তিনি একজন গৃহবধু। বাস করেন রাজধানীর একটি অভিজাত অাবাসিক এলাকায়। বীমা কোম্পানিতে চাকুরীরত স্বামী অার চার বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। কিছুদিন অাগপর্যন্তও এই সুখ বিরাজ করছিল।
মাস দুয়েক অাগের এক রাতের কথা। তার স্বামী অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে বিছানায় অঘোর নিদ্রায় মগ্ন। এমন সময় বাইরে খট খট শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে তিনি মূল দরজায় কাছে যেতে লাগলেন। সেখানে পৌঁছুতেই টের পেলেন কেউ তার দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। তিনি অাতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। বাড়িতে নির্ঘাত ডাকাত পড়েছে। দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে খিল দিতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে। ডাকাতরা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। অাতঙ্কিত অবস্থায় তিনি বাসায় স্টোররুমে ঢুকে খিল লাগিয়ে দিলেন। এরপর তার অার কিছু মনে নেই। ভোরবেলায় যখন পাড়া-প্রতিবেশিরা অচেতন অবস্থায় তাকে স্টোররুমের দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করল, তখন তার শরীরে ভীষণ জ্বর, মুখ দিয়ে অঝোর ধারায় লালা ঝরছে।
এ ঘটনার পর থেকে তার নানা সমস্যা দেখা দিতে লাগল। কিছুদিন লক্ষ্য করলেন, তিনি রাতে ঘুমোতে পারছেন না। ঘুমালেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। তার মনে হলো, এগুলো হয়তো বাড়িতে ডাকাত ঢোকার সেই ভয়াবহ স্মৃতির প্রতিক্রিয়া ছাড়া অার কিছুই নয়। কিন্তু সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলল।
তার স্বামী তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি জানালেন, তার মনের মধ্যে ডাকাতদলের ঘরে প্রবেশ করার দৃশ্যগুলো সবসময় পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। সিনেমা দেখার সময় ঐ ধরনের দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেন না। এগুলো দেখলে তিনি প্রচণ্ডভাবে ঘামতে আরম্ভ করেন আর টিভি বন্ধ করে দেন।
তিনি মনোবিদকে জানালেন, তার মনে হচ্ছে তিনি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কোনোকিছু সঠিকভাবে মনে রাখতে পারছেন না। সহজে রেগে যাচ্ছেন, যেকোনো আওয়াজে চমকে উঠছেন। দীর্ঘ সময় ধরে রাতে ভালোভাবে না ঘুমানোর ফলে সবসময় ক্লান্ত অনুভব করছেন। তার মনে হতে শুরু করেছে যে পৃথিবীটা এক বিপজ্জনক জায়গা।
সব কথা শুনে আর কিছু পরীক্ষা করে মনোবিদ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, তিনি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-তে ভুগছেন।
PTSD কী?
ট্রমা হলো একধরনের মনোশারীরিক চাপমূলক ঘটনা। কোনো ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষদর্শীর মনে ট্রমার সঞ্চার করতে পারে। এর নমুনা হতে পারে শারীরিক বা যৌন নির্যাতন, মারাত্মক দুর্ঘটনা, সামরিক সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
কোনো ব্যক্তি যখন তার সামনে কোনো করুণ মৃত্যু সংঘটিত হতে দেখে অথবা অন্য কোনো মানুষকে হত্যা করতে দেখে কিংবা প্রচণ্ড আঘাত পেতে দেখে, তখন ব্যক্তির মাঝে ট্রমার সৃষ্টি হয়। ট্রমার সময় ব্যক্তি একধরনের অসহায়ত্ব অনুভব করে থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে এই স্মৃতির ভয়াবহতা বাড়তেই থাকে। এর ফলে তারা আতঙ্কিত আর উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বলা হয়। এটি একধরনের অ্যাংজাইটি অর্ডার, যা কোনো দুঃখজনক ঘটনা দেখে বা তার অভিজ্ঞতা লাভের পর দেখা দেয়। কমপক্ষে এক মাস ধরে এর লক্ষণ-উপসর্গ থাকে। লক্ষণ-উপসর্গে ব্যক্তি চরম দুর্দশা এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাতের সম্মুখীন হয়।
