Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সেইদর্ফ: ৩টি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ৪টি ইউসিএল জয়ের একমাত্র কিংবদন্তি

যেকোনো ফুটবলারেরই স্বপ্ন ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জয়ের। কারো স্বপ্ন সত্য হয়, আবার কারো হয় না। ইব্রাহিমোভিচ, বুফনদের মতো অনেক কিংবদন্তিও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শিরোপার স্বাদ পাননি। কিন্তু অনেক সৌভাগ্যবান এই শিরোপা জিতেছেন একাধিকবার। এই তালিকায় রয়েছেন স্টেফানো, মালদিনি, সেইদর্ফ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসি, ইনিয়েস্তার প্রমুখ তারকা খেলোয়াড়েরা।

তবে সবার চেয়ে ডাচ কিংবদন্তি ক্ল্যারেন্স সেইদর্ফ এক ও অনন্য একটি জায়গায়, ইতিহাসে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি রেকর্ড ভিন্ন তিনটি ক্লাবের হয়ে জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, তথা ইউসিএল শিরোপা। ভিন্ন দুটি ক্লাবের হয়ে তিনটি বা চারটি ইউসিএল শিরোপাজয়ী বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় রয়েছেন। এমনকি ভিন্ন দুই ক্লাবের হয়ে ৫টি ইউসিএল জিতেছেন পর্তুগিজ তারকা রোনালদো। তার দখলে রয়েছে ইউনাইটেডের হয়ে একটি এবং রিয়ালের হয়ে জেতা চারটি শিরোপা।

কিন্তু এখনও সেইদর্ফের অনন্য কৃতিত্বে ভাগ বসাতে পারেননি কোনো খেলোয়াড়ই। সেইদর্ফের অনন্য এই রেকর্ডের স্বীকৃতি স্থান পেয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও। ডাচ এই কিংবদন্তির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের শুরুটা হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের ক্লাব আয়াক্স থেকে। এরপর জিতেছেন স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ ও ইতালির এসি মিলানের হয়ে। 

“আবেগ, স্মৃতি- ভাগ্যক্রমে, খারাপের চেয়ে বেশিই ভালো।” চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সাথে বিশেষ বন্ধনের ব্যাপারটিকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে চাওয়া সেইদর্ফের সেই সোনালি সময়ের সাফল্য নিয়েই আজকের আয়োজন। 

ডাচ কিংবদন্তি ক্ল্যারেন্স সেইদর্ফ; Image Source: skysports.com

আয়াক্স, ১৯৯৪-৯৫

একসময়ের ডাচ কলোনি সুরিনামে জন্ম নেওয়া সেইদর্ফ মাত্র ২ বছর বয়সে নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমান। সময়ের সেরা মিডফিল্ডার হয়ে ওঠার শুরুটা আয়াক্সের একাডেমি থেকেই। আয়াক্সের একাডেমিতে তার সাথে ছিলেন প্যাট্রিক ক্লাভার্ট ও এডগার ডেভিসদের মতো খেলোয়াড়েরা, যারা পরবর্তীতে আয়াক্সের সোনালী প্রজন্মের অন্যতম খেলোয়াড়ে পরিণত হন।

ড্যানি ব্লিন্ড ও ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের মতো কিংবদন্তিদের সাথে খেলা দলটিতে তরুণ প্রতিভার অভাব ছিল না। ফ্রাঙ্ক ও রোনাল্ড ভাইদ্বয়, লিটমানেন, ক্লাভার্ট, ডেভিস ও সেইদর্ফদের তরুণ দলটি পরিপক্ব হয়ে সেরা সময় পার করে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। আয়াক্সের হয়ে সেইদর্ফ মাঠে নামেন ১৯৯২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে এবং এখন পর্যন্ত তিনিই ক্লাবটির মূল দলে খেলা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়।

এত অল্প বয়সে দলে জায়গা পেয়ে শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন এই ডাচ কিংবদন্তি এবং আয়াক্সের মাঝমাঠের অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন। গতি, শারীরিক শক্তি ও সহজাত প্রতিভার দরুন সেইদর্ফ ছিলেন একজন অসাধারণ মিডফিল্ডার, মাঝমাঠের যেকোনো জায়গায় যিনি খেলতে পারতেন। 

