেন সালমা। মাঝমাঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল দলের বাকি সদস্যরা। এই কান্না সফলতার, অবহেলার জবাবের। হয়তো এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “কত খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। এমন একটা শিরোপার জন্যই হয়তো খেলেছি এতদিন।”

জাতীয় দলের পাশাপাশি ক্লাব ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ তিনি। খেলে যাচ্ছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। একবার এ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমি শুরু থেকেই মোহামেডানে খেলি। সেখানেই খেলতে চাই।”

এশিয়া কাপ অর্জনের দিক থেকে সবার উপরে থাকলেও ২০১২ সালে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭ উইকেটে পাওয়া জয়ের সেই ম্যাচও মনে রাখবেন সালমা। শুধু জয়ের জন্যই নয়। সেবারই প্রথম টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে অধিনায়কত্ব পান তিনি।

৩.

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতা নিয়ে যখন চারিদিক উত্তপ্ত, তখন এসবে গা ভাসাননি সালমা। দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার হয়েও তিনি হেঁটেছেন শান্তির পথে। বলা যায়, ক্রিকেটের পথে। সেবার তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি বেতন নিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমার ক্রিকেট খেলাটা ভালোভাবে হবে না।”

সালমা মাথা না ঘামালেও, তাদের সফলতার কারণেই দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মাথা ঘামাচ্ছে। অবশেষে তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

সালমার মতো যারা গ্রাম থেকে ক্রিকেট খেলে এসেছেন, তারা জানেন পথটা কত বন্ধুর। এই জায়গায় সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি হলো পরিশ্রম। তিনি নিজেও টের পান সব সমস্যার কথা। তাই চিন্তা করেন কিভাবে সবকিছু পরিবর্তন করা যাবে। কী করলে নারী ক্রিকেটকে গুরুত্বের চোখে দেখা হবে।

সবার সামনে সালমা খাতুন। এই অর্জনের মুকুট তাকেই মানায়; Image Source: BCB

সালমা বলেছেন, “সমস্যাগুলো দূর করতে হলে মেয়েদের মন থেকে শক্ত হতে হবে। নারী ক্রিকেটকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। আমি বরাবরই বলি, নারী ক্রিকেটের জন্য আলাদা জায়গা, মাঠ, প্র্যাকটিসের সুযোগ ইত্যাদি দরকার। এসব ব্যাপারে গুরুত্ব প্রয়োজন। কতৃ‌র্পক্ষ গুরুত্ব দিলে ধীরে ধীরে মানুষও গুরুত্ব দেবে। এভাবে সমাজ-পরিবার নারী ক্রিকেটকে গুরুত্বের চোখে দেখবে। তখন আর এসব সমস্যা হবে না।”

নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু ক্রিকেটে আসার পর টের পান, এটার কোনো বিকল্প নেই। তাই ভবিষ্যৎ নারী ক্রিকেটারদের পড়াশোনায় জোর দেওয়ার পক্ষে তিনি।

দেশের মধ্যে সালমার প্রিয় খেলোয়াড় মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান। নারীদের মধ্যে শুকতারা, পান্না, জাহানারা আলম ও পিংকি। এমনকি নিজের খেলাটাও তার পছন্দ।

বিদেশে নারী ক্রিকেটার পছন্দ ঝুলন গোস্বামীকে (ভারত)। ছেলেদের মধ্যে সাঈদ আনোয়ার (পাকিস্তান), শচীন টেন্ডুলকার (ভারত) ও ক্রিস গেইল (উইন্ডিজ)।

খুব কষ্ট করে ক্রিকেটার হতে পেরেছেন সালমা। সেই কষ্টের পথ যেন সবার না হয়, সে চেষ্টা করতে চান তিনি। দেশের সেরা এই নারী ক্রিকেটারের ইচ্ছা, অবসর নেওয়ার পর কোচ হওয়া। অবশ্যই স্বপ্ন জাতীয় দলের কোচ হওয়া। কিন্তু সেটার আগে তৃণমূল ক্রিকেটের কোচ হিসেবেই কাজ শুরু করতে চান। তাহলে অবসর? সেসব নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ভাবনা নেই তার।

আপাতত চোখ আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সিরিজটির দিকেই।  

ফিচার ইমেজ- Swisscontact

Related Articles