বলা হয়, ক্রিকেট টি-টুয়েন্টি খেলাটিই কেমন, তা বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। অথচ বিশ্ব টি-টোয়েন্টির প্রথম আসরের প্রথম ম্যাচেই দলটি বাজিমাৎ করেছিল গেইল-স্যাময়েলস-ব্রাভোর উইন্ডিজকে হারিয়ে। বলা হচ্ছিল, ক্রিকেটের এই নবতর সংস্করণ আসলে বাংলাদেশের মতো দলগুলোর জন্যেই। ওডিআই বা টেস্টের মতো পরিকল্পনা প্রয়োজন নেই এখানে, মার-মার কাট-কাট ব্যাপার। ‘যদি লাইগ্যা যায়’ ধরনের সংস্করণে স্বাভাবিকভাবেই দশটার মধ্যে দুটো লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাছে ‘বিশ্ব টি-টোয়েন্টি’ এমনই দুর্বোধ্য হয়ে উঠল যে সেই প্রথম আসরের প্রথম ম্যাচটির পর মূল আসরে আর একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। উলটো হারতে হয়েছে নবাগত আফগানিস্তানের কাছেও।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে অন্য নামে বলা হয় পাওয়ার ক্রিকেট – পেশিশক্তির প্রদর্শনী। হ্যাঁ, এখানেও দেখা মেলে পেলব কবজির আলতো মোচড়ের অলস সৌন্দর্য্য। আরো দেখা যায়, কমনীয়তার চূড়ান্ত রূপ – দৃষ্টিনন্দন কাভার ড্রাইভ। নান্দনিকতা ও শিল্প দেখা মেলে ঢের। তবে দিনশেষে পার্থক্য গড়ে দেয় ঐ মাসল পাওয়ারটাই। আর যাদের পেশিশক্তি নেই, তারা ভর করেন অ্যাডাপ্ট্যাবিলিটি, ট্রান্সফরমেশন ও টাইমিংয়ে। সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানানসই করে নিতে, নিজের হিটিং অ্যাবিলিটি বাড়াতে যা যা করতে হয় করেন তা।
আর বাংলাদেশ ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টির সূচনা থেকেই ‘মিসিং ফ্যাক্টর’ হচ্ছে এই পাওয়ার ক্রিকেট।
*****
পাওয়ার ক্রিকেটটা প্রয়োজন কেন?
সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা বরং পাওয়ার হিটার নিয়ে আলোচনা করি। এই পাওয়ার হিটাররাই পাওয়ার ক্রিকেটের মূল নিয়ামক বা যোগানদাতা। শ্রীলঙ্কান অলরাউন্ডার থিসারা পেরেরা নিজেও একজন পাওয়ার হিটার। তিনি বলেন,
‘দর্শক ও সমর্থকদের কাছে পাওয়ার হিটারদের আবেদনই অন্যরকম। তারা পাওয়ার হিটারদের ভালোবাসে, পছন্দ করে। যখন এই ক্রিকেটাররা মাঠে নামেন গ্যালারী বা টিভির সামনে থেকে দর্শকরা কেবল চার-ছক্কা দেখতে চায়।’
বহু ম্যাচে শ্রীলঙ্কার উদ্ধারকর্তা হয়েছেন, নিজ ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য বহু অসম্ভব ম্যাচ বের করে এনেছেন অমানুষিক পাওয়ার হিটিংয়ের জোরে। তিনশোরও অধিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অংশ নেয়ার পরও তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেট দেড়শোর নিচে নামেনি।
‘আমি সমর্থকদের কাছে অনুরোধ রাখব, তারা যেন পাওয়ার হিটারদের গড় না দেখেন, বরং স্ট্রাইকরেটের দিকে লক্ষ্য রাখেন। যেকোনো ম্যাচ যেকোনো মুহূর্তে ঘুরিয়ে দেয়ার সক্ষমতা আমরা রাখি।’
পেরেরার সঙ্গে দ্বিমত করবেন তেমন ক্রিকেটবোদ্ধা পাওয়া ভার।
