পানি নিয়ে টানাটানি যে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধে গড়াতে পারে, এমনটা অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ পানি নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে জটিল মন কষাকষিতে ভুগছে। পানি অমূল্য সম্পদ আর এই সম্পদ নিয়েই একটি যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়াতে, ২০০২ সালে। অবশ্য এটাকে ঠিক যুদ্ধ না বলে আদিবাসীদের সাথে সরকারের সংঘর্ষ বলাই শ্রেয়। কয়েক মাসব্যাপী ব্যাপক দাঙ্গা, হরতাল আর গোলাগুলিতে ভরপুর সেই সময়টাকে তাত্ত্বিকভাবে যুদ্ধ বলা না গেলেও বাস্তবে সেটা যুদ্ধের তুলনায় কম কিছু ছিল না। দেড় যুগ আগের সেই ঘটনা কিভাবে পাল্টে দিলো বলিভিয়ার ইতিহাস? চলুন, দেখা যাক।
প্রেক্ষাপট
লাতিন আমেরিকার ঠিক মাঝখানে অবস্থান বলিভিয়ার। নাইট্রেট যুদ্ধে হেরে তারা সমুদ্রতটের অধিকার খুইয়েছে ১৮৮৩ সালে। উত্তর-পূর্বে ঘন আমাজন বন আর তৃণভূমি; মধ্য আর দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিমাংশ অধিকার করে রয়েছে সুবিশাল আন্দিজ পর্বতমালা। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বলিভিয়ার ইতিহাস অন্য দশটা লাতিন দেশের তুলনায় খুব একটা আলাদা না। স্পেনীয়দের হাতে আদিবাসী মানুষের গণহত্যা, উপনিবেশিক শাসন, দাসত্ব, মহামারী, স্বাধীনতা, আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে দলাদলি, সামরিক শাসন আর ব্যাপক দারিদ্রতা।
অন্যান্য আন্দিজ প্রজাতন্ত্রের মতো বলিভিয়ার সমাজেও বিপুল সংখ্যক আদিবাসী আছে এবং তারা চরমভাবে নিগৃহীত। ঊষর আন্দিজের খনি আর কৃষিজমি সম্বল করে গড়ে ওঠা বিষণ্ন শহর আর গ্রামে বসবাস করে কুয়েচুয়া, আইমারা, চিকুইতানোসহ নানা গোত্রের রেড ইন্ডিয়ান আর স্প্যানিশ-আদিবাসী শংকর মেস্তিজো জাতের মানুষেরা। প্রায় সবাই তারা হতদরিদ্র্য। দিনে দুই ডলার আয় করা সেখানে বিশাল ব্যাপার। মধ্য বলিভিয়ার এমনই একটি শহর কোচাবাম্বা।
কোচাবাম্বা সমৃদ্ধ শহর। কোকা, ভুট্টার পাশাপাশি শহরটি গুরুত্বপূর্ণ সব যন্ত্রশিল্পের কেন্দ্র। অঞ্চলটির বেশিরভাগ মানুষই আইমারা আর কুয়েচুয়া জাতের। বিখ্যাত ইনকা শাসক হুয়ানা কাপাকের এই প্রজাদের আছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোচাবাম্বার মেয়েরা খালি হাতে স্প্যানিশ বন্দুকের সাথে যুদ্ধ করে বলিভিয়ার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ২০০০ সালে এই কোচাবাম্বা ফুঁসে উঠলো ব্যাপক আন্দোলনে।
কেন আন্দোলন
আন্দিজ পাহাড়ে পানি সংকট লেগেই থাকে। বলিভিয়ার মতো গরীব দেশে এই সমস্যা আরো প্রকট। কোচাবাম্বার পানি সরবরাহের দায়িত্বে ছিল সেমাপা নামের একটি সরকারি সংস্থা। তারা সস্তায় পানি বিক্রি করতো বটে, কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বলিভিয়ার ক্ষমতায় তখন ডানপন্থী সরকার, নেতৃত্বে সাবেক সামরিক শাসক থেকে গণতান্ত্রিক নেতা বনে যাওয়া বানজের। বানজের ও তার পূর্বসূরীরা সেই আশির দশক থেকে বলিভিয়াতে ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ শুরু করে।
এদিকে কোচাবাম্বার মেয়র সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ম্যানফ্রেড ভিয়ার স্বপ্ন হচ্ছে প্রকান্ড একটা বাঁধ তৈরি করে পানি সংকটের মোকাবেলা করা। এখন বাঁধ বানাবার বিপুল অর্থ কোথা থেকে আসবে? এগিয়ে এলো বিশ্বব্যাংক। তাদের শর্ত হচ্ছে, বলিভিয়া সরকার যদি দেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করতে রাজি হয়, তবে মোটা অংকের ঋণ দেওয়া হবে। ১৯৯৯ সালে সরকার কোনো ঘোষণা না দিয়েই চট করে কোচাবাম্বার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তুলে দিলো ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাখতেল কর্পোরেশনের হাতে, ৪০ বছরের জন্য। ব্যাখতেল পানি সরবরাহ ও বিক্রি করবে। বিনিময়ে সেমাপার তিন কোটি ডলার ঋণও তারা শোধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল।
