‘কেনিয়া’ নামটা শুনলেই এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষের মনে দু’টো শব্দের উদয় হওয়ার কথা – ‘ক্রিকেট’ ও ‘আক্ষেপ’। যদিও কেনিয়া দেশটা কখনোই ক্রিকেটের প্রতিশব্দ ছিল না। বরং, সীমিত ক্রিকেটীয় প্রতিভার দেশটিতে এই খেলাটি খেলতই হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার। বোর্ডের অর্থকড়ি কিংবা অবকাঠামো – কোনোটাই ছিল না। এর মধ্যেই নব্বই দশকে একটু একটু করে বড় হচ্ছিল কেনিয়ার ক্রিকেট।
তবে দেশটির জাতীয় ক্রিকেট দল বড় বিস্ময়ের উপহার দেয় ২০০৩ সালে এসে। সেবার বিশ্বকাপের মঞ্চে ক্রিকেটের ইতিহাসে আইসিসির একমাত্র সহযোগী দেশ হিসেবে তারা পৌঁছে যায় বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। এমনকি সেমিফাইনালে স্বয়ং ভারতের বিপক্ষেও পাল্লা দিয়ে লড়েছিল দলটি!
বৈশ্বিক গণমাধ্যমে তখন একটা আলোচনা বেশ জোরেসোরেই চাউর হয়েছিল – শিগগিরই নাকি টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে চলেছে কেনিয়া। এর আগের বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলাদেশ যদি টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে পারে, তাহলে কেনিয়া কেন নয়?
যদিও কেনিয়া আদৌ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি। সেই না পাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। দেশটির ক্রিকেট অবকাঠামো বলতে তেমন কিছুই ছিল না। একমাত্র সম্বল বলতে ছিল নাইরোবির ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ক্রিকেট কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে বুঁদ হয়ে থাকতেন।
আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রচার ও প্রসার ছিল, যেমন জনপ্রিয়তা ছিল, সেটার ত্রিসীমানায়ও কখনো আসতে পারেনি কেনিয়া। কেনিয়ার ক্রিকেটের প্রসার, প্রচার ও জনপ্রিয়তা স্রেফ কয়েকটা পরিবার ও ক্রিকেট ক্লাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি অনেক ভেবে তাই কেনিয়াকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা আফ্রিকান ক্রিকেটীয় দেশটি চলে যায় চূড়ান্ত পতনের মুখে। আজ ক্রিকেট মানচিত্রেও তাদের খুঁজে বের করতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।
তবে এত কিছুর পরও এটা সত্যি যে, কেনিয়ার ক্রিকেটের সবেচেয়ে আলোঝরা সময়টা কখনোই মুছে যাবে না ক্রিকেটের ইতিহাস থেকে। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল একটা সোনালী প্রজন্মের সুবাদে। সোনালী প্রজন্মের বীর সেনানীরা প্রত্যেকেই নিজেদের সেরা খেলাটাই খেলেছেন সে সময়।
স্টিভ টিকোলো
কেনিয়ার ইতিহাসে তো বটেই, সহযোগী দেশগুলোর ইতিহাসেও এত বড় মাপের ক্রিকেটার আগে কখনো আসেননি। পারফরম্যান্স তার এতটাই ধারাবাহিক ছিল যে, ২০০৭ সালে তিনি আইসিসির বিবেচনায় সহযোগী দেশের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন। কেনিয়া জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন লম্বা সময়। ২০০৩ সালের রূপকথার বিশ্বকাপেও তিনিই ছিলেন দলপতি।
কেনিয়ার ক্রিকেটে টিকোলো পরিবার বেশ বিখ্যাত। স্টিভ টিকোলোর দুই ভাই টম ও ডেভিডও জাতীয় দলে খেলেছেন। স্টিভের ক্যারিয়ার মাত্র ১৩৫টি ওয়ানডে ও ১৫ টি-টোয়েন্টির হলেও তিনি জাতীয় দলে খেলেছেন প্রায় ১৮ বছর। তিনি এমনই একজন ফিগার ছিলেন যে, ২০১৩ সালে ৪২ বছর বয়সেও তাকে অবসর ভেঙে ফিরতে হয়েছিল জাতীয় দলে।
