সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন জাভি হার্নান্দেজ। ক্লাব ও জাতীয় দল ক্যারিয়ারে জেতেননি এমন কোনো ট্রফি অবশিষ্ট নেই। বার্সেলোনার হয়ে এবং স্পেনের হয়ে টিকিটাকা করে বিশ্ব মাতিয়েছেন।
জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন অনেক আগে। বার্সেলোনাও ছেড়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যে খেলছেন। তবে মূল চিন্তায় এখন কোচিং। খেলা দেখেন জাভি কোচের দৃষ্টি দিয়ে। সেই চোখেই বিশ্বকাপে স্পেন, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পরিণতি এবং মেসি ও নেইমারকে নিয়ে কথা বলেছেন এই মিডফিল্ডার।
স্পেন দলে প্রতিভার অভাব ছিলো না। কিন্তু আপনার কী মনে হয়, কেন তারা রাশিয়ায় এভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো?
প্রথম ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেকোনো জাতীয় দলের পক্ষে অন্য জাতীয় দলকে হারানোটা কঠিন; তা প্রতিপক্ষের মান যাই হোক না কেন। এটা স্রেফ ফুটবলীয় কথা। কিন্তু আমার মনে হয়েছে দল ভালোই শুরু করেছিলো। পর্তুগালের বিপক্ষে শুরুটা বেশ ভালো ছিলো। আমি ঐ ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখেছিলাম। আমি মনে করি, ছেলেরা প্রতাপ দেখিয়েই খেলেছে এবং বেশ ভালো ফুটবল খেলেছে; অল্প সময়ের জন্য হলেও। এরপর ওরা আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছে। আরেকটা ব্যাপার দলকে খুব ক্ষতিগ্রস্থ করেছে-লোপেতেগির চলে যাওয়া। কোচ বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার দুই দিন আগে রিয়াল মাদ্রিদের চাকরি নিতে চলে গেলেন। এটা খেলোয়াড়দের হজম করা কঠিন ছিলো।
আপনি কি এই ঘটনায় হতাশ হয়েছেন?
অবশ্যই। আমি যখন কোচেস ট্রেনিং কোর্স করছি, তখন রোজই লোপেতেগিকে দেখেছি। আমার মনে হয়েছিলো, এই মানুষটা এই কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করেছে। তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন। তিনি খেলোয়াড়দের ভালো চিনতেন। তার সময়ে গেলো দুই বছরে স্পেন বাছাইপর্বে একটি ম্যাচও হারেনি। বাছাইপর্বে স্পেন সত্যিই দারুন খেলেছে।
মনে হচ্ছিলো, সবকিছু লোপেতেগির নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি একজন ভালো নেতা। দলের অনেকেই আমাকে এটা বলেছে। সবাই তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট। এরপর টুর্নামেন্ট শুরুর দুই দিন আগে খবর এলো, তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিচ্ছেন! দেখুন, আমি মনে করি, তিনি বার্সেলোনা বা বেটিসে যোগ দিলেও একই ঘটনা ঘটতো। আমি মাদ্রিদের বিপক্ষে কিছু বলছি না। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে, এই ঘটনা দলের সুরটা নষ্ট করে দিয়েছে। আমি সেই ঘটনার পর যা বলেছি, আবারও বলছি-এটা খুব তাড়াহুড়ো করা সিদ্ধান্ত ছিলো, ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো এবং দল এটা ভালোভাবে নেয়নি।
স্পেনের খেলার ধরনে কোনো সমস্যা ছিলো?
দেখুন এই ‘বিনা কারণে বল পজেশন’ কথাটা উঠছে তো রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের কারণে। এটা ঠিক যে, আপনি সব ম্যাচে একই কাজ করতে পারবেন না। উদাহরণ হিসেবে পর্তুগালের বিপক্ষে কিন্তু আমরা মিডিয়া যেটাকে ‘টিকি টাকা’ বলে, সেটা ভালো খেলেছি। সেটা কাজে দিয়েছে। একই জিনিস আমরা রাশিয়ার বিপক্ষে করতে গিয়েছি। কিন্তু এমন কিছু দিন ফুটবলে আসবে, যখন আপনার কৌশল কাজে দেবে না। এমন কিছু দিন আসবে, যখন প্রতিপক্ষ আপনার কাজ কঠিন করে দেবে।
আপনার কি মনে হয়, এটা স্পেনের জন্য ঠিক পথ?
আমার কোনো সন্দেহ নেই এই যে টিকিটাকা বা আপনারা যা বলেন, এই পাসিং স্টাইল স্পেনের জন্য অবশ্যই সঠিক। এটা আমরা ১০ বছর আগে শুরু করেছি। কামাচাও, ইনাকি সায়েজ বা দেল বস্কের গোড়ার দিকের ঘটনা। তবে এটা আমরা লুই আরাগোনাসের অধীনেই বেশী খেলেছি। এই আইডিয়ায় অবশ্যই আমাদের শক্ত থাকতে হবে। আমরা যদি এখন ভিন্ন কোনো স্টাইলে খেলার চেষ্টা করি বা ভিন্ন ধারণায় যাওয়ার চেষ্টা করি, সেটা বিরাট একটা ভুল হবে। স্পেনকে এমন একটা পথে থাকতে হবে, যেখানে তার খেলোয়াড়রাই-ইসকো, বুস্কেটস, থিয়াগো, আসেনসিও-পথ ঠিক করে দেবে। এই খেলোয়াড়রা বল পায়ে রাখতে পছন্দ করে, তারা হাই প্রেস করে এবং নায়ক হয়ে উঠতে পছন্দ করে। আমি এভাবেই ব্যাপারটা দেখতে পছন্দ করি। তবে বুঝি যে, এটা দেখার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও আছে।
এবারের বিশ্বকাপ শুরুর আগে ব্রাজিল আপনার ফেবারিট ছিলো?