তিন কোটি ডলার অনেক অর্থ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশন তো বিনা লাভে কাজ করবে না। কাজেই ব্যাখতেল পানির জন্য দাম ধরলো মাসে ২০ মার্কিন ডলার। ঐ বিদেশী কোম্পানিটির পরিচালকদের সরেশ মাথাতে এটা আসেনি যে, কোচাবাম্বার সিংহভাগ লোকই গড়প্রতি মাসে আয় করে মোটে একশো ডলার। অত দামে পানি কেনা তাদের পক্ষে অসম্ভব।
অশান্ত আন্দিজ
কোচাবাম্বার গরিব লোকেরা প্রথমে রাস্তায় নামে পানির দামের বিরুদ্ধে। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে তাদের সাথে যোগ দেয় শহরের মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা। আর ছাত্ররা তো ছিলোই। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল কোঅর্দিনেদোরা নামে পরিচিত একটি কমিটি। এগুলোর নেতৃত্বে ছিল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাসহ শ্রমজীবী মানুষেরা, মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতেন অস্কার অলিভেরা নামের এক আদিবাসী নেতা। গোটা জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি জুড়ে শহরে চললো হরতাল আর অবরোধ। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বহু মানুষ আহত হয়, শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়।
মার্চ মাস জুড়ে ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্বে একটা সমঝোতার চেষ্টা চালানো হতে থাকলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে এপ্রিলে আবার শুরু হয়ে গেল পুরোদস্তুর আন্দোলন। সরকারও চটে লা পাজ থেকে সৈন্য পাঠালো। গোলাগুলিতে মারা গেল বেশ কয়েকজন মানুষ, আহত হলো আরো অনেকে। তাতে লাভ কিছু হলো না, পাশের শহরগুলোতেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। এপ্রিলে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলো দেশে। জনতা নয়টি প্রদেশের মধ্যে পাঁচটিকেই একরকম দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শুরু হয়ে গেল সেনাবাহিনীর সাথে ধস্তাধস্তি।
২০০০ সালের ৯ এপ্রিলের কথা একটু আলাদা করে বলতে হয়। আচাকাচি শহরের কাছে সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন হতাহত হলে ক্ষিপ্ত জনতা এক অফিসারকে পাকড়াও করে গণধোলাই নেয়। সে যাত্রা অন্য সৈন্যরা তাকে রক্ষা করে ফেরত আনলেও জনতার রোষ কমেনি। আহত সেই অফিসারকে হাসপাতাল থেকে ছিনিয়ে এনে হত্যা করা হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী লা পাজে। তখন অবশ্য এটা আর স্রেফ পানির দাবিতে আন্দোলন নয়। নিজস্ব সমস্ত সমস্যা সমাধানের সুযোগ পেয়ে গেল যেন সবাই।
লা পাজের পুলিশ বাহিনীর অফিসারেরা বেতন বাড়াবার দাবিতে ব্যারাকে বসে রইলো। জায়গায় জায়গায় সেনাবাহিনীও একই জেদ ধরলো। সরকার তো বেগতিক বুঝে তখনই তাদের বেতন বাড়িয়ে দিল, কিন্তু বাকি মানুষদেরকে তো এভাবে তুষ্ট করা সম্ভব না। বেতনের দাবিতে শিক্ষকেরাও তখন আন্দোলনে। রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছাত্ররা। যদিও ততদিনে কোঅর্দিনেদোরার বেশিরভাগ নেতাই হয় আত্মগোপনে অথবা জেলে, আন্দোলন কিন্তু চলতেই থাকলো। প্রধান প্রধান শহরে বসানো হয়েছে ব্যারিকেড আর রোডব্লক। হরদম পুলিশের সাথে মারপিট চলছে।