আয়াক্সের দুর্দান্ত সেই দল; Image Source: twitter.com

ভন গালের আয়াক্স গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচেই ২-০ গোলে পরাজিত করে মালদিনি, বারেসি, বোবানদের এসি মিলানকে এবং ফাইনালেও তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইতালিয়ান এই ক্লাবটি। পুরো আসরে কোনো ম্যাচ না হেরে ফাইনালে পা রাখে আয়াক্স এবং ফাইনালের পথে সেমিফাইনালে দলটির কাছে ৫-২ গোলে পর্যুদস্ত হয় জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ।

১৯ বছরের তরুণ হিসেবে পুরো আসরে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন সেইদর্ফ এবং মাঝমাঠে তার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রুপ পর্বের মতোই ফাইনালেও আয়াক্সের সাথে পেরে ওঠেনি মিলান, তবে জয়সূচক গোলের জন্য আয়াক্সের অপেক্ষা করতে হয়েছে ম্যাচের ৮৫ মিনিট অবধি। ভিয়েনার ফাইনালে ম্যাচের ৭০ মিনিটে লিটমানেনের বদলি হিসেবে নামেন ক্লাভার্ট। ৮৫ মিনিটে এই খেলোয়াড়ই জয়সূচক একমাত্র গোলটি করে আয়াক্সকে এনে দেন স্বপ্নের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের ব্যাপারে সেইদর্ফ বলেন,

ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল জয়ের স্বপ্ন সবার থাকে এবং আমি ভাগ্যবান যে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আমি তা জিতেছি।

রিয়াল মাদ্রিদ, ১৯৯৭-৯৮

সেইদর্ফ ছিলেন প্রতিভা ও ভাগ্যের মিশেলে গড়া অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। যেখানেই খেলেছেন সেখানেই জিতেছেন এবং বড় শিরোপাই জিতেছেন। আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর তিনি পাড়ি জমান ইতালির সাম্পদোরিয়ায়। মাত্র এক মৌসুম খেলার পর তিনি যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। ইউরোপের মোট ৫টি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি এবং তিনটির হয়েই জিতেছেন ইউসিএল শিরোপা।

আয়াক্সের সেই তরুণ সেইদর্ফ রিয়ালে খেলার সময় আরও অভিজ্ঞ এবং পরিপক্ব একজন মিডফিল্ডার হয়ে ওঠেন। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের হয়ে মাঠে দারুণ ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন তিনি। দলটির সেমিফাইনালে ওঠার পিছনে তার ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। 

রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সেইদর্ফ; Image Source: marca.com

শুরুর দিকে সেইদর্ফ মাঝমাঠে প্লেমেকারের ভূমিকায় খেললেও তার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে তিনি আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার, হোল্ডিং কিংবা বক্স-টু-বক্স, এমনকি উইংয়েও খেলেছেন। পরিপূর্ণ একজন মিডফিল্ডারের সব গুণই ছিল এই কিংবদন্তির মধ্যে। ঠিক এই কারণেই তিনি তার সময়ের সেরাদের একজন ছিলেন।

রিয়ালের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমেই সাফল্য পান সেইদর্ফ। সেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। শক্তিশালী রিয়াল মাদ্রিদ অপ্রতিরোধ্য গতিতে গ্রুপ পর্ব পার করার পর কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমি ফাইনালে যথাক্রমে বিদায় করে জার্মান ক্লাব লেভারকুসেন ও ডর্টমুন্ডকে।

জুভেন্টাসের বিপক্ষে সেইদর্ফ; Image Source: sportbible.com

ফাইনালে মুখোমুখি তখন লিপ্পির জুভেন্টাস এবং হেইঙ্কেসের মাদ্রিদ। সেইদর্ফ এবার তার সাবেক সতীর্থ ডেভিসের বিপক্ষে নেমেছিলেন মাঠে। তাছাড়া জুভেন্টাসের এই দলে তখন ছিলেন পিয়েরো, জিদান, কন্তে, দেশম, ইনজাঘির কিংবদন্তি খেলোয়াড়েরা।

মিয়াতোভিচের ৬৬ মিনিটের গোলে ৩২ বছর পর আবার মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের স্বাদ পায়। সেইদর্ফ তার ক্যারিয়ারের অসাধারণ এই অর্জনের সংযোজনটা করেছিলেন তার দেশ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। সেইদর্ফের মতে, এত বছর পর রিয়ালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর সময়টা ছিল অনেকটা ঘোরের মতো।

