১
১৫৪০ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিককার কথা। শের খান তখন সবেমাত্র তার শক্তিশালী দুর্ধর্ষ আফগান সেনাবাহিনী নিয়ে কনৌজের কাছাকাছি এসে ঘাঁটি গেড়েছেন।
শের শাহের গতিবিধি সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর সম্রাট হুমায়ুন আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। চৌসার পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ, সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব আর নিরাপত্তার দিকটি চিন্তা করে তিনি দ্রুত মুঘল সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রা থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে কনৌজের দিকে যাত্রা করলেন।
কনৌজে গিয়ে শের শাহের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্রাট হুমায়ুন সেনাবাহিনীসহ গঙ্গা পাড়ি দিলেন। দুই বাহিনী তখন গঙ্গার একই দিকে মাত্র ১৫ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে অবস্থান করছে।
কনৌজের যুদ্ধের ঘটনাবলী ভালো করে লক্ষ্য করলে এ যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহকে অনেকটা চৌসার যুদ্ধের ঘটনাবলীর মতোই মনে হয়। কনৌজে ঘাটি গেড়ে দুই বাহিনী সেই চৌসার যুদ্ধের মতোই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বসে রইলো। পার্থক্য হলো, চৌসায় এই সময়টা ছিলো প্রায় ৩ মাস, আর কনৌজে ১ মাস।
শের শাহ চৌসার যুদ্ধের মতোই কনৌজের যুদ্ধক্ষেত্রেও অপেক্ষা করছিলেন খাওয়াস খানের জন্য। খাওয়াস খান চেরুহ জমিদারদের পরাজিত করে তার বিজয় সংবাদ আগেই শের শাহের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন কনৌজে এসে পৌঁছাতে তার যেটুকু সময় লাগে।
ধুরন্ধর শের শাহ আরো অপেক্ষা করছিলেন বর্ষার জন্য। নদী পাড়ি দেয়ার পর মুঘল সেনাবাহিনী যে জায়গাটিতে ক্যাম্প করেছে, সে জায়গাটি শের শাহের অবস্থানের তুলনায় যথেষ্ট নিচু ছিলো। বর্ষার বর্ষণে এই অবস্থায় মুঘল সেনাবাহিনী অবশ্যই চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
অন্যদিকে সম্রাট হুমায়ুন চাচ্ছিলেন শের শাহ নিজে যেন আগে আক্রমণ করে। সম্রাট হুমায়ুন এ যুদ্ধে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কামানগুলোর উপর নির্ভর করছিলেন। তাছাড়া তড়িঘড়ি করে তৈরি করা মুঘল সেনাবাহিনীও যথেষ্ট বিশৃঙ্খল ছিলো। যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার আগে সেনাবাহিনী পরিপূর্ণভাবে গুছিয়ে নেয়ার জন্য সম্রাটের আরো কিছু সময় প্রয়োজন ছিলো।
২
কনৌজের যুদ্ধে দুই বাহিনীর মোট সৈন্য সংখ্যা ঠিক কত ছিলো, তা নিয়ে মতভেদ আছে এবং কোনোটি সম্পর্কেই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
সম্রাট হুমায়ুনের পানিবাহক জওহর আবতাবচির মতে, সম্রাট যখন সেনাবাহিনীসহ কনৌজের উদ্দশ্যে আগ্রা ত্যাগ করেন, তখন তার সাথে মোট ৯০ হাজার সৈন্যের বিশাল এক সেনাবাহিনী ছিলো। অন্যদিকে, বদায়ূনী, ফিরিশতা আর নিজামউদ্দীন আহমদ এই সংখ্যাটা আরো ১০ হাজার বাড়িয়ে মোট ১ লাখ সৈন্যের কথা বলেছেন। আবার মির্জা হায়দার কনৌজের যুদ্ধে মুঘল সৈন্যদের সংখ্যা বলেছেন প্রায় ৪০ হাজার। ড. ঈশ্বরী প্রসাদও একই কথা বলেছেন। তিনি সম্রাটের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ৩০ আর ৪০ হাজারের মাঝামাঝি উল্লেখ করেছেন।
