ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে ইতালির রাজনৈতিক সঙ্কট। প্রেসিডেন্ট সের্জিও মাতারেল্লা অর্থমন্ত্রীর পদের জন্য মনোনীত পাওলা স্যাভোনাকে সে পদ দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। এতে দেশটির দুই রাজনৈতিক দলের জোট সরকার গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ফলে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অভিশংসনের প্রস্তাব।
তবে প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কার্লো কোতারেল্লিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে সাময়িক সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন তিনি, সেটা নিয়ে ভাবনার প্রয়াস রয়েছে। ইউরোজোনের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে সার্বিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লার নেওয়া সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাবই বা কেন আনা হলো? তিনি কি সত্যিই অভিশংসিত হতে পারেন?
সঙ্কটের কারণ কী?
কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় গত মার্চের নির্বাচনের পর থেকেই ইতালি সরকারবিহীন অবস্থায় রয়েছে। তাই রাজনৈতিক দল ফাইভ স্টার ও ডানপন্থী দল লীগ জোট সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে দল দুটি জুসেপ্পে কনতেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল করে জোট সরকার গঠনে সম্মত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী কনতে তার মন্ত্রীসভার সম্ভাব্য সদস্যদের নাম প্রস্তাব করতে প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লার সাথে সাক্ষাৎ করেন। অর্থমন্ত্রীর পদে পাওলো স্যাভোনাকে নিয়োগে প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লা বাধ সাধেন। ইউরোজোনে ইতালির সদস্যপদ নিয়ে স্যাভোনার বিরুদ্ধাচারণ ও সমালোচনাতেই ছিল মাতারেল্লার বিপত্তি।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে মাতারেল্লা বলেন, “ইউরোতে আমাদের অবস্থানের অনিশ্চয়তা ইতালীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করেছে।” তার মতে, স্যাভোনার অবস্থান ইউরোপে ইতালির অবস্থান সম্পর্কে রাজনৈতিক দল দুটির সাথেও দ্বন্দ্বপূর্ণ। তিনি আরও জানান, “আমি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাসম্পন্ন একজন কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিকে চেয়েছিলাম যিনি সরকারের কার্যক্রমের সাথে সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, ইতালি ইউরো থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বা বেরিয়ে আসার জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে প্ররোচনা দান করবে এরকম কাউকে নয়।”
তিনি জানান, জুসেপ্পে কনতে অন্য কোন সমাধানে আসতে রাজি হননি। অবশেষে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকৃতি জানান।
প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লার পদক্ষেপটি কি অসঙ্গতিপূর্ণ?
ইতালির আইন অনুযায়ী, মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে কারও নিয়োগ বাতিল করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের রয়েছে। যদিও সেই ক্ষমতা খুব কমই ব্যবহার করা হয়। এ পর্যন্ত তিনবার ইতালিতে এ ক্ষমতার প্রয়োগ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট অস্কার লুইজি স্কালফারো প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনিকে তার ব্যক্তিগত আইনজীবীকে আইনমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিতে বাধা দেন।
ইতালিতে প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম সাধারণত আনুষ্ঠানিক হলেও তার কিছু মৌলিক ক্ষমতা থাকে, যেমন- সরকারপ্রধান নিয়োগ ও সংসদ মুলতবী করা। স্থায়িত্বের অভাবের কারণে দেশটিতে ১৯৪৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় প্রায়ই প্রেসিডেন্টগণ এগিয়ে এসেছেন। সেদিক থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লার পদক্ষেপ অসঙ্গতিপূর্ণ বলা যায় না।
প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের প্রস্তাব
ইতালির রাজনৈতিক দল ফাইভ স্টারের প্রধান লুইজি ডি মাইও প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লার এই পদক্ষেপে বেশ নারাজ। দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯০ অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের প্রস্তাব দিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্তির মাধ্যমে সংসদ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করতে পারে। ভোটের ফলাফল পক্ষে হলে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আদালত ঠিক করে অভিশংসন হবে নাকি হবে না।
ডি মাইয়ো বলেন, “আমি চাই এই প্রাতিষ্ঠানিক সংকট সংসদে উত্থাপিত হোক এবং প্রেসিডেন্টকে জবাবদিহি করা হোক।” তিনি আরও বলেন, “আমরা সরকার গঠনে মাত্র কয়েক ধাপ পিছিয়ে ছিলাম কিন্ত আমাদেরকে থামিয়ে দেওয়া হলো, কেননা মন্ত্রীসভায় এমন একজন ছিলেন যিনি কিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা করেছিলেন।”
অভিশংসনের সম্ভাবনা কতটুকু?
অভিশংসনের ডাক দিলেও ডি মাইয়ো এ পর্যন্ত খুব বেশি সাড়া বা সমর্থন পাননি। এদিকে অপর রাজনৈতিক দল লিগের নেতা স্যালিনি বলেছেন, “আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কিছু জিনিস রাগের মাথায় করা উচিত না। আমি অভিশংসনের ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।”
তাই পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এক্ষেত্রে ডি মাইয়ো সফল না হলেও তার প্রস্তাব ইতালির এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও অভিশংসনও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ আদালতের হাতে ন্যস্ত থাকে। ফলে এসময় এটি ইতালির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ না-ও হতে পারে।
বর্তমান অবস্থা
প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কার্লো কোতারেল্লিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর ফলে আবারও ইতালিতে নতুন করে নির্বাচনের পথে অগ্রসর হতে হবে। সাময়িকভাবে ক্ষমতায় আসা কোতারেল্লিকে হয়তো পরবর্তী বাজেট পাশের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লা গত রবিবার জানান, জনপ্রিয় সরকারের প্রত্যাশায় বিগত ১০ বছরে জার্মান ও ইতালীয় সরকারের ব্যবধান দেশটির জন্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ।
এদিকে ফাইভ স্টারের নেতা ডি মারিও তার সমর্থকদের প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এখনই হাল ছেড়ে দেবেন না, আমরা প্রাতিষ্ঠানিক একগুঁয়েমির কাছে নত স্বীকার করবো না যা দেশের মানুষকে নিজের দেশের জন্যই সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়।” তিনি আরও বলেন, “কিছু আওয়াজ তুলুন। আমাদের সবার মিলিয়ে এটি করা গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রতিবাদ হিসেবে ইতালির শহরগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে র্যালি করা হবে। এছাড়াও ছুটির দিন ২ জুনে রোমে একটি ইভেন্টের আয়োজন করা হবে।
প্রেসিডেন্ট মাতারেল্লা স্যাভোনাকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়োগ না দেওয়ার প্রধান কারণ ছিল স্যাভোনা ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী। তার আশঙ্কা এই পদে নিয়োগ দিলে স্যাভোনা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার প্রয়াস ঘটাতে পারেন। তবে তাকে নিয়োগ না দিয়ে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
Featured Image Source: AFP PHOTO / Vincenzo PINTO