আন্ডারডগদের উঠে আসা দেখতে আমরা মোটামুটি সবাই পছন্দ করি। এরা এমন সব দল, যাদের উপর আমাদের কোনো প্রত্যাশা থাকে না। কিন্তু এরা যখন বড় কোনো দলকে হারিয়ে তখন সবারই সেটা দারুণ লাগে। এই বিশ্বকাপ দেখেছে বেশ কিছু আন্ডারডগের উত্থান। গ্রুপপর্বে আন্ডারডগরাই পাল্টে দিয়েছিল অনেক সমীকরণ। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দল এমন পারফর্ম করেছে যে তাদের ইউরোপীয় ফুটবলের আভিজাত্যই হুমকির মুখে পড়েছিল। এমন কয়েকটা আন্ডারডগের মাঝে মরক্কো নিজেদের আলাদা করে ইতিহাসের পাতায় তুলে এনেছে। প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে তারা উঠেছিল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
সেমিফাইনালের পথ অ্যাটলাসের সিংহদের জন্য মোটেও মসৃণ ছিল না। পর্তুগাল ও স্পেনের মতো বড় দলগুলোর কাঁটা তাদের সরাতে হয়েছে। এবং এই যাত্রায় তারা হজম করেছিল কেবলমাত্র ১টি গোল, সেটিও ছিল আবার আত্মঘাতী। সেমিফাইনালে এসে তারা মুখোমুখি হয় বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের। এবারের বিশ্বকাপে এটিই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। কিন্তু আন্ডারডগের এবার হেরে যায় ফেভারিটদের কাছে। ২-০ গোলে জিতে ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ হিসেবে জায়গা করে নেয় ফ্রান্স।
ফ্রান্স সেমিফাইনালে নেমেছিল ৪-২-৩-১ ফরমেশনে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জেতা খেলায় যারা খেলেছিলেন তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসে কেবল ২ জনে। অসুস্থতার জন্য দলে ছিলেন না আদ্রিয়েন র্যাবিও ও দায়ো উপামেকানো। তাদের জায়গায় দলে আসেন ইউসুফ ফোফানা ও ইব্রাহিমা কোনাতে। তবে তাদের তারকাসমৃদ্ধ স্কোয়াডে এক তারকার বিকল্প আরেক তারকা থাকায় পরিবর্তন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
বিশ্বকাপে মরক্কো ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেললেও এদিন তারা নামে ৫-৪-১ ফরমেশনে। ফ্রান্সের বিপক্ষে খেলার প্রশ্ন আসলে মরক্কোর এই পরিবর্তনকে পজিটিভ হিসেবেই নেয়া যায়। তাদের আক্রমণভাগও এতে করে ডিফেন্সিভ কাজ থেকে অব্যাহতি পায়। কিন্তু প্রশ্ন আসে আবার উইনিং কম্বিনেশন ভাঙা নিয়েও। মরক্কো এই খেলায় দলে ফিরিয়ে আনে লেফট উইংব্যাক নুসাইর মাজরাউইকে। সেই সাথে ৫ জনের ডিফেন্স বানাতে দলে ঢোকায় আশরাফ দারিকে। হাফ-ফিট অধিনায়ক রোমান সাইস শেষ মুহূর্তে দলে অন্তর্ভূক্ত হন। এছাড়া তাদের দল অপরিবর্তিতই ছিল।
এই খেলায় মরক্কোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কিন্তু মনে হবে, খেলা তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল পুরো সময়টা। বলের দখল (৬২%), পাসের সংখ্যা(৫৭৫), পাসিং অ্যাক্যুরেসি (৮৬%) – সব দিক থেকেই তারা ছিল এগিয়ে। মরক্কো সত্যি তাদের সেরাটা দিয়ে খেলেছিল। পরিসখ্যান সব বলে না; কিন্তু ফ্রান্সের বিপক্ষে তারা নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পড়েছিল একরকম। পুরো বিশ্বকাপে ডিফেন্সিভ খেলে জিতে তারা হুট করেই যখন ৫ মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে, ফ্রান্সের ডিফেন্স তারা আর ভাঙতে পারেনি। উল্টো তাদের খেলাটা খেলেই ফ্রান্স আরো এক গোল আদায় করে নেয়।