অপরদিকে, নিজামউদ্দীন আহমদ আর ফিরিশতার মতে কনৌজের যুদ্ধে শের শাহের কাছে মোট ৫০ হাজারের মতো সৈন্য ছিলো। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, শের শাহের কাছে মাত্র ১৫ হাজারের কিছু বেশি সৈন্য ছিলো। তবে এ মতটি ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না।
সব মতবাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে এটা বলাই যুক্তিযুক্ত যে, দুই বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা প্রায় কাছাকাছিই ছিলো। এবং সংখ্যাটা সম্ভবত ৪০ হাজারের আশেপাশেই হবে।
৩
কনৌজের যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুনের অন্যতম একটি শক্তিস্তম্ভ ছিলো তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কামানগুলো। তিনি এ যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য প্রায় ৭০০টি কামান নিয়ে এসেছিলেন। কামানগুলো ছোট আকৃতির চাকাযুক্ত প্লাটফর্মের উপর বসানো থাকতো। প্রত্যেকটি কামান টেনে নিতে ৪টি করে গরু লাগতো। এছাড়া সেনাবাহিনীতে প্রায় ২১টি বড় কামান নিয়ে ছিলো। আকারে তুলনামূলক বড় আর শক্তিশালী এসব কামান টেনে নিতে মোট ১৬টি করে গরু প্রয়োজন পড়তো।
গঙ্গা পাড়ি দিয়ে সম্রাট দ্রুত সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ বিন্যাসে সাজিয়ে নিলেন। বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করে অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হলো আসকারী মির্জাকে। আসকারী মির্জার অবস্থানের কিছুটা পেছনে গভীর একটি পরিখা খনন করে পরিখার পেছনে মুঘল সেনাবাহিনীর কামানগুলোকে মোতায়েন করা হলো। মুঘল সেনাবাহিনীর এই আর্টিলারি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্বে রইলেন মুহাম্মদ খান রুমী, হুসেন খলিফা আর উস্তাদ আহমেদ রুমী। আর্টিলারি ইউনিটের পেছনে রইলেন স্বয়ং সম্রাট হুমায়ুন।
হুমায়ুনের বামপাশে মোতায়েন করা হলো হায়দার মির্জাকে। আর হায়দার মির্জার বামে রইলেন সম্রাটের সৎ ছোট ভাই মির্জা হিন্দাল। আর সম্রাটের ডানপাশে মোতায়েন করা হলো ইয়াদগার নাসির মির্জা ও কাসিম হুসেন সুলতানকে।
৪
শের শাহ তার বাহিনীকে ভাগ করলেন মোট ৭ ভাগে। খাওয়াস খান আর বরমজীদ গৌড়কে একেবারে সামনে মোতায়েন করে তাদের পেছনে মূল বাহিনী নিয়ে অবস্থান নিলেন শের শাহ। শের শাহের সাথে মূল বাহিনীতে আরো ছিলেন আজম হুমায়ুন সরওয়ানী, সরমস্ত খান, ঈশা খান সরওয়ানী, কুতুব খান লোদী, সঈফ খান সরওয়ানী আর বিজলি খান।
মূল বাহিনীর ডানপাশে অবস্থান নিলেন জালাল খান, নিয়াজী আফগান আর তাজ খান জালোই। আর বামবাহুর নেতৃত্বে রইলেন আদিল খান সূর ও রায় হুসাইন জলওয়ানী।
শের শাহ তার বাহিনীর এই ডান আর বামবাহুর পাশাপাশি আরো দুটি সাহায্যকারী বাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। এই বাহিনী দুটির অবস্থান ছিলো যথাক্রমে ডান ও বাম বাহুর ডান ও বামপাশে। আর মূল বাহিনীর বেশ কিছুটা পেছনে একটি রিজার্ভ ফোর্স রাখা হলো।
বাহিনীর অবস্থানের দুই পাশে দুটি গভীর পরিখা খনন করে বাহিনীর নিরাপত্তা আরো বৃদ্ধি করা হলো।
শের শাহ অধীর আগ্রহে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হুমায়ুন কনৌজে আসার এক মাস পর প্রথম বৃষ্টি পড়লো। শের শাহের আর আক্রমণ শুরু করতে কোনো বাঁধা রইলো না। ইতোমধ্যেই আফগান শিবিরে খাওয়াস খান এসে উপস্থিত হলে শের শাহ আস্বস্ত হয়ে সামরিক তৎপরতা শুরু করলেন।
তিনি প্রথমেই সম্রাট হুমায়ুনের রসদের একটি বিশাল চালান আটক করলেন। এছাড়া প্রায় ৩০০ উট আর বিপুল সংখ্যাক ষাঁড়ও তার হস্তগত হলো।
৫
