প্রিমিয়ার লিগ এখনও মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কিন্তু মাত্র ১১ সপ্তাহের মাথায়ই লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার সিটি ম্যাচকে কেন্দ্র করে ভাবতে হচ্ছে শিরোপার কথা। কারণ, অদম্য লিভারপুলের যাত্রা কিছুটা ধীর করে দিয়ে শিরোপা লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে, যেকোনোভাবে ক্লপবাহিনীকে হারানো প্রয়োজন ম্যান সিটির।
গত মৌসুমের সেই রোমাঞ্চকর গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। মৌসুমের শেষ তিন ম্যাচ তখনও বাকি। শিরোপার দৌড়ে টিকে আছে মাত্র দুটি ক্লাব- লিভারপুল ও ম্যান সিটি। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ছিল, তাদের মধ্যে পয়েন্টের ব্যবধান আবার মাত্র ‘১’। ২৭ এপ্রিল হাডার্সফিল্ড টাউনকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে অলরেডরা অপেক্ষায় ছিল সিটির হারের। কিন্তু আগুয়েরো ঠিকই বার্নলির বিপক্ষে পয়েন্ট নিয়ে এলেন। পরের ম্যাচে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষেও জিতল লিভারপুল, তাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতেই যেন নিজেদের মাঠে লেস্টারকে হারালো সিটিজেনরা।
এরপর এলো প্রিমিয়ার লিগের শেষ সপ্তাহ। লিভারপুল ও ম্যানসিটি একই সময়ে মাঠে নামলো সেদিন। দু’দলের সহজ জয়, ফলে ম্যাচের ভাগ্য ফিরে গেল এ বছরের জানুয়ারির ৪ তারিখে। যেদিন ইতিহাদে ক্লপবাহিনীর অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল গার্দিওলার ম্যানসিটি। ফলে নিজেদের সেরা একটি মৌসুম পার করেও, মাত্র এক পয়েন্ট আর ঐ হারের জন্য লিগ শিরোপা স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়নি লিভারপুলের।
লিভারপুল
দুর্দান্ত ফর্মে আছে লিভারপুল। ইনজুরি সমস্যা থেকে ফিরে আবার দলে নিয়মিত হয়েছেন অ্যালিসন। তাদের ঈর্ষণীয় আক্রমণ-ত্রিফলাতেও কোনো সমস্যা নেই। তবে তাদের ভাবাচ্ছে জোয়েল মাতিপের ইনজুরি। রক্ষণে অবশ্যই থাকবেন ভার্জিল ভ্যান ডাইক, আর দুই ফুলব্যাক ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন। কিন্তু ধারাবাহিকতা না থাকা ও অধিক ভুলপ্রবণ দেজান লভ্রেনের থাকা মানে যেন দামি সুতোয় তৈরি চাদরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম খুঁত। আর সিটিজেনদের কোচ পেপ গার্দিওলা যে এই খুঁত ধরেই অলরেডদের জমাট ডিফেন্সকে ‘বেহুলার বাসরঘর’ করে দিতে পারেন, সেটা ক্লপও নিশ্চিতভাবে জানেন ও মানেন।
৪-৩-৩ ফর্মেশনে আক্রমণভাগের দায়িত্বে অবশ্যই থাকবেন সালাহ, মানে ও ফিরমিনো। চলতি মৌসুমে মিশরীয় ফরোয়ার্ড সালাহকে তেমন ধারাবাহিক দেখাচ্ছে না। অবশ্য বড় ম্যাচে সালাহর গোলদক্ষতা ফুটে ওঠার নজির কম। আর পেপ গার্দিওলার দলের বিপক্ষেও সালাহর গোল করার রেকর্ডও মানানসই না। প্রিমিয়ার লিগে গত বছরের দেখায় তার কোনো গোল নেই, আর সর্বশেষ গোল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। তাই সালাহ থেকে দল বেশি তাকিয়ে থাকবে ফিরমিনো ও মানের দিকে। এ মৌসুমে প্রথম থেকেই মানে আছেন দারুণ ছন্দে। অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচেও গোল পেয়েছিলেন এই সেনেগালিজ ফরোয়ার্ড।
