Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অতি জীবাণুমুক্ত জীবন: যা বাড়িয়ে তোলে ক্যান্সারের ঝুকি

মাঝে মাঝেই খবরে আসে, এক দেশের গুপ্তচর আরেক দেশে ধরা পড়েছে। তারপর শুরু হয় টানাপোড়েন। মাঝে মাঝে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে নাড়িয়ে দেয়। শুরু হয় কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব। তবু তারা কিন্তু আবারও গোপনে প্রতিবেশী বা শত্রু দেশে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে থাকে। বলা হয়ে থাকে, যে দেশের ইন্টেলিজেন্স যত বেশি শক্তিশালী, অন্য দেশের হাড়ির খবর যত বেশি আছে তাদের কাছে, সেই দেশ তত নিরাপদ। কারণ প্রাপ্ত তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিশালী! আর তাদের ক্ষমতা জানা থাকলে শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করে বা ব্যূহ রচনা করাও অনেকটা সহজ হয়ে যায়।

আসুন চিত্রকল্পটি আমরা এবার একটু আলাদাভাবে কল্পনা করি। আপনার দেহকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র কল্পনা করুন তো। সেক্ষেত্রে আপনি হয়ত ভাববেন, কিন্তু আপনার প্রতিপক্ষ কারা? কোথায় তারা, যারা অনধিকার প্রবেশ করে আপনাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে চায়? তারা আপনার চারপাশেই মিশে আছে। আপনি আয়েশ করে সকালে যে টোস্টে কামড় দিচ্ছেন, তৃষ্ণায় স্বচ্ছ গ্লাস ভর্তি যে জল চুমুকেই নিঃশেষ করছেন কিংবা প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাসের সাথে যে বাতাস গ্রহণ করছে – এদের মধ্যেই মিশে থাকে ওরা। ওদের চোখে দেখা যায় না, অনুধাবন করা যায় না- এতই ক্ষুদ্র ওরা। নিঃশব্দে ওরা ঢুকে পড়ে মানুষের শরীরে, চুপটি করে বাসা বাধে নানাবিধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তারপর বংশবিস্তার করে সেখানে, সংখ্যায় যখন যথেষ্ট পরিমাণে জড় হয় তখন ওরা দল বেধে হামলা করে দেয়। অসুস্থ হয়ে পড়ি আমরা।

 

রোগ-জীবাণুর সাথে যুদ্ধই আমাদের ইমিউনি সিস্টেমকে করে তোলে শক্তিশালী; Image Source: Organic Facts

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমাদের প্রতিপক্ষ হলো ভয়ংকর সব রোগ-জীবাণু। তবে আমাদের দেহের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট কিন্তু কম যায় না। এর নাম দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি। একবার যে দেহের ঢুকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তার চেহারা-ছবি সব সংরক্ষণ করে রাখে সে।

তারপর তার শক্তি সামর্থ্যকে হিসেব করে তার জন্য বিধ্বংসী সব অস্ত্র তৈরি করে রাখে। ফের যদি তারা অনুপ্রবেশ করতে চায়, তাহলে ঢিসুম! খতম করে দেয় তাদের। এই বিধ্বংসী অস্ত্রের নাম এন্টিবডি। কিন্তু যদি এমন হয়, আমাদের দেহের ইন্টেলিজেন্সকে যদি ঠিকঠাক মতো শত্রুকে চিনতে সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে? সেক্ষেত্রে দেহ সম্ভাব্য শত্রুর জন্য কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবে? ঠিক এমনটিই হতে যাচ্ছে আমাদের অতি স্বাস্থ্য সচেতনতার যুগে!

রোগজীবাণু বিহীন অতি পরিচ্ছন্নতা উসকে দিচ্ছে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগকেও। ব্রিটিশ ক্যান্সার গবেষক মেলভিন গ্রিভেস তার গবেষণায় এমনটিই তুলে ধরেছেন সম্প্রতি। তার গবেষণায় উঠে এসেছে এই ভয়াবহ তথ্য- আমাদের দেহের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) সাথে যদি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে যথেষ্ট রোগ জীবাণুর মোলাকাত না হয়, তাহলে শৈশবে তাদের দেহে ক্যান্সারের আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে বেশ বড় মাত্রায়।

যেসব ক্যান্সার শিশুদের বেশি হয় তার মধ্যে প্রধান একটি লিউকেমিয়া। আপনারা সবাই কমবেশি এই নামটির সাথে পরিচিত। লিউকেমিয়ার একটি বিশেষ শ্রেণীর নাম একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া, যা সাধারণত প্রতি ২,০০০ শিশুর মাঝে একজনের হতে পারে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, এটি সমাজের অগ্রসর এবং ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিন্তু সমাজের এই স্তরেই কেন লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার প্রকোপ বেশি? কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন পাওয়ার ক্যাবল, তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রভৃতি এর পেছনে দায়ী থাকতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে অনুসন্ধানে এগুলো ধোপে টেকেনি।

উন্নত বিশ্বে শিশুদের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে লিউকেমিয়ার হার; Image Source: The Indian Express

মেলভিন গ্রিভেস সারা বিশ্বের ক্যান্সার গবেষকদের এক মিলন মেলা ঘটিয়েছেন। প্রাপ্ত ফলাফল থেকে তিনি জানাচ্ছেন, এই রোগটি তিনটি পর্যায় শেষে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

প্রথম ধাপে রয়েছে, ভ্রুণ দেহের ঘটে যাওয়া কিছু মিউটেশন, যা একজন মানুষকে লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে, শৈশবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ না দেওয়া। আজকের আমাদের এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু এখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। শৈশবে মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে যদি কোনো প্যাথোজেনের পরিচয় না ঘটে, তাহলে সে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারে না। কারণ প্রতিকূল পরিস্থিতিই মানুষকে বিরুদ্ধ শক্তির সাথে লড়াই করতে শেখায়।