এটা সত্য। আমি মনে করেছিলাম, ওরা শারীরিকভাবে শক্তিশালী, ভালো সংগঠিত এবং ওদের কিছু ভেতরের লোক আমাকে বলছিলো, টিটের ক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু যেমনটা বললাম, বিশ্বকাপ আসলে খুব সমতাপূর্ণ একটি টুর্নামেন্ট। আর বেলজিয়াম সেদিন তুরুপের তাশটা দারুণ খেলেছে। হ্যাজার্ড তো অসাধারণ ছিলেন, ডে ব্রুইন খুবই বুদ্ধিমান।
জাতীয় দলের হয়ে আপনার শেষটা দুঃখজনক ছিলো। ২০১৪ বিশ্বকাপে স্পেনের শেষ ম্যাচে শুরুর একাদশেও ছিলেন না। ইনিয়েস্তার কষ্টটাও প্রায় একই রকম। আপনি কি তার কষ্টটা টের পাচ্ছেন?
হ্যাঁ, পুরোপুরি। আমি কোচিং সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে অনেক ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি বুঝতে পারি। আমার ব্যাপারে, আমি সেদিন হতাশ হয়েছিলাম। কারণ, আমি নিজেকে জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে দেখতাম। কিন্তু আমি এটা ভাবিনি যে, হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায় আমি কতটা খারাপ খেলেছি। এখন আমি ইনিয়েস্তার কষ্টটা আরও বেশি বুঝতে পারি। তিনি এই অনুভূতি নিয়ে গেলেন যে, তিনি আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি বুঝতে পারি, তার কতটা খারাপ লাগছে।
আপনি তার সাথে কথা বলেছেন?
হ্যাঁ, আমরা তো বন্ধু। আমি তার অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারছি। কারণ আমিও একই অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। এটা এমন ব্যাপার নয় যে, আপনি খুব সহজে হজম করে ফেললেন।
আপনার কি মনে হয় নেইমার খুব বেশি নাটকীয়তা করেছে?
তিনি এভাবেই খেলেন। অনেকদিন ধরেই এভাবে খেলছেন। আর এটা হঠাৎ করে বদলে ফেলার ব্যাপার নয়। আমি বুঝি যে, এতে কিছু সমস্যা হয়। অনেকে ভাবেন, তিনি খুব বেশি ডাইভ দিচ্ছেন। কিন্তু আপনি এর সমালোচনা করতে পারবেন না যে, তার চেষ্টার কমতি ছিলো বা ব্যক্তিত্বের অভাব ছিলো। তিনি সবসময় খেলোয়াড়দের মুখোমুখি হন এবং দলের ভার করেন। যিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন সেরকম একজনের চেয়ে আমি এরকম একজনকে দলে পেতে পছন্দ করবো।
বার্সেলোনায় কি কেউ কখনো নেইমারকে তার এই নাটকীয়তা নিয়ে কিছু বলেছে?
না। আমরা সবাই কী করছি, এটা বোঝার মতো যথেষ্ঠ বয়ষ্ক। আমাদেরকে মাঝে মাঝে যেটা করতে হয়েছে, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের অতি আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করতে হয়েছে।
আপনি কি মনে করেন, মেসির পর নেইমারই সবচেয়ে প্রতিভাবান?
এই মুহুর্তে তাই। হ্যাঁ, তিনি মেসি ও ক্রিস্টিয়ানোর পরিষ্কার উত্তরসূরী। এ ব্যাপারে তিনি এক নম্বর।
মেসির ব্যাপারে আসি। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ কেমন দেখলেন?
তারা চেষ্টা করেছে। তারা খুব খারাপ ফুটবল খেলেনি। কিন্তু আপনি যখন কোনো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে ফুটবল খেলবেন, তখন ভালো করা কঠিন। আমি স্পেনে এই অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি একসময়। কিছু লোক থাকে, যারা বল চায় না। এরা দলে অহেতুক চাপ তৈরি করে। আপনি মাঠে গিয়ে এইসব ব্যাপার নিয়ে ভুগতে পারেন না। আর্জেন্টিনা দলে এখন এমন একটা দুশ্চিন্তা ঢুকে গেছে যে, তারা ১৯৮৬ সালের পর থেকে আর বিশ্বকাপ জেতেনি; এটা বিরাট সমস্যা। এই জায়গা থেকে বের হয়ে পায়ে বল চাওয়া এবং সেখান থেকে ভালো করাটা খুব কঠিন।
আপনি লিওকে অন্যদের চেয়ে ভালো চেনেন। তিনি কি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলাটা উপভোগ করেন?
আমার মনে হয় না। তিনি বার্সেলোনার হয়ে যতটা আনন্দে খেলেন, আর্জেন্টিনায় ততটা না।
আপনার কি মনে হয়, আর্জেন্টিনার হয়ে এই বিধ্বস্থ হওয়াটা বার্সেলোনার মেসিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে?
সম্ভবত, হ্যাঁ। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, আপনি জীবনে সবকিছু, প্রতিটি জিনিস কখনো অর্জন করতে পারবেন না। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ওই প্রজন্মের (স্পেনের) আমরা সবাই সবকিছু জিতেছি। কিন্তু এটা স্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিক হলো, আপনার সবসময় কিছু না কিছু ঘাটতি থেকে যাবে। কিছু একটা থাকবে, যা আমরা অর্জন করতে পারবো না।
ফিচার ইমেজ: AS