ইতিহাস
আশির দশকের গোড়ার দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে প্রথম PTSD শনাক্ত করা হয়। তখন মার্কিন সৈন্যরা শেল শক বা ব্যাটল ফ্যাটিগ নামে এক মানসিক বিপর্যয়ে ভুগত বলে মনে করা হতো। ১৯৯০ সালে প্রথমদিকের ন্যাশনাল কোমরবিডিট-এর এক জরিপে দেখা যায়, মহিলারা পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়।
একই সময়কার ন্যাশনাল ভিয়েতনাম ভেটেরান রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের জরিপে দেখা যায়, প্রায় ২৫% মার্কিন সৈন্য পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে অাক্রান্ত। যারা এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, দেখা গেছে, তারা যুদ্ধের ঘটনা এবং কারো আঘাত বা মৃত্যুদৃশ্য দেখার পর এতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর নারীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা যায় যৌন নির্যাতন/অত্যাচার, হুমকি/ভয়-ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদিকে।
রোগের কারণ
• কোনো ধরনের জীবন বিপন্নকারী পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া।
• শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া বা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা।
• ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- ঝড়, তুফান, ভূমিকম্পের মুখোমুখি হওয়া।
• অাকস্মিক সামাজিক পরিবর্তন, যেমন- দাঙ্গা, বিপ্লব, অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করা।
এছাড়াও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হবার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো-
ট্রমাটিক ঘটনাটির-
• ধরন
• প্রচণ্ডতা
• অাকস্মিকতা
• ব্যপ্তিকাল
• সান্নিধ্য
রোগের উপসর্গ
PTSD-তে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ভয় আর উদ্বেগ অনুভব করেন। এর কিছু সাধারণ উপসর্গ হলো-
ঘটনার আবেগপূর্ণ পুনরাবৃত্তি: আক্রান্ত ব্যক্তি ঘটনাটিকে নিয়ে বারবার দুঃস্বপ্ন দেখেন আর প্রায়ই জাগ্রত অবস্থায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখেন। এর ফলে ব্যক্তি প্রতিবার সেই তীব্র মানসিক আঘাত আর ভয় অনুভব করেন যা ঘটনা ঘটার সময় অনুভব করেছিলেন। এ সময় নানা শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, গা গোলানো ভাব আর আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
এড়িয়ে চলা: আক্রান্ত ব্যক্তি এমন সব আলোচনা, স্থান এবং পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন, যা সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে পারে।
সবসময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন: আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় সতর্ক থাকেন আর সুরক্ষিত পরিবেশেও বিপদের আশঙ্কা নিয়ে ভীত হয়ে থাকেন। তার ঘুমাতে অসুবিধা হয় এবং বারবার চমকে ওঠেন।
অনুভূতিহীন হয়ে পড়া: আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের প্রতি আবেগ অনুভব করেন না এবং ক্রমশ বিনোদন কাজে আনন্দ হারিয়ে ফেলেন। এক্ষেত্রে তার পারিপার্শ্বিকতা অনুভূতির বিকৃতি অথবা সবকিছু অবাস্তব বলে মনে হতে থাকে।
অপরাধবোধে ভোগা: আক্রান্ত ব্যক্তি ট্রমাটিক ঘটনার পর নিজে বেঁচে যাওয়ার অপরাধবোধে ভোগেন। কারণ তিনি মনে করেন যে, অন্যরা মরে গেছে অথচ এত কিছুর পরও তিনি বেঁচে আছেন অথবা বেঁচে থাকার জন্য তাকে এমন কিছু করতে হয়েছে যা ঠিক নয়, এ কথা তিনি বার বার মনে করতে থাকেন।