তাদের আক্রমণ-ত্রিফলা বাদেও লিভারপুলের ট্র্যাম্পকার্ড হচ্ছে মধ্যমাঠে থাকা ফ্যাবিনহো ও তাদের ফুলব্যাক জুটি। ফ্যাবিনহো মাঝমাঠ থেকে খেলার চিত্র পাল্টে দিতে পারেন। কিন্তু তাদের ফুলব্যাক নিয়ে ক্লপের রীতিমতো উভয় সংকট। ট্রেন্ট আর্নল্ড ও রবার্টসন দু’জনই অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক। তাই ভালো দিক হলো, সিটিজেনদের ইনজুরি সমস্যা ও বেহাল রক্ষণের সামনে এরা কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। আর সমস্যা হচ্ছে, সিটিজেনদের দুই উইঙ্গার স্টার্লিং ও বার্নার্ডো সিলভাকে নিয়ে। অলরেড ফুলব্যাকদের এই অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক স্বভাবের কারণে তাদের মতো গতিময় উইঙ্গারের সামনে দুই পাশের উইং উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর মাতিপও নেই যে ফুলব্যাকদের রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ করবেন। তাই উইংজুড়ে প্রতি-আক্রমণে গোল হজম করার সম্ভাবনা বেড়ে যায় লিভারপুলের। আর এ মৌসুমের শুরু থেকেই তাদের রক্ষণ গোল হজম করা থেকে বিরত থাকতে পারছে না। কিন্তু ক্লপের হাই-প্রেসিং ফুটবলের বদৌলতে খেই হারিয়ে ফেলে অধিকাংশ প্রতিপক্ষ। তাই গোল হজম করলেও শেষ মুহূর্তে ফিরে আসার সামর্থ্য আছে বর্তমান লিভারপুলের।
ম্যানচেস্টার সিটি
লিভারপুলের যে সমস্যা প্রায় নেই বললেই চলে, ম্যানচেস্টার সিটির ক্ষেত্রে তা একদম উল্টো। দলের একাদশের অধিকাংশ খেলোয়াড় ইনজুরিতে। আগে থেকেই মাঠের বাইরে লিরয় সানে, লার্পোত, রদ্রি ও ডেভিড সিলভা। আর গত ম্যাচে যুক্ত হয়েছে গোলরক্ষক এডারসনের ইনজুরি। তাই না চাইলেও গার্দিওলাকে ভরসা করতে হবে ক্লদিও ব্রাভোর উপর। আর নিজেকে হারিয়ে ফেলা ব্রাভোর উপর আস্থা রাখার দিন যে ফুরিয়েছে, তা স্বয়ং গার্দিওলা নিজেও জানেন।
সর্বশেষ ম্যাচে সাউদাম্পটনের বিপক্ষে গার্দিওলা দল সাজিয়েছিলেন ৪-৩-৩ ছকে, যেখানে রক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ফার্নান্দিনহো ও জন স্টোনস। ইনজুরিমুক্ত ডিফেন্ডারদের ভেতর ওটামেন্ডি ও স্টোনসের কেউই তেমন ফর্মে নেই। তাই অগত্যা গার্দিওলাকে ফার্নান্দিনহোকে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলাতে হয়। ফলে মিডফিল্ডেও তার ছাপ পড়ে। কারণ, রদ্রি না থাকার কারণে মধ্যমাঠের রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থাকার মতো কেউ থাকে না। গুন্ডোগান থেকে সিলভা, কিংবা ডি ব্রুইন, কেউই রক্ষণে আগ্রহী নয়। তাই লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচের আগে এমন শাঁখের করাত ঘাড়ে নিয়েই দল সাজাতে হবে গার্দিওলাকে।
তবে একাদশ নির্বাচনের সমস্যার ভিড়েও গার্দিওলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন ডি ব্রুইন ও তার আক্রমণভাগ নিয়ে। ডি ব্রুইন এবার দারুণ ছন্দে আছেন, মাঝমাঠ থেকে গোল সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন একাই। আর ডি ব্রুইনের তৈরি করা সুযোগগুলোও হেলাফেলা করছেন না স্টার্লিং ও আগুয়েরোর মতো বিশ্বমানের ফরোয়ার্ডরা। তাই ক্লপ যদি আলাদা করে ডি ব্রুইন ও স্টার্লিংকে নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা না করে রাখেন, তবে মাঠে লিভারপুলকে ভুগতেও হতে পারে।