৩০-এর কাছাকাছি গড় নিয়ে ব্যাট করেছেন। বাংলাদেশের সাথে তার ক্যারিয়ারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এমনকি বাংলাদেশের ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও এক সময় নিয়মিত মুখ ছিলেন এই টিকোলো।
শেষবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন ২০১৪ সালে। যদিও আজও ক্রিকেটের সাথেই আছেন। জাতীয় দলের খেলোয়াড় কাম কোচ ছিলেন, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচিং করিয়েছেন। এখন তিনি উগান্ডার জাতীয় দলের কোচ।
আসিফ করিম
২০০৩ বিশ্বকাপের নায়ক। এর আগে অধিনায়কও ছিলেন। যদিও আসিফ করিম বাস্তব জীবনে ছিলেন একজন ইনস্যুরেন্সের এজেন্ট। সেই বিশ্বকাপের আগেই অবসরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বোর্ডের অনুরোধে অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন ক্রিকেটে।
নব্বই দশকে আসিফের স্লো লেফট আর্ম বোলিং বেশ কার্যকর ছিল। সেটা কতটা? উত্তর খুঁজতে বিখ্যাত সেই বিশ্বকাপের সুপার সিক্সের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটার কথা না বললেই নয়। সেদিন প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপে রীতিমতো কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আসিফ।
৮.২ ওভার বোলিং করেছেন। এর মধ্যে ছয়টাই ছিল মেইডেন ওভার। রান দিয়েছেন মাত্র সাতটা, উইকেট তিনটা। আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সেটা অন্যতম সেরা এক বোলিং ফিগার।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে সেমিফাইনাল হারের পরই আসিফ ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে এই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পথচলা।
আসিফের পরের প্রজন্মও ক্রিকেটে এসেছে। আসিফের ছেলে ইরফান করিম এখন কেনিয়া ক্রিকেট দলের নিয়মিত সদস্য।
মরিস ওদুম্বে
মরিস ওদুম্বের ক্যারিয়ারকে চাইলে কেনিয়া ক্রিকেটের সাথেই গুলিয়ে ফেলা যায়। সেই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে যখন পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল কেনিয়া, তখন সেই দলে ছিলেন ওদুম্বে। ওদুম্বে তখন অধিনায়ক। ১৫ রানে তিন উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরাও হন তিনি।
এখানেই শেষ নয়, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে কেনিয়ার অতিমানবীয় উত্থানের পেছনেও ছিলেন এই ওদুম্বে। ব্যাটিংয়ে ৪২ গড়ে রান করেছেন, অফ স্পিনে নিয়েছিলেন নয় উইকেটও।
সেই বিশ্বকাপের পর যেমন আস্তে আস্তে কেনিয়াও পতনের দিকে চলে যান, পতন হয় ওদুম্বেরও। ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যান তিনি। ২০০৪ সালে একজন বাজিকরের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি।
ফিরে ২০০৯ সালে ৪০ বছর বয়সে তিনি ঘরোয়া প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরেছিলেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে তিনি কিছুকালের জন্য কেনিয়া দলের কোচ হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
মার্টিন সুজি
১৯৯৭ সাল। মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠ। এক বলে দরকার এক রান। হাসিবুল হোসেন শান্ত কোনোক্রমে ব্যাটে বল লাগিয়েই দৌঁড় দিলেন। পূরণ হল এক রান। ব্যস, নিশ্চিত হল বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়!