এই প্রক্রিয়ার শেষপর্যায়ে রয়েছে, দেহের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জীবাণুর আক্রমণ যা দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে লিউকেমিয়ার সূচনা করতে পারে।

এই ‘একীভূত ত্রয়ী’ তত্ত্ব একদিনের ফল নয়। বরং বহুদিনের গবেষণা আর পরিশ্রমে অসংখ্য তথ্য বিশেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন, যা একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া এবং তার রহস্যময় অজানা কারণগুলোর মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেছে। প্রফেসর গ্রিভেসের ভাষায়, এটি স্পষ্ট যে এই রোগের একটি সুস্পষ্ট জৈবতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে, যা একজন মানুষের শরীরে নানাবিধ সংক্রামণ দ্বারা উন্মোচিত হয়, যার শরীরে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব রয়েছে।

এক্ষেত্রে তিনি প্রমাণ হিসেবে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। চলুন তার মধ্যে কয়েকটি জেনে আসা যাক। ইতালির মিলান শহরে সোয়াইন ফ্লুর সংক্রমণ দেখা যাওয়ার পরে সেখানে আক্রান্ত শিশুদের সাতজনের দেহে লিউকেমিয়া ধরা পড়ে। 

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসকল শিশুরা নার্সারিতে অন্যান্য শিশুদের সাথে পড়াশোনা করে কিংবা যারা উঠোন কিংবা মাঠে বড় ভাইদের সাথে এক হাত মারামারি করে তাদের লিউকেমিয়া হওয়ার হার অন্যদের চেয়ে, বিশেষত যারা সুপার স্পেশাল প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে কিংবা বহুতল এপার্টমেন্টে বড় হয়েছে, তাদের থেকে কম।

আমাদের অন্ত্রে থাকে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া; Image Source: NutriSimple

আমাদের প্রত্যেকের দেহের অন্ত্রে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে,যারা দেহের কোনো ক্ষতি করে না। বরং নানাভাবে এরা দেহের উপকার করে। শৈশবে মাতৃদুগ্ধ পান করলে এই সমস্ত ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহে সহজেই প্রতিস্থাপিত হতে পারে। দেখা গেছে মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুদের একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার হার অন্যদের তুলনায় কম। ঠিক এই জিনিসটা দেখা যায়, যাদের স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় জন্মলাভ হয় তাদের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রেও শিশুরা মাতৃদেহ থেকে কিছু নিরপরাধী ব্যাকটেরিয়া লাভ করে, যারা শিশুর ইমিউনিটিতে ভূমিকা রাখে। সিজারিয়ান প্রক্রিয়ায় জন্মলাভ করা শিশুর এই সুযোগ থাকে না।

এগুলো তো গেলো পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য। এবার আসা যাক গবেষণাগারে চালানো পরীক্ষার কথায়। কিছু প্রাণীকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে জন্ম দেওয়া হয়, যেখানে কোনোরূপ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী কিংবা প্যাথোজেনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ তাদের ছিল না। এমনকি স্বাভাবিক প্রাণীর শরীরের অন্ত্রে যে হরেক রকমের ব্যাকটেরিয়া থাকে, তা থেকেও মুক্ত ছিল তারা। একসময় তাদের বাইরের পরিবেশে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। অনুমিতভাবেই তাদের লিউকেমিয়ার প্রকোপ দেখা যায়।

এই ঘটনাগুলোই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই অতি খুঁতখুঁতে জীবাণুমুক্ত অতি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শিশুদের বড় করে তোলা অতটা উপকারী নয়, যতটা আমাদের মা-বাবা ভেবে থাকেন। অবশ্য এই সম্পূর্ণ গবেষণা কোনোভাবে মা-বাবার অতি সচেতনতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না। পাশাপাশি এই গবেষণা এটাই তুলে ধরে, একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার মতো ভয়াবহ রোগ অপ্রতিরোধ্য নয়- অভিমত প্রফেসর কেলভিন গ্রিভেসের

শিশুদের শৈশব হয়ে উঠুক স্বাভাবিক, তাতেই মঙ্গল; Image Source: Shaw Academy

তবে রোর বাংলার প্রিয় পাঠককুলের জন্য একটি কথা আগে থেকে জানিয়ে রাখি, এই প্রবন্ধটি পড়েই কেউ যদি বাড়ি গিয়ে একগাদা কাদাজল মাথায় দিয়ে বসে থাকেন, তাহলে যে রাতারাতি তার রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়ে গিয়ে লিউকেমিয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে-  এমনটি ভাবার প্রয়োজন নেই। আর এই নিবন্ধটি মূলত উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোজ্য। আমাদের দেশে কম-বেশি আমরা সবাই মাঠে-ঘাটে, স্কুলে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বড় হয়েছি। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যাদের জীবন খুব কড়া রুটিনে সীমাবদ্ধ। স্কুল আর কোচিং কিংবা বিকেল হলে আঁকার স্কুল। এই নিবন্ধটি মূলত তাদের অভিভাবকদের জন্য।

আপনার সন্তানকে আর পাঁচটি শিশুর মতো স্বাভাবিক উপায়ে বড় করুন, তাদের খেলতে দিন, ঘুরতে দিন। এতে যেমন তার মানসিক বিকাশ সাধিত হবে, তেমনই শারীরিকভাবে হয়ে উঠবে শক্তিশালী।

Feature Image: Interactive Biology

Related Articles