প্রতিদিন আমরা যেখানেই যাই এবং রেস্টুরেন্টে খাই না কেন, সবাই শুধু ফাইনাল নিয়েই কথা বলে।

এসি মিলান, ২০০২-০৩ ও ২০০৬-০৭

সেইদর্ফ হয়তো সবসময় মাঠের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন না। কিন্তু কম-বেশি প্রায় সব ম্যাচেই তিনি এমন কিছু করতেন, যার জন্য আপনি তাকে মনে রাখতে বাধ্য। মাঝমাঠের যেকোনো জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা, প্রতিপক্ষকে বোঝার দক্ষতা ও কৌশলী দূরদৃষ্টি তাকে সবসময়ই এগিয়ে রেখেছে। তাছাড়া ক্ষিপ্র গতিতে পুনরায় বলের দখল নেওয়া, প্রতিপক্ষের আক্রমণ মাঝমাঠেই ভেস্তে দেওয়ায় তার দক্ষতা ছিল অসামান্য।

রিয়াল থেকে ২০০০ সালে ইন্টার মিলানে যোগ দেওয়ার দুই বছর পর ক্লাবটির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানে পাড়ি জমান সেইদর্ফ। রোসসোনেরিদের হয়ে কাটিয়েছেন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সেরা সময়। মিলানের হয়ে ১০ বছরের ক্যারিয়ারে সেইদর্ফের শিরোপার তালিকা ভীষণ ঈর্ষণীয়। এই সময়ে তিনি জিতেছেন ২টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও লিগ শিরোপা এবং ১টি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ।

সেইদর্ফ মিলানের হয়ে ৪২৩টি ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৬২টি। গোল দিয়ে তার মতো কিংবদন্তির বিচার করা যে অসম্ভব তা, তা বলা বাহুল্য। ঠিক এই কারণেই পেলের করা জীবিত ১২৫ জন ফুটবল কিংবদন্তির তালিকায় সেইদর্ফ জায়গা করে নিয়েছিলেন ২০০৪ সালেই, যদিও তখনও তিনি ফুটবল থেকে অবসরই নেননি। 

মিলান কিংবদন্তি সেইদর্ফ; Image Source: dailymail.co.uk

মিলানে যোগ দেওয়ার মৌসুমেই সেইদর্ফ তার হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে নিয়েছিলেন। এই জয়ের পথে তিনি পরাজিত করেছিলেন তার সাবেক তিন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ, আয়াক্স এবং ইন্টার মিলানকে। গ্রুপ পর্বে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হলেও কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমি ফাইনালে মিলানের প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে আয়াক্স ও ইন্টার।

ফাইনালে সেইদর্ফ আবারও মুখোমুখি হয়েছিলেন জুভেন্টাসের। কিন্তু এবারে ভাগ্য তার তেমন একটা সহায় ছিল বলা যাবে না। নির্ধারিত সময়ের পরও ইতালিয়ান ক্লাবদ্বয়ের এই ফাইনালের ফলাফল গোলশূন্য থাকলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকে। টাইব্রেকে সেইদর্ফের শট গোলরক্ষক ফিরিয়ে দিলেও সতীর্থদের নৈপুণ্যে শেষ পর্যন্ত ২-৩ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় মিলান।

সেইদর্ফ, মি. চ্যাম্পিয়ন্স লিগ; Image Source: uefa.com

সেইদর্ফের ঝুলিতে এখন ৪টি নয়, ৫টি চ্যাম্পিয়ন্স শিরোপা থাকতে পারতো, যদি না ২০০৫ সালের ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’ ফাইনালে লিভারপুলের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের কাছে মিলান হার না মানতো। তবে এই হারের প্রতিশোধ নিতে খুব বেশি সময় নেয়নি সেইদর্ফের মিলান। ২০০৭ সালের ফাইনালে লিভারপুলকে ২-১ গোলে পরাজিত করে ইস্তাম্বুলে পরাজয়ের ক্ষত কিছুটা হলেও দূর করতে পেরেছিল রোসসোনারিরা।

ফিচার ইমেজ – the18.com

Related Articles