চল্লিশ পেরিয়েও দারুণ দাপটে ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলে যাওয়া শহীদ আফ্রিদি হতে পারেন উপযুক্ত উদাহরণ। দুই দশকেরও অধিক সময়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রায় সময়ই হাস্যকরভাবে আউট হয়েছেন। ধুমধাড়াক্কা পিটুনির জন্য সমালোচিত হয়েছেন, নিন্দিত হয়েছেন। কিন্তু তাকে সমর্থকরা অত্যাধিক পছন্দ করত। ভালোবেসে ডাকনাম দিয়েছিল – ‘বুমবুম আফ্রিদি’। তিনিও তিনশ’রও বেশি টি-টোয়েন্টিতে দেড়শ’র অধিক স্ট্রাইকরেট রেখেছেন। এমনকি ওডিআই ক্রিকেটেও তার স্ট্রাইকরেট শতাধিক। প্রায় চারশোর মতো ম্যাচ খেলে ১১৭ স্ট্রাইকরেট ধরে রাখা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এই ‘ক্রাউড-পুলার’ আফ্রিদি যতই ‘ডাকবাবা’ নামে ট্রোল হন না কেন, অসংখ্য ম্যাচ তিনি নিজ দলকে জিতিয়েছেন অসম্ভব পাওয়ার হিটিংয়ের জোরে। খাদের কিনার থেকে দলকে তুলে নিয়েছেন জয়ের বন্দরে। বাংলাদেশ ক্রিকেটও শহীদ আফ্রিদীর অমন অমানুষিক পিটুনির শিকার হয়েছে।
শুধু শহীদ আফ্রিদি নয়, হাল আমলে নিজেকে আপাদমস্তক ভেঙেচুরে নতুন রূপে হাজির হওয়া দীনেশ কার্তিকও বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন পাওয়ার হিটিংয়ের অমানুষিক ও অবিশ্বাস্য জোর। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বহুবার পাওয়ার হিটিংয়ের পরিণতি ভোগ করলেও, এই পাওয়ার ক্রিকেটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখনো একজন পাওয়ার ক্রিকেটারের হাহাকার লক্ষণীয়।
*****
আমরা আলোচনা করছিলাম পাওয়ার ক্রিকেট প্রয়োজন কেন?
পাওয়ার হিটিংয়ের আলোচনার ফলে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেই হয়তো বুঝে যাব, কেন পাওয়ার ক্রিকেট প্রয়োজন।
‘আমার কাছে এটা সম্পূর্ণ ব্যাটিং ইমপ্যাক্টের ব্যাপার। আপনি যদি পাঁচ-ছয় বলে কুড়ি রান তুলে দিতে পারেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী শিবির অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যাবে। অথবা এরকমও হতে পারে, আপনার দল বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে, আপনি গিয়ে এলোপাতাড়ি চালিয়ে সঙ্গিন অবস্থাকে রঙিন অবস্থায় রূপান্তর করে দিলেন। আমার নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ হয়, কারণ আমি আমার দলের জন্য যেকোনো অবস্থায় এই কাজটা করার সক্ষমতা রাখি।’
বলেছিলেন ডেভিড ভিসা, যিনি একসময় খেলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে। পরে নামিবিয়ার হয়ে মাতিয়েছেন গত আসরের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি। সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তো মাতিয়ে বেড়াচ্ছেনই। বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো দু’টি দলকে হারিয়ে ডেভিড ভিসার পাওয়ার হিটিংয়ে ভর দিয়ে মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছিল নামিবিয়া।