এদিকে সম্রাট হুমায়ুন আর তার জেনারেলরা পড়েছিলেন বেশ ভালো বিপাকে। গঙ্গা পাড়ি দিয়ে নদীর যে জায়গাটিতে মুঘল সেনাবাহিনী শিবির স্থাপন করেছে, তা অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমিতে ছিলো। বর্ষার বর্ষণ শুরু হয়ে যাওয়ায় এ ধরনের জায়গায় সেনাবাহিনীর অবস্থান করা কিংবা যুদ্ধের জন্য সৈন্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। মে মাসের ১৫ তারিখের বর্ষণে শিবির তো রীতিমত প্লাবিত হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে হায়দার মির্জা পরামর্শ দিলেন আরেকটু সামনে এগিয়ে কিছুটা উঁচু জমিতে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হোক।
১৫৪০ সালের ১৬ মে সম্রাট হুমায়ুন হায়দার মির্জার প্রস্তাব গ্রহণ করে শিবির গুটানোর নির্দেশ দিলেন। মুঘল আর্টিলারী বাহিনী আর শিবিরের কিছু অংশ স্থানান্তরের জন্য সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। মুঘল শিবিরের এই তৎপরতার খবর মূহুর্তের মাঝেই স্কাউটদের মাধ্যমে শের শাহের কাছে পৌঁছে গেলো। শের শাহ বুঝলেন এটাই সবচেয়ে ভালো সুযোগ মুঘলদের চেপে ধরার জন্য।
কনৌজের যুদ্ধে শের শাহের রণপরিকল্পনা খুব সহজ ছিলো। তিনি তার গোটা বাহিনী নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীকে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরবেন। শুধুমাত্র নদীর দিকটা খোলা থাকবে। যেন কঠিন পরিস্থিতি দেখলেই মুঘল যোদ্ধারা নদীপথে পালিয়ে যেতে উদ্যমী হয়।
৬
১৭ মে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মুঘল সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ চালালেন শের শাহ। যুদ্ধ শুরু হলে আক্রমণের প্রথম ধাক্কার প্রায় পুরোটাই গেলো মির্জা হিন্দালের উপর দিয়ে। আফগান বাহিনীর জালাল খান আর জালাল খানের ডানে থাকা সাহায্যকারী ইউনিটটি একযোগে হিন্দাল মির্জার ইউনিটকে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করে বসলো।
প্রথমে কিছুটা চাপে পড়ে গেলেও শেষপর্যন্ত মির্জা হিন্দাল এই আক্রমণ ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হলেন। হিন্দালের পাল্টা জবাবের ক্ষিপ্রতায় জালাল খানের আক্রমণটি ব্যর্থ হয়ে গেলো। জালাল খান তার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মরতে মরতে কোনোমতে বেঁচে গেলেন। তবে জালাল খানের পরাজয় ঠেকিয়ে দিলো তার অধীনস্ত জেনারেলরা।
ইতোমধ্যে দুই বাহিনীর অগ্রবর্তী দুটি ইউনিটই প্রচন্ড সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো। এখানে সমানে সমান লড়াই হচ্ছিলো।
তবে আফগান বাহিনীর আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় প্রচণ্ড চাপে পরে গেলো ইয়াদগার নাসির মির্জা আর কাসিম হুসেন সুলতানের ইউনিটটি। আদিল খানের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে তাদের ইউনিটটি ভেঙে গেলো। এই ইউনিট থেকে যোদ্ধারা পালিয়ে আচমকা মধ্যভাগে হুমায়ুনের নেতৃত্বাধীন ইউনিটে ভিড় করলে মধ্যভাগের শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
সুযোগ পেয়ে আফগানরা মুঘল সেনাবাহিনীকে ডান দিক থেকে আরো চেপে ধরে। ইতোমধ্যেই আফগান বাহিনীর দুই পাশে মোতায়েনকৃত সাহায্যকারী বাহিনী দুটি মূল যুদ্ধক্ষেত্রে এড়িয়ে মুঘল সেনাবাহিনীকে পেছন থেকে ঘিরে ধরলে মুঘলদের অবস্থা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে মুঘল সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। তড়িঘড়ি করে বাহিনীতে ভর্তি করা অদক্ষ যোদ্ধারা আতঙ্কে ছুটোছুটি করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলে।