মরক্কোর ৫ জনের ডিফেন্সের বিপরীতে লড়ার জন্য ফ্রান্স প্রথমে হাই-প্রেসিং খেলা শুরু করেছিল। কিন্তু ১ম গোলের পর সেভাবে আর এই কৌশলে তারা সুবিধা করতে পারছিল না। উল্টো মরক্কোর আক্রমণ বাড়ছিল। ফ্রান্সের ডিফেন্স যথাসম্ভব সব ঠেকিয়ে দেয়। এরপর তারা এই কৌশল বাদ দিয়ে মিড-ব্লক মেথডে খেলা শুরু করে। তাতে করে তাদের আক্রমণ কমার সাথে সাথে কমছিল মরক্কোর আক্রমণে ফ্রান্সের ডিফেন্স ভাঙার শঙ্কাও।
এই নতুন কৌশলে অলিভিয়ের জিরু নেমে আসেন একটু ডিপে, তার দুই পাশে থাকা দুই উইঙ্গারেরও নিচে। আর সেই দুই উইঙ্গার এমবাপে ও দেমবেলে একটু ভেতরে চেপে আসেন অনেকটা রাইট ফরোয়ার্ড ও লেফট ফরোয়ার্ডের মতো। জিরু একটু নিচে নেমে হেডে বল উইন করে দুই উইঙ্গারের জন্য স্পেস বানিয়ে দেন। দুই উইঙ্গারও বল পেলে তাদের গতিকে কাজে লাগিয়ে মরক্কোর ডিফেন্সে চাপ বাড়ায়। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার রোলে থাকা গ্রিজমানও নেমে গিয়ে ৩ জনের মিডফিল্ডের একটি লাইন তৈরি করেন। এতে করে হাওয়ায় বল না ভাসিয়ে এন-নেসিরি পর্যন্ত বল নেয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় মরোক্কোর কাছে।
ফ্রান্সের এই ট্যাকটিক্স ধরতে পেরে মরক্কোও পরিবর্তন আনে তাদের খেলায়। তারা এবার মিডফিল্ডে পাসিং ফুটবল খেলে ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টা করে। দুই মিডফিল্ডার আমরাবাত ও ওউনাহি নিজেদের ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগিয়ে দুই উইংয়ে বল সাপ্লাইয়ের চেষ্টা করেন। এজন্য তারা শুরু করে উইংব্যাক ও উইঙ্গারের সাথে ট্রায়াঙ্গল পাসিং। এতে করে তারা ফ্রান্সের দুই ফুলব্যাকের উপর চাপ বাড়িয়ে তাদের পেছনে বল নিয়ে যাওয়ার জায়গা বানানোর চেষ্টা করে।
ওউনাহি ফ্রান্সের ওই মিডফিল্ডে অবস্থান নিয়ে চেষ্টা করেন তাদের জায়গা থেকে সরানোর। কিন্তু মিডফিল্ডার তিনজনের মধ্যে গ্রিজমানও সেদিন ডিফেন্সিভ ডিউটিতে ছিলেন। ফলে তাদের পক্ষে কোনো লাইন ব্রেকিং পাস দেওয়াও সম্ভব হয় নি। ওউনাহি কোনোমতে বাঁচার জন্য উইংয়ে থাকা স্পেসে অবস্থান নিয়ে সেখানে তার সতীর্থদের জন্য ভালো পাসিং অপশন তৈরি করেন। এমনকি নিচে নেমে বল ক্যারি করে ফ্রান্সের অর্ধে নিয়ে এলেও সেখান থেকে ফাইনাল থার্ডে বল সাপ্লাই করতে পারছিলেন না ফ্রান্সের ২ লাইনের ডিফেন্সের জন্য। এক জায়গায় না এক জায়গায় বল আটকাচ্ছিলই। এর মধ্যে অবশ্য তার ২৫ গজ দূর থেকে নেয়া দুর্দান্ত একটি শট ফিরিয়ে দেন লরিস।