এই দৃশ্যটা অমর হয়ে থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায়। সেদিন সেই শেষ ওভারটা করেছিলেন কেনিয়ার পেসার মার্টিন সুজি। তিনি কেনিয়ার ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পেসার। ৬৪ ওয়ানডে ম্যাচের ক্যারিয়ারে নিয়েছেন ৪৩ উইকেট।
১৯৯৬, ১৯৯৯ ও ২০০৩ – তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি। কেনিয়ার ক্রিকেটে সুজি ভাইয়েরা খুবই পরিচিত। মার্টিনের ছোট ভাই হলেন টনি সুজি। দুই ভাই মিলে ১৯৯৯ ও ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলেছেন।
ক্যারিয়ার শেষ করে মার্টিন ক্রিকেট কোচিংয়ে মন দেন। ২০০৭ সালে তাকে কেনিয়া দরের সহকারী কোচ করা হয়। ২০১১ সালে তিনি উগান্ডা দলের প্রধান কোচ হন। ২০১৮ সালে তিনি রুয়ান্ডা দলেরও কোচের দায়িত্ব পান।
থমাস ওদোয়ো
১৯৯৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় থমাস ওদোয়োর। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করেন ২০১৪ সালে গিয়ে। বলা যায়, কেনিয়ার ক্রিকেটের শুরু থেকে শেষ – পুরোটাই দেখেছেন তিনি।
পরিপূর্ণ একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ১৫৬টি উইকেট যেমন পেয়েছেন, তেমনি করেছেন এক সেঞ্চুরি ও আট হাফ সেঞ্চুরি। অবশ্যই কেনিয়ার ইতিহাসের সেরা বোলারদের একজন তিনি।
জাতীয় দলে থাকা অবস্থাতেই ২০১২ সালে তিনি কেনিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচিং করিয়েছেন। এরপর ২০১৬ সালে তাকে জাতীয় দলের অন্তর্বতীকালীন কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে সেই পদে তিনি স্থায়ী হন। ২০১৮ সালে ব্যর্থতার জের ধরে পদত্যাগ করেন কোচের পদ থেকে।
রবিন্দু শাহ
রবিন্দু শাহ ছিলেন চৌকশ একজন ক্রিকেটার। ভারতের গুজরাটের বংশদ্ভূত। ১৯৯৮ সালে তার অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। অভিষেকেই তিনি করেন ৫২ রান। হায়দারাবাদের সেই ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিখ্যাত। কারণ, মোহাম্মদ রফিকের ৭৭ রানের ইনিংসে ভর করে সেবারই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয় পায় বাংলাদেশ দল।
নব্বই দশকের শেষভাগ থেকেই কেনিয়া দলে নিয়মিত রবিন্দু শাহ। মিডল অর্ডারে তিনি নিজের ক্যারিয়ারে বেশ ভাল কিছু ইনিংস খেলেছেন। ১৯৯৯ ও ২০০৩ – দু’টো বিশ্বকাপেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্যাটিং ভরসার প্রতীক।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপও খেলেন তিনি। এরপরই ৩৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। এখন তিনি বেশ সফল ব্যবসায়ী।
কেনেডি ওটিয়েনো
বাকিদের তুলনায় তিনি ততটা পরিচিত মুখ নন। যদিও, তাকে কেনিয়া ক্রিকেটে প্রতিশব্দ বলা যায় ডানহাতি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে। কারণ, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল অবধি কেনিয়া জাতীয় দল যতগুলো ম্যাচ খেলেছে, তার মধ্যে কেবল তিনটি ম্যাচেই কেবল খেলেননি কেনেডি ওটিয়েনো ওবুইয়া। তার দুই ভাই কলিন্স ওবুইয়া ও ডেভিড ওবুইয়াও জাতীয় দলে খেলেছেন।
ক্যারিয়ার মাত্র ৯০ ওয়ানডে এবং ৪ টি-টোয়েন্টির হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ছিলেন ১৩ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে। অভিষেক সেই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে, জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০৯ সাল অবধি। এমনকি দলে জায়গা হারানোর পরও ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন আরো বছর তিনেক।