আর লিভারপুলের মধ্যমাঠ পায়ের কারুকাজ দিয়ে খেলে না, ভাইনালদাম থেকে ফ্যাবিনহো – সবাই একাধারে ধ্বংসাত্মক ঘরানার ফুটবলার। ভাইনালদাম যদিও বক্স-টু-বক্স খেলে থাকেন, তবে ক্লপের ট্যাকটিকসে কোনো শৈল্পিক মিডফিল্ডার নেই। প্রতিপক্ষের আক্রমণ কোনোভাবে মধ্যমাঠে শেষ করে দিতে পারলেই যথেষ্ট। তাই ক্লপের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গার্দিওলার ট্যাকটিক্সকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
লিভারপুল বনাম ম্যানসিটি : হেড টু হেড
দুই দলের সমস্যা বা প্লাস পয়েন্ট নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক, মনে রাখা প্রয়োজন, ম্যাচটি হবে অলরেডদের ঘরের মাঠে, অ্যানফিল্ডে; যেখানে ম্যানসিটি শেষ ১৫ বছর কোনো জয়ের মুখ দেখেনি। বিপরীতে, অলরেড’রা শেষ ৫০ ম্যাচে হেরেছে মাত্র ১টি বার। তাই রেকর্ড, বর্তমানে দুই দলের ফর্ম, ও দলগত অবস্থা বিচারে এই ম্যাচে লিভারপুল অবশ্যই ফেভারিট।
প্রিমিয়ার লিগে অনেক নামজাদা কোচদের আনাগোনার স্থান। মরিনহো, আর্সেন ওয়েঙ্গার, আন্তোনিও কন্তে, মরিসিও সারির মতো কোচরা কিছু মৌসুম আগেও ছিলেন বা আছেন। এক সময়ে গার্দিওলাই ছিলেন এলাকার রাজা। নিয়মিত টক্কর দেবার মতো কেউ ছিল না তার সামনে। কিন্তু ক্লপ এসে তার রাজ্যে হানা দিয়ে বসলেন। প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলই একমাত্র ক্লাব, যারা ম্যানসিটিকে নিয়মিত মনে করিয়ে দিচ্ছে, বর্তমান প্রিমিয়ার লিগ তাদের একার সাম্রাজ্য নয়।
ব্যক্তিগতভাবে ক্লপের সামনে গার্দিওলার রেকর্ড ভালো নয়। নিজেদের ১৭ বারের দেখায় ক্লপ জিতেছেন মাত্র ৮ বার। আর প্রিমিয়ার লিগে তাদের দ্বৈরথে গার্দিওলা প্রথমবার ক্লপের কাছে হেরেছিলেন। তবে প্রিমিয়ার লিগে মুখোমুখি হবার রেকর্ডে দু’দল যেন একই রেখায়। ছয়বারের দেখায় উভয় দলই দু’টি করে ম্যাচ জিতেছে, বাকিগুলো ড্র।
চলতি মৌসুমে উভয় দলের রক্ষণের অবস্থা শোচনীয়। ক্লিনশিট যেন ডুমুরের ফুল, তবে লিভারপুল সিটিজেনদের থেকে একটি গোল কম হজম করেছে। আর এ পর্যন্ত ম্যানসিটি গোল করেছে ৩৫টি, সেখানে লিভারপুল মাত্র ২৫টি।
সিটির যে দৈন্যদশা চলছে, তা আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, লাপোর্ত একাদশে না ফেরা পর্যন্ত তাদের রক্ষণ স্বরূপে ফিরবে না। তাই পেপ গার্দিওলাকে অবিশ্বাস্য কিছু করতে হলে আজকের ম্যাচেই করতে হবে। ২০০৩ সালের পর থেকে এ মাঠে তারা জেতেনি, এই পরিসংখ্যান মেনে মাঠে নামলে মৌসুম অর্ধেক পার হবার আগেই লিগ শিরোপা লিভারপুলকে উপহার দিয়ে আসবে ম্যানসিটি। আর কোনো রূপকথা রচনা করতে পারলে অলরেডদের সাথে তাদের পয়েন্ট ব্যবধান কমে নামবে চারে। ফলে বাকি মৌসুম অদম্য লিভারপুলের পাশে লড়াই চালিয়ে যাবার শক্তিটুকু অন্তত থাকবে সিটিজেনদের।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/