পাওয়ার ক্রিকেটের প্রয়োজনীয়তা এখানেই। যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থায় ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য পাওয়ার ক্রিকেটের বিকল্প নেই। আর এই পাওয়ার ক্রিকেটটা সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করতে পারেন পাওয়ার হিটাররা। পাওয়ার হিটারদের কল্যাণে ক্রিকেটে ‘ফিনিশার’ কথাটি এখন হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।
*****
মাইকেল বেভান ছিলেন ‘ফিনিশার’ কথাটির সমর্থক। ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘ফিনিশার’ মানেই ছিলেন মাইকেল বেভান। আরো অনেকেই ‘ফিনিশার রোল’ প্লে করতেন, তবে বেভানের তুলনায় তা নগণ্য। ক্রিকেট মাঠে ঝড়ের গতিতে চলত বেভানের মস্তিষ্ক। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আবির্ভাবের বহু আগে বিশ্ব একাদশের হয়ে ঢাকার মাঠে তিনি খেলেছিলেন ১৩২ বলের হার না মানা ১৮৫ রানের ইনিংস। যেটাকে বহু ক্রিকেট পন্ডিত ‘ওয়ান অফ দ্য ফাইনেস্ট ওডিআই ইনিংস’ বলে রায় দিয়েছেন। বেভান টি-টোয়েন্টি পাননি, ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেটও পচাত্তরের নিচে। এই যুগে ‘ফিনিশার’ টার্মটা তাই বেভানের সঙ্গে যাবে না হয়তো বা, কিন্তু ক্রিকেটে ফিনিশার টার্মটা যোগ করেছিলেন তিনিই। পরে ব্যাটনটা মাইকেল হাসি হয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনীতে গিয়ে আরো নান্দনিক, আরো বিস্তৃত, আরো হিসেবি, আরো চমৎকার ও উপভোগ্য হয়ে ধরা দেয়।
এই টি-টোয়েন্টির সময়ে ফিনিশার বলতে আমরা বুঝি এমন একজন, যিনি খেলাটাকে রিড করবেন পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি দিয়ে। তিনি ধ্বংস করবেন, তিনি সৃষ্টি করবেন। তিনি দৃষ্টিকটুভাবে আউট হতে পারেন, পরাজিতও হবেন, কিন্তু যেদিন দাঁড়াবেন সেদিন নিস্তার নেই প্রতিপক্ষের। তিনি যতক্ষণ মঞ্চে আছেন ততক্ষণ পর্যন্ত বিরোধী শিবিরে থাকবে চাপা-আতঙ্ক। সবাই জানে তিনি মারবেন, এই মারাটাই তার শক্তিমত্তা। আবার তিনি মারতে গিয়ে মরবেনও, এটাই তার দুর্বলতা। যে ক্রিকেটার যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন, যিনি প্রতিপক্ষের মনোবল-কৌশল সমস্ত দুমড়ে-মুচড়ে দেয়ার সাহস রাখেন, যিনি যেকোনো বোলিং আক্রমণ মুহূর্তেই ‘ছেলেখেলা’ করতে পারেন, যিনি ম্যাচ বা ইনিংসটাকে গৎবাঁধা পরিণতির বদলে অবিশ্বাস্য ও চমকে দেয়া সমাপ্তির দিকে টেনে নিতে পারেন – আজকাল ফিনিশার বলতে আমরা বুঝি তাদেরকেই।
আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ড, হার্দিক পান্ডিয়া, ডেভিড মিলার, টিম ডেভিড, লিয়াম লিভিংস্টোন… আজকালকার সময়ে ‘ফিনিশার রোল’ প্লে করা স্মরণীয় সব নাম।
*****
বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রকৃতিগতভাবেই নেই পেশিবহুল ক্রিকেটার। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের যেমন প্রকৃতিদত্ত মাসল পাওয়ার থাকে বা অস্ট্রেলিয়ান ও ইংলিশ ক্রিকেটার যেমন শারীরিকভাবে শক্তিশালী হন, এমনকি পাকিস্তানিরাও যেমন শক্তিমান হয়ে থাকে – বাংলাদেশে সে সুযোগ নেই। টি-টোয়েন্টির ফিনিশার রোলে বাংলাদেশ এ যাবৎ বহু ক্রিকেটারকে দিয়েই চেষ্টা চালিয়েছে, ফল মেলেনি। সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন, সৌম্য সরকার, জিয়াউর রহমান, মোসাদ্দেক হোসাইন, নুরুল হাসান ইত্যাদি ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আফিফ হোসাইন, শামীম হোসাইন, শেখ মাহেদী হাসান, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনদের দিয়েও চেষ্টা করা হয়েছে; কেউই সেভাবে সফল হননি।