শের শাহ এই যুদ্ধে মুঘলদের পূর্বপুরুষ সম্রাট বাবরের ব্যবহার করা তুর্কী কৌশল পার্থিয়ান শট বা তুঘুলামা কৌশলটি ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্র মুঘলদের জন্য আরো জটিল করে তোলেন। সম্রাট হুমায়ুনের তুলনামূলক নবীন যোদ্ধার আধিক্যে ঠাসা মুঘল সেনাবাহিনী এই কৌশলের সাথে তেমন একটা পরিচিত ছিলো না। ফলে দলে দলে মুঘল যোদ্ধারা মারা যেতে থাকলেন।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে এই জটিল, রক্তাক্ত আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝেও সম্রাট হুমায়ুন ধৈর্য্য আর বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ এক আফগান সৈন্যের আক্রমণে হুমায়ুনের ঘোড়া বিভ্রান্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে গেলো। হুমায়ুন বুঝে গেলেন, তাকে আরেকবার চৌসার যুদ্ধের ভাগ্যবরণ করতে হবে। তবে এবার আর তিনি তার জেনারেলদের হারাতে চান না।
তিনি আসকারি মির্জা, ইয়াদগার নাসির মির্জাসহ তার অন্যান্য জেনারেল আর আমিরদের একত্রিত করে পেছনে নদীর তীরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নদীতে কোনো বাহন পাওয়া গেলো না। সম্রাট তার ঘোড়াকেই নদীতে নামিয়ে দিলেন।
কোনো কিছু পরিষ্কার করে বোঝার আগেই মুঘলরা পরাজিত হয়ে গেলো! এমনকি মুঘলরা তাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্টিলারি ইউনিটকে ব্যবহার করার সুযোগটা পর্যন্ত পেলো না!
৭
সম্রাট হুমায়ুন ঠিক যেন চোখের পলকেই কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেলেন। না পারলেন কোনো রণপরিকল্পনা প্রদর্শন করতে, না পারলেন সেনাবাহিনী ঠিকমতো পরিচালনা করতে! এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুঘল সেনাবাহিনীর তুলনায় শের শাহের সেনাবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো আর শের শাহের রণপরিকল্পনাও উন্নত ছিলো। তাছাড়া আফগান বাহিনীর মনোবল আর নৈতিক অবস্থা মুঘল সেনাবাহিনীর চেয়ে এ যুদ্ধে বহুগুণে উন্নত ছিলো।
চৌসার যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকেই মুঘলরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলো। কিন্তু এই যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুনের পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ ছিলো বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনী আর অবস্থানগত অসুবিধা। মূলত অবস্থানগত বিপর্যয়ের কারণে আর্টিলারি ইউনিটের কামানগুলো কোনো গোলাই ছুড়তে পারেনি। অথচ, মুঘল সেনাবাহিনীর শক্তিস্তম্ভই ছিলো আর্টিলারি ইউনিটের এই কামানগুলো।
আরামপ্রিয় সম্রাট হুমায়ুন এ যুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে প্রচণ্ড বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। আফগানদের দুর্ধর্ষ আক্রমণে মুঘল যোদ্ধারা যখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলো, সম্রাট হুমায়ুন তখন একাই পাহাড়ের মতো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আফগানদের মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন। তবে তার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, কারণ তিনি আরেকবার চৌসারের মতো পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন।
কনৌজের যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুনের বীরত্বের প্রসঙ্গে শের শাহের জীবনীকার আব্বাস সারওয়ানী বলেছেন,