মরক্কোর কোচ যে শুধু একটি প্ল্যানই নিয়ে নেমেছিলেন, তা নয়। তার হাতে আরো অপশন ছিল। এই নতুন পরিকল্পনাটি ছিল ডান প্রান্তের আক্রমণ দিয়ে। হাকিম জিয়েশ ডিপে নেমে গিয়ে চলে আসেন মিডফিল্ডে। তাকে মার্ক করতে ওইখানে অনেকটুকু স্পেস দিয়ে দেয় ফ্রান্স। জিয়েশের পিছনে ছিলেন হাকিমি। তিনি এই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে উঠে আসেন লেফট মিডফিল্ডে। জিয়েশের এই ফ্রান্সের ডিফেন্সের ভিতরে ঢুকে যাওয়ায় রাইট ফ্ল্যাংক থেকে ফোকাস সরে যায় ফ্রান্সের। কিন্তু হাকিমি বল নিয়ে উপরে উঠলেও ফ্রান্সের সলিড ডিফেন্সের জন্য বক্সের ভেতরে বল দিতে পাচ্ছিলেন না।
এখানে জিয়েশ পরিচয় দেন তার ভিশন, টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটি ও প্লেমেকিংয়ের। জিয়েশ যখন বল নিয়ে এগোচ্ছিলেন, তখন তার উপর চাপ দেন ফরাসি ডিফেন্ডারেরা বল নিয়ে আর সামনে যেতে না পেরে ছেড়ে দিতে হয় বল। দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি আবার ফিরে যাবেন। কিন্তু না, তিনি সেখান থেকে বল দিচ্ছিলেন হাকিমির ফ্ল্যাংকে। এভাবেই আসলে মরক্কো তাদের সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করে।
খেলার দ্বিতীয়ার্ধে গোলের জন্য মরক্কো এবার পরিবর্তন আনে নিজেদের ফরমেশনে, তারা ফিরে যায় তাদের ৪-৩-৩ এ। এতে তারা দু’টি সুবিধা আদায় করে। তাদের ফুলব্যাক দুইজন আরো বেশি উপরে উঠতে পারেন ডিফেন্সের শেপ ধরে রেখে। এমনকি তারা আরো দূরে সরে টাচলাইনেও অপারেট করতে পারে। বল দখল হারানো মাত্র দুই সিবির সাথে একত্রে নামতেও পারে।
দুই ফুলব্যাকের এমন মুভমেন্টের ফলে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল মিডফিল্ডাররাও তাদের জায়গা ছেড়ে কিছুটা নিচে নামে। এতে মিডফিল্ডে কিছুটা জায়গা তৈরি হয় আমরাবাত ও ওউনাহির জন্য। তারা এ সময় ডিপ-লাইং প্লেমেকারের রোলে গিয়ে দুই ফুলব্যাকের সাথে কম্বিনেশন ঠিক রেখে বল নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। মিডফিল্ডে এভাবে মরক্কো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ায় ফ্রান্সে মিডফিল্ড আরো নিচে নেমে নতুন একটি লাইন তৈরি করে স্ট্রাইকার অব্দি বল নেয়া আটকায়। মরক্কো যা সুযোগ পেয়েছিল, এভাবেই পেয়েছে। এই আক্রমণ আটকানোর পুরো ক্রেডিট পাবে ফ্রান্স। নাহলে মরক্কো যে কয়টি বড় সুযোগ তৈরি করেছিল, তাতে ২-১টি গোল না হওয়া রীতিমতো হতাশার।
ফ্রান্স এই বিশ্বকাপেও এসেছিল ফেভারিটের তকমা নিয়েই। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের অধিকাংশ গল্পে ফেভারিটদের ছাল-চামড়া তুলে নিয়েছিল আন্ডারডগেরা। ফ্রান্সের তাই মরক্কো নিয়ে যথেষ্ট ভয় ছিল। তার উপর কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পায় ভাগ্যের জোর আর ইংল্যান্ডের কিছু বোকামির জন্য।
তবে মরক্কোর সাথে এদিন ছিল একদম ভিন্ন ফ্রান্স। পরিসংখ্যান যতই বলুক যে ফ্রান্স পিছিয়ে ছিল, কিন্তু খেলা তাদের আয়ত্বেই ছিল। হুটহাট তারা সুযোগ তৈরি করে নেয়, এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ওইদিন ২টি গোলও আদায় করে। তাদের আক্রমণগুলো একদম টিমওয়ার্কের মাধ্যমে হয়। যদিও তাদের প্রায় সব পজিশনেই তারকা খেলোয়াড়েরা ছিলেন, তবুও তাদের গোলগুলো হয়েছে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
