ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ১২তম ব্যাটসম্যান হিসাবে দশ হাজার রান পূর্ণ করতে হলে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচে ৩৩ রান প্রয়োজন ছিলো মহেন্দ্র সিং ধোনির। বেশ কিছুদিন ধরেই দশ হাজার রানের ক্লাবের দোরগোড়ায় অপেক্ষা করতে থাকা ধোনির অপেক্ষা আর দীর্ঘায়ত হয়নি। শেষ নয়টি ওয়ানডে ম্যাচে মাত্র পাঁচবার ব্যাট করার সুযোগ পাওয়া ধোনি ম্যাচের ২৮তম ওভারে ব্যাট হাতে ক্রিজে আসেন।
ভারতের ইনিংসের ৪৩তম ওভারের প্রথম বলে চার মেরে ৯,৯৯৯ রানে পৌঁছান তিনি। লিয়াম প্লাঙ্কেটের করা ঐ ওভারের দ্বিতীয় বলে থার্ড ম্যান অঞ্চলে খেলে কাঙ্ক্ষিত এক রান নিয়ে চতুর্থ ভারতীয় ব্যাটসম্যান এবং বিশ্ব ক্রিকেটের ১২তম ব্যাটসম্যান হিসাবে তিনি দশ হাজার রানের ক্লাবে যোগদান করেন।
লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচে স্বরূপে ছিলেন না ধোনি। যার ফলে এমন কীর্তি গড়ার পরেও সতীর্থদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি তিনি। প্লাঙ্কেটের বলে সিঙ্গেল নিয়ে যখন দশ হাজার ওয়ানডে রান পূর্ণ করেন, তখনও জয়ের জন্য ৪৬ বলে ১১৬ রান প্রয়োজন ছিলো ভারতের। লর্ডসে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শেষপর্যন্ত ৫৯ বলে মাত্র দুটি চারের মারে ৩৭ রান করে সাজঘরে ফেরেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
১
ভারতের সর্বজয়ী অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাটসম্যান হিসাবেও অন্যতম সেরা একজন ব্যাটসম্যান। তার ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০০৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে সাত নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই রান আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ঐ সিরিজের বাকি দুই ম্যাচেও নিজের ব্যাটিং প্রতিভা দেখাতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ১২ রান করার পর তৃতীয় ওয়ানডেতে অপরাজিত সাত রান করেন।
পরের বছর ২০০৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ছয় ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ডাক পান ধোনি। সিরিজের প্রথম ম্যাচে সাত নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে মাত্র তিন রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। যার ফলে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তার একাদশে থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।
বিশাখাপট্টনমে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে একাদশে থাকার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো টপ অর্ডারে ব্যাট করার সুযোগ পান ধোনি। সুযোগ পেয়েই নিজের জাত চেনান তিনি। তিন নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ১২৩ বলে ১৫টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ১৪৮ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন তিনি। এই ইনিংসের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তার। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের বাকি চার ম্যাচেও তিন নাম্বারে ব্যাট করছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের সিরিজের পর আবারও মিডল অর্ডার এবং লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করেন ধোনি। এরপর আবার তিন নাম্বারে ব্যাট করার সুযোগ পান ২০০৫ সালের ৩১শে অক্টোবর, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। জয়পুরে শ্রীলঙ্কার দেওয়া ২৯৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ওভারেই শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট হারায় ভারত। এরপর ব্যাট হাতে ক্রিজে আসেন ধোনি। একাই শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দেন তিনি। তার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ২৩ বল বাকি থাকতেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভারত। ধোনি ১৪৫ বলে ১৫টি চার এবং দশটি ছয়ের মারে ১৮৩ রানে অপরাজিত থাকেন। জয়ের লক্ষ্য যদি আরেকটু বেশি হতো, তাহলে হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম দ্বিশতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান হিসাবে নিজের নাম লেখাতেন তিনি।