‘স্বয়ং সম্রাট যুদ্ধক্ষেত্রে তার অবস্থানে পাহাড়ের মতো অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এমন সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করলেন যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। কিন্তু যখন এক অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখলেন, তখন তিনি আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিলেন। অতিপ্রাকৃত এই যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে তিনি আগ্রা অভিমুখে ঘোড়া ছোটালেন। অক্ষত অবস্থায় তিনি রণাঙ্গন ত্যাগ করলেন, কিন্তু তার বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধাই গঙ্গার পানিতে ভেসে গেলো।‘
যা-ই হোক, সম্রাট হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধের মতোই কনৌজের যুদ্ধেও পরাজয় স্বীকার করে পিছু হটলেন। তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুললেন না। বিপুল সংখ্যক সেনা হারালেও তিনি তার ভাই আর জেনারেলদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদে টেনে বের করে আনতে পেরেছেন।
৮
কনৌজের যুদ্ধে পরাজয়ের পর যারা যারা জীবিত ছিলেন সম্রাট হুমায়ুন তাদের নিয়ে সোজা আগ্রার দিকে ঘোড়া ছোটালেন। পথে স্থানীয় বিদ্রোহীদের সাথে ছোটখাট সংঘর্ষ করতে করতে এগোতে হচ্ছিলো। কথায় আছে, হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। কনৌজে হুমায়ুনের পরাজয়ের সংবাদে স্থানীয় এসব বিদ্রোহীরা উৎসাহী হয়ে স্বয়ং হুমায়ুনের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিলো। তবে এসব বিদ্রোহীদের মাঝে সম্রাটের উপর অসন্তুষ্ট কৃষক বিদ্রোহীরাও ছিলো।
যা-ই হোক, শেষপর্যন্ত সম্রাট নিরাপদেই আগ্রা পৌঁছাতে সক্ষম হলেন। সম্রাট আগ্রা পৌঁছালেন বটে, তবে রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর সামান্য কিছু সৈন্য ছাড়া সেনবাহিনীর কেউ আগ্রা পৌঁছালো না। তারা আর কখনোই আগ্রা পৌঁছাবে না।
এদিকে কনৌজের যুদ্ধে বিজয়ের পর শের শাহ বরমজীদ গৌড়কে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে হুমায়ুনকে তাড়া করতে প্রেরণ করলেন। তবে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, হুমায়ুনকে আক্রমণ করা যাবে না। শুধু তাড়া করতে হবে।
এদিকে আগ্রা পৌঁছে সম্রাট হিসাব করে দেখলেন, আফগানদের আক্রমণের হাত থেকে আগ্রাকে রক্ষা করার মতো কোনো সৈন্যই তার হাতে নেই। প্রমাদ গুণতে লাগলেন হিন্দুস্তানের পরাশক্তি মুঘল সালতানাতের দ্বিতীয় সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন। তিনি বুঝে গেলেন, তাকে আগ্রা ছাড়তে হবে। মাত্র এক রাত আগ্রায় থেকে পরিবার আর কোষাগারের যতটা সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আগ্রার রাজপথে নেমে এলেন হুমায়ুন। তাকে এখনই আগ্রা ছাড়তে হবে, কিন্তু তিনি যাবেন কোথায়?
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫
২। তারিখ-ই-শের শাহ; মূল: আব্বাস সারওয়ানী, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: শের শাহ, অনুবাদক: সাদিয়া আফরোজ, সমতট প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৫
৩। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১৬
৪। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২
৫। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩
ফিচার ইমেজ: barmazid.com