প্রথমার্ধে মরক্কোর ফরমেশন দেখে ফ্রান্সের বুঝে ফেলা উচিত যে তারা উইংয়ে খুব কম সুযোগ পাবে। কিন্তু মিডফিল্ডে গ্রিজমানও থাকায় তারা যদি এদিকে ভালো ফোকাস করে, তবে গোল পাবে। মরক্কো ফ্রান্সের উইংকে বেশি বিপদজনক ভাবায় মিডফিল্ড থেকে যে এভাবে থ্রু-বল এসে লাইন ভেঙে দেবে, তা ভাবতে দেরি করে ফেলে।
এই ভুলেই ফ্রান্স পায় তাদের প্রথম গোল। মরক্কোর উইঙ্গারগুলো ডিফেন্সিভ সাপোর্ট না দিয়ে অপেক্ষায় ছিল যদি ফ্রান্স বল নিয়ে আসে তবে প্রেস করার। এই কাজের ফলে মিডফিল্ডে ৪ জনের মধ্যে গ্যাপ তৈরি হয়। ভারানে এই সুযোগে লাইন ব্রেকিং পাস দেন গ্রিজমানের কাছে। এখানে যদি বোউফল সাপোর্ট দিতেন, তবে আমরাবাত এসেই বল আটকাতে পারতেন। ভুল শুধু একজনই করেননি, করেন আরেকজনও। বলের গতি সম্পর্কে ধারণা ভুল করে এল ইয়ামিক স্লাইড করেন। কিন্তু তার আগেই বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন গ্রিজমান। গ্রিজমানের কাটব্যাক করা পাস ঠেকাতেও ব্যর্থ হয় মরক্কো। এমবাপের শট ডিফ্লেক্ট হয়ে বল যায় ফাঁকায় দাঁড়ানো থিও হার্নান্দেজের দিকে। শরীর কন্ট্রোল করতে না পারলেও মাথার উপরে থাকা বলকে ভলি করে বলের সাথে একটি কানেকশন তৈরি করতে পারেন। গোলরক্ষক বনো দ্বিধায় পড়েন যে সামনে আগাবেন না জায়গায় থাকবেন। এগিয়ে গিয়েও শট ফেরাতে ব্যার্থ হন। গোললাইনে দাঁড়ানো ডিফেন্ডারও পারেননি বল ফেরাতে। এভাবে ৫ মিনিটেই এক সুবর্ণ সুযোগে এগিয়ে যায় ফ্রান্স।
এই গোলে গ্রিজমানের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই গোল ছাড়াও গ্রিজমানকে দেখা গিয়েছে পুরো ম্যাচেই, মিডফিল্ডকে সাপোর্ট দিতে। এমবাপের কারণে গ্রিজমানের উপর থেকে স্পটলাইট না থাকলেও এই বিশ্বকাপে গ্রিজমানের পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি তার ওয়ার্করেট বাড়িয়ে ফ্রান্সের ডিফেন্সে আলাদা একটি সাপোর্ট বাড়ান। মরক্কোর সাথের খেলায় তার হিটম্যাপ দেখুন, দেখবেন যে যেখানেই বল, সেখানেই গ্রিজমান। আর গ্রিজমানের সেদিনের খেলায় যদি তাকে যদি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলি, তবে তাও সত্য। কেননা তার বেশ কয়েকটা ব্লক এবং ইন্টারসেপশন ছিল মরক্কোর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য।
যতই টিম গেম হোক এটি, কিছুটা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য থাকলে তা টিম গেমেও প্রভাব ফেলে। দুই দলই টিম গেমে সমানে সমানে খেললেও ফ্রান্স এগিয়ে ছিল এইদিকে। খেলোয়াড়দের তাৎক্ষণিক নেয়া সিদ্ধান্ত ও কাজ একটি বড় ভূমিকা রাখে ফ্রান্সের খেলায়; যে কারণে তাদের এই ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে তারা মরক্কোর ডিফেন্স ভেঙে ফেলার উপক্রম ঘটায় বেশ কয়েকবার। কীভাবে?