এ রোগের পরিপূর্ণ উপসর্গ-লক্ষণগুলো প্রচন্ড স্পষ্টভাবেই রোগীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। রোগী এবং তাদের পরিবার-পরিজন এ রোগের কারণে নানা রকম উদ্বেগের শিকার হন। এই রোগ অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রের দক্ষতার ওপর আঘাত হানে এবং সামাজিক নানা কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে তোলে।
জটিলতা
এই রোগের কিছু জটিলতা হলো-
• বিষন্নতা এবং উদ্বেগ
• ইটিং ডিসঅর্ডার
• অাত্মঘাতী মনোভাব
চিকিৎসা
কোনো বড় অঘটনের পর যেকোনো ব্যক্তির PTSD হতে পারে। পরিবার আর বন্ধুদের সহযোগিতায় অনেকেই এই মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। যদি কেউ এই মানসিক আঘাত কাটিয়ে না উঠতে পারেন বা সময়ের সাথে সাথে উপসর্গগুলো আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, তাহলে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। PTSD চিকিৎসা মূলত দুই উপায়ে করা হয়ে থাকে।
১. সাইকোথেরাপি
কগনিটিভ থেরাপি: এটি একধরনের টক থেরাপি (Talk Therapy), যা মানুষের অবধারণগত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে। ট্রমাটিক ঘটনার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রোগীর মন থেকে মুছে দিতে এক্সপোজার থেরাপির সাথে এই থেরাপিটি ব্যবহার করা হয়।
এক্সপোজার থেরাপি: এই ব্যবহারগত থেরাপির সাহায্যে রোগী ট্রমাটিক ঘটনা ও তার স্মৃতির সাথে লড়াই করার শক্তি পান। দুঃস্বপ্ন ও ফ্ল্যাশব্যাক নিরাময়ে এক্সপোজার থেরাপি খুব কাজে দেয়। এই থেরাপিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীকে সেই বেদনাময় স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে করে তার সহনক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
অাই মুভমেন্ট ডিসেন্টিজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং থেরাপি (ইএমডিঅার): ইএমডিঅার মূলত কয়েকটি অাই মুভমেন্ট প্রক্রিয়ার সাথে এক্সপোজার থেরাপির সমন্বয় সাধন করে। ট্রমাটিক ঘটনার প্রতি রোগীর সাড়াদান প্রক্রিয়ার উন্নয়ন সাধন এ থেরাপির মূল লক্ষ্য।
এ সকল থেরাপি একাকী অথবা দলগত উভয় ভাগেই গ্রহণ করা সম্ভব। তবে দলগতভাবে গ্রহণ করাটাই বেশি সমীচীন, কেননা এতে করে রোগী এ রোগের অাক্রান্ত অন্যদের সম্পর্কে এসে নানাভাবে উপকৃত হতে পারেন।
২. ওষুধ
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট: বিষন্নতা বিরোধী ওষুধগুলো PTSD নিরাময়ে খুব কাজে দেয়। সেই সাথে নিদ্রা ও মনোযোগ বিকার সারাতে এরা ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন সেরোটোনিন রিঅাপটেক ইনহিবিটর (SSRI), যেমন- sertraline (Zoloft) এবং paroxetine (Paxil) ওষুধ দুটিকে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) PTSD নিরাময়ের জন্য অনুমোদন করেছে।
প্রাজোসিন: যদি এর উপসর্গগুলোর সাথে দুঃস্বপ্ন এবং অনিদ্রাও দেখা দেয় তাহলে এই ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও এটি PTSD নিরাময়ে FDA কর্তৃক অনুমোদিত নয়, তবে অনেকেই এটি সেবন করে ফল পেয়েছেন বলে জানা যায়। তবে যেকোনো ওষুধ সেবনের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা অাবশ্যক।
করণীয়
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে অাক্রান্ত একজন রোগীর জন্য যেটা অনেক প্রয়োজনীয় তা হলো আপনজনদের মানসিক সমর্থন। কারণ আপনজন বা পরিবারের সদস্যদের সমর্থনের ফলে রোগী নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারবে এবং তার মানসিক আঘাত বা ট্রমা মোকাবিলা করার মেনোবল গড়তে পারবে এবং নিজের ভেতর সাহস জোগাতে সক্ষম হবে। তাই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের রোগীকে নানাভাবে সাপোর্ট দেয়ার দায়িত্ব পরিবার ও সমাজের। এক্ষেত্রে সবারই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
Featured Image: Shutterstock