মহেন্দ্র সিং ধোনি ২০০৫ সালে ২৭টি ওয়ানডেতে ৪৯.৭২ ব্যাটিং গড়ে ৮৯৫ রান করেছিলেন। ধারাবাহিক সাফল্য পাওয়ার কারণে ২০০৭ সালে তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঐ বছর ৩৭টি একদিনের ম্যাচে ৪৪.১২ ব্যাটিং গড়ে ১,১০৩ রান করেছিলেন তিনি। এরপরের দুই পঞ্জিকাবর্ষেও সহস্রাধিক করে রান নিজের নামের জমা করেছিলেন ধোনি। ২০০৮ সালে ৫৭.৭৩ ব্যাটিং গড়ে ১,০৯৭ রান এবং ২০০৯ সালে ৭০.৪৭ ব্যাটিং গড়ে ১,১৯৮ রান করেছিলেন তিনি।
২
মহেন্দ্র সিং ধোনি ৩২০টি ওয়ানডেতে দশটি শতক এবং ৬৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫১.৩০ ব্যাটিং গড়ে ১০,০০৪ রান করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে এর আগে ১১জন ব্যাটসম্যান দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। ধোনি একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে ৫০ এর উপর ব্যাটিং গড় নিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে দশ হাজার রান পূর্ণ করেছেন।
৩
মহেন্দ্র সিং ধোনি ২৭৩তম ইনিংসে দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। সবচেয়ে দ্রুত দশ হাজার রান পূর্ণ করা ক্রিকেটারদের তালিকায় তিনি ৫ম স্থানে আছেন। সবচেয়ে কম ইনিংসে দশ হাজার ওয়ানডে রান পূর্ণ করেছেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তিনি ২৫৯তম ইনিংসে দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন।
৪
মহেন্দ্র সিং ধোনি ছাড়া দশ হাজার রানের ক্লাবের বাকি ১১জন তাদের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় টপ অর্ডারে ব্যাট করেছেন। কিন্তু ধোনি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন পাঁচ কিংবা এর চেয়েও নিচে।
তিনি এখন পর্যন্ত ২৭৪টি ওয়ানডে ম্যাচে পাঁচ কিংবা এরচেয়ে নিচের ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করেছেন। ২৭৪ ম্যাচের মধ্যে ২২৮ ইনিংস ব্যাট করে ৪৮.৩২ ব্যাটিং গড়ে ৭,৬৮৩ রান করেছেন। একই ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান করেছেন শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তিনি ৩৫.১২ ব্যাটিং গড়ে ৬,০৪১ রান করেছিলেন।
এক থেকে চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে ধোনি ৪৫ ইনিংস ব্যাট করেছেন। যার মধ্যে তিনটি শতক এবং ১৮টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৬৪.৪৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৩২১ রান করেছেন। নিয়মিত টপ অর্ডারে ব্যাটিং করলে তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার আরও বেশি সমৃদ্ধ হতো, তা বলাই যায়।
৫
২০০৭ সালে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর ১৯৯টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই ১৯৯ ম্যাচের ১৭১ ইনিংসে ব্যাট করে ৫৩.৯২ ব্যাটিং গড়ে ৬,৬৩৩ রান করেছেন। শতক হাঁকিয়েছিলেন ছয়টি এবং অর্ধশতক ৪৭টি।
অধিনায়ক হিসাবে ওয়ানডেতে তার চেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করেছেন শুধুমাত্র রিকি পন্টিং। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক পন্টিং ২৩০টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৮,৪৯৭ রান করেছেন।
উইকেটরক্ষক এবং অধিনায়ক হিসাবে ধোনির মোট রানের কাছাকাছিও কেউ নেই। এই ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কুমার সাঙ্গাকারার মোট রান ১,৭৫৬।
লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচে মাহেন্দ্র সিং ধোনি আরও একটি রেকর্ড গড়েন। ইনিংসের ৩৬.৩ ওভারে জস বাটলারের ক্যাচ তালুবন্দী করে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে চতুর্থ উইকেটরক্ষক হিসাবে তিনশো ক্যাচ ধরার রেকর্ড গড়েন তিনি। তার আগে এই কীর্তি গড়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, কুমার সাঙ্গাকারা এবং মার্ক বাউচার।
ধোনি ৩২০টি ওয়ানডেতে ৪০৭টি ডিসমিসাল করেছেন। এরমধ্যে ৩০০টি ক্যাচ এবং ১০৭টি স্ট্যাম্পিং। সবার উপরে থাকা কুমার সাঙ্গাকারার ৪০৪ ম্যাচে ৪৮২টি ডিসমিসাল, যার মধ্যে ৩৮৩টি ক্যাচ এবং ৯৯টি স্ট্যাম্পিং।
অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ২৮৭ ম্যাচে ৪৭২টি ডিসমিসালের মধ্যে ৪১৭টি ক্যাচ এবং ৫৫টি স্ট্যাম্পিং এবং মার্ক বাউচারের ২৯৫ ম্যাচে ৪২৪টি ডিসমিসালের মধ্যে ৪০২টি ক্যাচ এবং ২২টি স্ট্যাম্পিং।
মাহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্ব গুণের পাশাপাশি লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটে অন্যতম সেরা একজন ব্যাটসম্যান হিসাবে বেশ নামডাক রয়েছে। উইকেটের পেছনেও রয়েছে তার চোখ ধাঁধানো পারফরমেন্স।
ফিচার ইমেজ- Wallpapercave.com