এরই মধ্যে টিভিতে একবার দেখা গেল এক বলিভিয়ান অফিসার একজন আন্দোলনকারী কিশোরকে গুলি করে মেরেছে। এতে গোটা দেশ রোষে ফেটে পড়লো। সরকার স্বয়ং মার্কিন কোম্পানিটিকে জানিয়ে দিলো, তাদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া আর সম্ভব না। কাজেই চুক্তি বাতিল করে তারা যেন কেটে পড়ে। ব্যাখতেলের কর্মকর্তারাও পরিস্থিতি বুঝে বিদায় নিলেন। পরে অবশ্য ব্যাখতেল পাওনা দাবি আদায়ের জন্য বলিভিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কোচাবাম্বার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা বুঝে পেল কোঅর্দিনেদোর নেতারা। ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয় ১৭৫ জন। শত শত লোককে জরুরি অবস্থা জারির সুযোগে অত্যাচার করে সরকারি বাহিনী।
ফলাফল
একনজরে দেখলে কোচাবাম্বার এই পানি যুদ্ধ বলিভিয়ার ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। কিভাবে? আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য বামপন্থী দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম আর তাদের এক ক্যারিশম্যাটিক নেতা দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠেন। কোকাচাষীদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় এই নেতার নাম ইভা মোরালেস। আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার জন্য তাকে ২০০১ সালে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। চার-পাঁচ বছরের মাথায় এই ইভা মোরালেসই বিপুল ভোটে ক্ষমতা জয় করেন।
জনগণের সাথে সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, আদিবাসীসহ সবার সমান অধিকার, টেকসই উন্নয়ন আর ধনীক শ্রেণীর বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়ে ইভা মোরালেস নাম কামিয়েছেন। অনেকেই তার শাসনের মধ্যে কোচাবাম্বার আন্দোলনের চেতনার মিল দেখতে পান। দুটি ক্ষেত্রেই সমষ্টিগত অধিকার, পুঁজিবাদ এবং বিশ্বায়ন বিরোধী অবস্থান এবং বঞ্চিত আদিবাসীদের সম্মান পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। বলিভিয়া বর্তমানে আশির দশক থেকে চলে আসা মুক্তবাজার অর্থনীতি আর বেহিসেবী বেসরকারীকরণের চক্কর থেকে বেরিয়ে অনেক নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতি বেছে নিয়েছে, যেখানে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বেশ কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। কোচাবাম্বার কাছে বলিভিয়া সরকার বিশাল বাঁধ বানাবার কাজে হাত দিয়েছে।
তবে মুদ্রার অপর পিঠ এতটা চমৎকার না। আদতে কোচাবাম্বার পানি যুদ্ধ কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে তা বিবেচনা করা কঠিন। বলিভিয়ার শত বছরের পুরানো সমস্যাগুলো এত দ্রুত গায়েব হয়ে যাবে এমনটা ভাবাই আসলে অন্যায়। তাছাড়া সরকার অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সেজন্যেই হয়তো, আঠারো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও কোচাবাম্বার অর্ধেক লোকই ঠিকমত পানি পায় না। পার্থক্য বলতে এখন পানির নিয়ন্ত্রণ আর সরবরাহ সবই সমাজের নেতাদের হাতে। বলিভিয়া যদিও একমাত্র দেশ হিসেবে আইন করে প্রকৃতিকে মানুষের মতোই অধিকার আর সম্মান দিয়েছে, কিন্তু সেই তারাই বিপুল পরিমাণ তেল আহরণ করার মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে চলেছে। কাজেই পানি নিয়ে আবার যুদ্ধ বেঁধে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ফিচার ইমেজ – developmentinaction.org