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ খুব সম্ভব এই সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত ক্রিকেটার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান তার, বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘ফিনিশার’ রোল প্লে করে সবচেয়ে সফল হয়েছেন তিনি। তকমাও জুটে গিয়েছিল – দ্য সাইলেন্ট কিলার। কিন্তু ফিনিশার হিসেবে ২০১৬ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৫ বলে ২২ ও ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে ১৮ বলে ৪৩ ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স নেই। অর্থাৎ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘ফিনিশার রোল’ বলতে যে ‘কিলার ইন্সটিংক্ট’ বোঝায়, তা অনেকটাই অনুপস্থিত রিয়াদের মাঝে। ইদানিং তিনি ‘সেট’ হতে এত সময় নেন যে অনেক সময় প্রতিপক্ষ শিবিরে ‘চাপা-আতঙ্কের’ বদলে কাজ করে ‘স্বস্তিদায়ক’ অনুভূতি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কোনোকালেই ‘ভয়ের চোরা স্রোত’ বইয়ে দেয়া ‘ফিনিশার’ ছিল না। এই না থাকাকে প্রকৃতির খেয়াল বলে উড়িয়ে দেয়ারও উপায় নেই। কারণ, দীনেশ কার্তিক দেখিয়ে দিয়েছেন শারীরিক গঠন দানবাকৃতি না হলেও কীভাবে অ্যাডাপ্ট্যাবিলিটি, ট্রান্সফরম্যাশন ও টাইমিং দ্বারা ‘পিলে চমকে দেয়া’ ফিনিশার হয়ে উঠা সম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক, সাংগঠনিক ও কাঠামোগত দুর্বলতা ও চিন্তার দৈন্যতাও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ এই ‘ফিনিশার রোল’ নিয়ে কতটা আগ্রহী, কতটা গুরুত্ব অনুধাবন করছে – তাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এই পর্যায়ে আমরা দেখব প্রাতিষ্ঠানিক বা কাঠামোগত চিন্তার মাধ্যমে কীভাবে সাধারণ একজন ক্রিকেটারও পাওয়ার হিটার বা ‘ফিনিশার রোল’ প্লে করার মতো দক্ষ হয়ে উঠেন।
*****
পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্ব টি-টোয়েন্টির গত আসরের সেমিফাইনালে। ম্যাথু ওয়েড ও মার্কাস স্টোইনিস ৪০ বলে অপরাজিত ৮১ রানের জুটি গড়ে ‘মাখা ভাতে ছাই দেয়ার মতো’ পাকিস্তানের ফাইনাল স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দেন। ম্যাথু ওয়েড ওপেন করতেন বা টপ অর্ডারে খেলেছেন। টুর্নামেন্টের মাসদুয়েক আগের দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ সফরেও ওপেন করেছেন তিনি। সেই তাকে যখন ‘ফিনিশাল রোল’ দেয়া হলো, তিনি তা অ্যাডাপ্ট করে নিয়েছেন। একই ব্যাপার ব্র্যাড হজের ক্ষেত্রেও। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে টপ অর্ডারে খেললেও ক্যারিয়ার সায়াহ্নে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি রাজস্থান রয়েলস তাকে ‘ফিনিশার রোল’ প্লে করতে বললে অনায়াসে তাতে মানিয়ে নেন। জস বাটলারের ক্ষেত্রে অবশ্য ঘটেছে উল্টোটা। তিনি ফিনিশার থেকে হয়ে উঠেছেন বিধ্বংসী ওপেনার। এই যে দীনেশ কার্তিক বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হয়ে উঠেছেন সময়ের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ফিনিশার – তিনি কিন্তু ক্যারিয়ার সূচনায় ছিলেন টেস্ট ওপেনার।
ক্রিস বেঞ্জামিন তরুণ ইংলিশ ক্রিকেটার। টপ-অর্ডার উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। দ্য হান্ড্রেড-এ বার্মিংহ্যাম ফোনিক্স-এ ছিলেন লিয়াম লিভিংস্টোনের সতীর্থ। তিনি বলেন,
‘লিয়ামের সঙ্গে একটি ইন্টারেস্টিং আলাপচারিতা শেয়ার করি। সে আমাকে বলল যে, উপরের দিকে ব্যাট করাটা বিগ রিলিফ। নিঃসন্দেহে সবাই উপরেই ব্যাট করতে চায়। সময় বেশি পাওয়া যায়, রান করার সুযোগ বেশি। সেট হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু তুই যদি নিচের দিকে ব্যাটিংয়ে দক্ষ হতে পারিস, নিজেকে ভালো একজন ফিনিশার হিসেবে গড়ে তুলতে পারিস, তাহলে তোর জন্য বিশাল একটা দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। বিশ্বক্রিকেটে ফিনিশার চরিত্রে ফিট হওয়ার মতো যোগ্য ক্রিকেটারের বড্ড অভাব।’
বেঞ্জামিন মাথায় ঢুকিয়ে নেন কথাটা। নিজেকে ফিনিশার হিসেবে প্রস্তুত করছেন এখন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটও চেষ্টা করেছে চরিত্র বদলে দেয়ার। কিন্তু কাজে আসেনি তা। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, আত্ম নিবেদন ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিশ্রম ছাড়া কী-ই বা সফল হয়? কে-ই বা সফল হতে পারেন?
মিডল অর্ডার ও লেইট-মিডল অর্ডারে পাওয়ার হিটার না থাকাটা টপ অর্ডারের জন্যও অস্বস্তি ও বিষম চাপ। আধুনক সময়ের ধারাভাষ্যকার রব কী খেলোয়াড়ি জীবনে কেন্ট দলের অধিনায়ক ছিলেন, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
‘কেন্টে খেলার সময় আমাদের টীমে নীচের দিকে ব্যাট করত আজহার মাহমুদ, ড্যারেন স্টিভেন্স ও জাস্টিন কেম্প। ফলে এটা আমাদের জন্য ছিল বিশাল স্বস্তির। আমরা আরামসে নিজেদের খেলাটা খেলতে পারতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল, যেকোনো অবস্থা থেকে ওরা খেলাটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে।’
*****
ফিনিশার হতে গেলে ঝুঁকি আছে, চাপ আছে। বিভিন্ন রকম পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে হতে পারে। সেই চাপ সামাল দিতে মানসিক স্থিতিও প্রয়োজন।
‘আপনি যতটা না ম্যাচ জেতাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ হারবেন। ধারাবাহিকভাবে এই কাজটা করে যাওয়া অনেক কষ্টকর। অনেক চ্যালেঞ্জিং। অনেক সময় প্রাপ্য সম্মান ও ক্রেডিটটাও পাওয়া যায় না।’
ডেভিড মিলারের চেয়ে আর কে ভালোভাবে বুঝবেন বা বোঝাতে পারবেন ব্যাপারটা?