মরক্কো যখন ফ্রান্সকে ঠেকাতে দুই লাইনে খেলা শুরু করে, বল পাওয়ার জন্য ফ্রান্সের কমপক্ষে দুইজন খেলোয়াড় অবস্থান নিতেন এই দুই লাইনের মাঝে, যেখানে তাদের মার্ক করার কেউ থাকত না। মার্ক করতে হলে অবশ্যই শেপ ভেঙে আসতে হবে। এতে অন্য খেলোয়াড়ের জন্য জায়গা তৈরি হওয়ার শঙ্কা ছিল। প্রথমার্ধে মরক্কো এভাবে বেশ কয়েকবার আক্রমণের মুখোমুখি হয়। কিন্তু মরক্কোর ডিফেন্স ও গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় ফ্রান্স ব্যবধান বাড়াতে পারেনি।
এমন ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে কিছু খেলোয়াড়ের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। জুলস কৌন্দে একজন সেন্টারব্যাক হলেও এই বিশ্বকাপে তিনি খেলছেন রাইটব্যাকের জায়গায়। যথেষ্ট তৎপর এই সিবির রয়েছে খুব শক্তিশালী ডিফেন্সিভ স্কিল। কিন্তু বল পায়ে তিনি মোটেও ভালো নন। দেশম তাই তাকে এমন এক দায়িত্ব দেন যাতে করে তিনি ডিপেই থাকবেন ও আক্রমণে উঠবেন না। কৌন্দের উপরে খেলেন দেমবেলে। তিনি পছন্দ করেন একা কাটিয়ে উপরে উঠতে। তাই সেখানে তিনি কৌন্দের সাপোর্ট নিতে খুব একটা ইচ্ছুক নন। তাই কৌন্দেকে উপরে তেমন দরকার হয়নি। আবার দেমবেলে যখন বল হারান, তখন কৌন্দেকে আলাদা করে নিচে নামতে হয়নি বল ফেরাতে। দেম্বেলে অধিকাংশ সময় রাইট ফ্ল্যাংকে একদম লাইন ধরে ছিলেন বলের আশায়; সেখানে ৫-৪-১ ফরমেশনে খেলা মরক্কোর কেউ যেত না শেপ ভেঙে। ফলে কৌন্দে বল পেলেই তা পাঠাতে পারতেন ফাঁকায় দাঁড়ানো দেমবেলের কাছে।
আর ফ্রান্সের বামপ্রান্তে ছিলেন এমবাপে ও থিও হার্নান্দেজ; সাথে মিডফিল্ডে গ্রিজমান। অল্প জায়গায় নিজের জন্য ফাঁকা জায়গা বানাতে গ্রিজমান দারুণ পারদর্শী। এই বিশ্বকাপে তাকে দেওয়াও হয় ‘ফ্রি রোল’। ফলে যখন তার কাছে যেটা ভালো মনে হতো, সেখানে গিয়েই অবস্থান নিতেন। তাকে এইজন্য খুঁজে পেতেও সুবিধা হয় তার সতীর্থদের। এমবাপের সাথে প্রায়ই পজিশন আদান-প্রদান করেছেন আক্রমণের সময়। এমবাপে আক্রমণের সময় হয় টাচলাইনের দিকে থাকতেন, নয়ত থ্রু বল ও ক্রসের আশায় দুই সিবির মধ্যবর্তী সংকীর্ণ জায়গাটুকুতে অবস্থান নিতেন। এমবাপের গতি এক্ষেত্রে তাকে আলাদা একটি সাপোর্ট দেয়। তবে এমবাপে সেখানে একা ছিলেন না। থিও হার্নান্দেজ অনেকটা উইংব্যাকের মতো প্রায়ই উপরে উঠেছেন। তার সাথে বোঝাপড়া করে খেলায় এমবাপেও বেশ কিছু পাসের সুযোগ পেয়েছেন। ফলে ওই প্রান্তে ফরাসিদের আক্রমণ বেশি ছিল।
ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোল ছিল মরক্কোর আরেকটি ভুলের মাধ্যমে। মধ্যমাঠে বল পান শুয়ামিনি। তিনি এবার দেখান তার পাসিং সামর্থ্য। মরক্কোর খেলোয়াড়দের চাপ থাকলেও তিনি সেই সূক্ষ্ম জায়গাটুকু থেকেই বল বের করে দিতে সক্ষম হন তার সেদিনের পার্টনার ফোফানার কাছে। ফোফানা বলকে সুন্দর করে নিজের আয়ত্বে এনে বল নিয়ে চলে আসেন একদম মরক্কোর ডি-বক্সের কাছে। সেখানে তিনি পেয়ে যান এমবাপেকে। এমবাপে আগে পেছন দিকে ফিরে গিয়ে বলকে রক্ষা করেন, এরপর তাকে ধরতে মরক্কোর ডিফেন্ডার জায়গা ছেড়ে চলে আসেন। তখন লেফট উইংয়ে থাকা থুরাম নিজে জন্য পেয়ে যান একদম ফাঁকা জায়গা। সেটি খেয়াল করে এমবাপে থ্রু বল দেন তাকে, দিয়েই নিজে ঢুকে পড়েন বক্সে। থুরাম বল পেয়ে ওই খালি জায়গাটি ব্যবহারের চেষ্টাও করেননি। এর পরিবর্তে তিনি বল রিসিভ করে বক্সে লো ক্রস দেন এমবাপের কাছে। সেখানে এমবাপে নিজের পায়ের জাদু দেখিয়ে কাটান দুইজন ডিফেন্ডারকে, শটও নেন গোলমুখে। কিন্তু তা বাধাপ্রাপ্ত হয় মরক্কান এক ডিফেন্ডারের পায়ে।
তবে গোল যখন কপালের লিখন, তখন তা তো হবেই। বলে যায়, জিরুর পরিবর্তে মাঠে নামা র্যান্ডাল কোলো মুয়ানির পায়ে। প্রায় ফাঁকা গোলে শট নিয়ে ফ্রান্সকে তিনি এগিয়ে দেন ২-০ গোলে।
ফ্রান্সের এই জয়ে নিশ্চিত হয় ফাইনালে আরেক ধ্রুপদী লড়াইয়ের। সেখানে তাদের অপেক্ষায় প্রথম খেলায় হেরে ফর্মে ফেরা আর্জেন্টিনা। তবে মরক্কোর সাথে ফ্রান্স প্রমাণ করে দিয়েছে নিজেদের সক্ষমতা। যখন গোল দরকার হবে, তা যে তারা আদায় করতেই পারবে। আর এই নিয়ে টানা দু’টি খেলায় তারা ওপেন প্লে থেকে কোনো গোল খায়নি।
আর ফুটবল বিশ্বের শ্রদ্ধা অবশ্যই মরোক্কোর প্রাপ্য। তাদের উপর কোনো প্রত্যাশা ছিল না তাদের। কিন্তু যে খেলা তারা দেখিয়েছে তাতে করে আফ্রিকান দলগুলো বিশ্বকাপে আরেকটি স্লটের দাবি তারা করতেই পারে। ফ্রান্সে ম্যাচ পর্যন্ত তারা একই ধাঁচে খেলে এসেছে। কখনো টিম গেম, কখনো ব্যক্তিগত নৈপুণ্য তাদের জয়ের পথে ধরে রেখেছে। সেই সাথে একটি ইউনিট হয়ে ডিফেন্ড করে তারা ঠেকিয়ে রেখেছিল স্পেন ও পর্তুগালের আক্রমণও। রক্ষণাত্মক খেলা অনেকসময় বিরক্তিকর হলেও মরক্কোর খেলাগুলো ছিল চোখের জন্য প্রশান্তির। শুধুমাত্র ফাইনাল থার্ডে তাদের কিছু দুর্বলতা ছিল, যেটি ফ্রান্সের বিপক্ষে তাদের হারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া হিসেব করলে বিশ্বকাপটি ছিল তাদের জন্য এক স্বপ্নযাত্রা।