তবুও এই কাজ করে যেতে হয়। ডেভিড ভিসা টাইটানস ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলার সময় কোচ রব ওয়াল্টার থেকে পেয়েছিলেন জীবনের সুন্দরতম শিক্ষা।
‘দেখো, ক্রিকেট খেলাটা দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো ব্যর্থতার সমষ্টি হয়ে। তোমার মনে রাখতে হবে এটাই তোমার কাজ। এই কাজটা করে যেতে হবে, ভুলে যাও সফলতা-ব্যর্থতা। ভুলে যাও তুমি কে। মনে রাখো শুধু তোমার কাজটা। নিজেকে উজার করে দাও। ফলাফল পক্ষে আসলে ভালো, আর যদি না আসে তাহলেও তুমি নিজেকে বদলে ফেলবে না। নিজের খেলাটা, নিজের মাইন্ডসেট, নিজের প্রশিক্ষণ ও খেলার ধরন কিছুই বদলাবে না। শুধু উপভোগ করো নিজের খেলাটা।’
ডলফিনস ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ডেভিড মিলারের কোচ ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ বললেই যিনি ভেসে উঠেন দর্শকের মানসপটে। সেই বিশ্বকাপে ফিনিশিংয়ের অবিশ্বাস্য স্বরূপ উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। পরামর্শ হিসেবে ক্লুজনারের এই কথাগুলি লাল কালি দিয়ে লিখে রাখার মতো,
‘চাপ আসলে কী? চাপ বলতে কী বোঝো তুমি? যুদ্ধে গিয়েছো কখনো? তোমার আশেপাশে বুলেট ছুটে যেতে দেখেছো? মৃত্যুকে ইঞ্চিকয়েক কাছ থেকে দেখেছো কখনো? চাপ হচ্ছে সেসব। প্রতি মুহূর্তে তাড়া করছে মৃত্যুভয়। ইঞ্চির হেরফেরে, একটু এদিক-সেদিক হলেই ইহজীবনের সমাপ্তি। চাপ বলে সে সবকে। ওভারপ্রতি দশ রান তোলা চাপ? ছ্যাহ, এসব কখনোই চাপ হতে পারে না।’
*****
খেলাটা অনেক বদলে গেছে। চাপের ধরনও একেক সময় একেক রকম। যে যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে, আত্মবিশ্বাসকে বাস্তবায়নে যে যত সাহসী হবে, বিশ্বক্রিকেটের উন্মুক্ত মঞ্চ তাকে অভিবাদন জানাবে। ধোনির চেয়ে স্মার্ট, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ক্রিকেটার খুব একটা নেই। তিনি থিসারা পেরেরাকে নিঃসংকোচে বলেন,
‘কোনো আইপিএল টীম তোমাকে নেয়া মানে হচ্ছে তোমার হিটিং অ্যাবিলিটিকে গুরুত্ব দেয়া। সুতরাং কখনোই স্কোরিং শট খেলা বন্ধ করা যাবে না। খেলতে থাকো। সাহসী হও।’
একজন অধিনায়কের এমন আশ্বাস বাণীতে কোন ক্রিকেটারের ব্যাটে চার-ছক্কা হৈ হৈ করবে না?
অধিনায়কের আশ্বাস বাণীর সঙ্গে প্রয়োজন পরিকল্পনাও। পরিশ্রম, অধ্যবসায় সমস্তই দরকার। এবি ডি ভিলিয়ার্স বা হালের সূর্যকুমার যাদব হয়তো বলে-কয়ে হয় না, কিন্তু ফিনিশার বা পাওয়ার হিটার গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ যত তাড়াতাড়ি পাওয়ার ক্রিকেটের গুরুত্ব বুঝবে, পাওয়ার হিটিংয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে তত মঙ্গল। কারণ, শুধু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নয়, আজকাল ক্রিকেটের সমস্ত আঙিনাতেই কি টেস্ট কি ওডিআই টি-টোয়েন্টির প্রভাব পড়ছে। সুতরাং পাওয়ার ক্রিকেট যদি অ্যাডাপ্ট করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেট সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়বে।
এখনই-বা কী এগিয়ে আছে? দেড় দশকের ব্যর্থতার পরও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে সেভাবে প্ল্যান-প্রোগ্রাম হয়নি। তবে কি চূড়ান্ত পর্যদুস্থতা ও সবক্ষেত্রে সর্বনাশের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, নাকি ঘুরে দাঁড়াবে এবার?