অবশেষে ইসরায়েলের কারাগার থেকে ৮ মাসের কারাবাস সম্পন্ন করে মুক্তি পেলেন ফিলিস্তিনি কিশোরী আ’হদ আল তামিমি। দখলদারিত্বের প্রতিবাদ করে আসা এই কিশোরী ফিলিস্তিনিদের কাছে যেমন প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন ইসরায়েলিদের মাথাব্যথার কারণ।
গত বছর ডিসেম্বরে এক সশস্ত্র ইসরায়েলি সেনাকে চড় ও লাথি মারার কারণে আটক করা হয় আ’হদকে। ১৫ ডিসেম্বরে ধারণ করা একটি অনলাইন ভিডিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ভিডিওটি ব্যাপকভাবে প্রচারের ফলে ভাইরাল হয়ে ওঠে এবং মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়।
ভিডিওটি ধারণ করেন তামিমির মা নারিমান। দখলকৃত ফিলিস্তিনের নবী সালেহ গ্রামে অবস্থিত তাদের পারিবারিক বাসভূমির সামনে এই ভিডিও ধারণ করেন তিনি। এরপর তার ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি প্রচার করা হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায় আ’হদ একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে লাথি ও চড় মারেন। গভীর রাতে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে ঘর থেকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে তারা গ্রেপ্তার করে তার মাকেও।
আ’হদ বিচারের পূর্বের এক শুনানিতে বলেছিলেন, তিনি সৈন্যদের উপর হামলা করেছেন কারণ তিনি তাদেরকে তার ১৫ বছর-বয়সী চাচাতো ভাই মোহাম্মদকে সেইদিন রাবার বুলেট দিয়ে মাথায় গুলি করতে দেখেন। এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায় তারা সৈন্যদেরকে আ’হদ তামিমির বাড়িতে পাঠায় কেননা সেখানে ফিলিস্তিনি তরুণরা সহিংস বিক্ষোভের আহ্বান জানানোর জন্য সৈন্যদের উপর পাথর নিক্ষেপ করছিল।
আ’হদের বিরুদ্ধে লাঞ্চনা, প্ররোচনা, সেনাদের কাজে হস্তক্ষেপ, পাথর নিক্ষেপসহ মোট ১২টি অভিযোগ আনা হয়। সেসময় তার বয়স ছিল ১৬ বছর। গত মার্চ মাসে দাখিল করা চার্জশিটে অপরাধ কমিয়ে আনার পর দোষী সব্যস্ত হলে তাকে ৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসে আটক করার পর থেকে তার শাস্তির সময় ধরা হয়, যা শেষ হলে গত ২৯ তারিখ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।
তার ট্রেডমার্ক কালো ও সাদা চেক আরব স্কার্ফ পরে আ’হদ বাড়ি ফিরে সেখানে জমায়েত হওয়া শুভকামনাকারীদেরকে অভিনন্দন জানান। ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক নিহত গ্রামবাসীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রতি আহ্বান জানান। পরে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা অব্যাহত রাখব এবং আমি আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করবো যেন সব আন্তর্জাতিক ফোরামে আমি আমার দেশের কথা জানাতে পারি ও বন্দিদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “কারাগার আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, আমি আমার স্বদেশের বার্তা প্রেরণ করার সঠিক উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছি।“
গত ডিসেম্বরে সেই ঘটনার পর ১৭ বছর বয়সী আ’হদ তামিমী ফিলিস্তিনিদের নায়ক হয়ে ওঠেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আ’হদকে ‘শান্তিপূর্ণ বেসামরিক প্রতিরোধের একটি নমুনা’ হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি জানান, এর মাধ্যমে আ’হদ বিশ্বকে প্রমাণ করে ফিলিস্তিনের মানুষ যেকোনো আত্মত্যাগের বিনিময়ে দৃঢ়তার সাথে স্থায়ীভাবে তাদের ভূমিতে অবস্থান করবে। আ’হদ ও তার মার সাথে সাক্ষাৎ করার পর তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফাকে এই বিবৃতি দেন।
আ’হদের ঘটনাটি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী অভিমতের সৃষ্টি করেছে। অনেক ইসরায়েলির মতে, আ’হদ তামিমি দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবার দ্বারা শোষিত। তাদের মতে আ’হদের পিতামাতা তার ছবি ব্যবহার করে ইসরায়েলি সৈন্যদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে। তার মা নারিমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্ররোচণা এবং হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। এদিকে এই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী তার চাচাতো ভাই নূরও আক্রমণের অভিযোগে অভিযুক্ত। ইসরায়েলের শিক্ষামন্ত্রী নফতালি বেনেট বলেছেন, আহাদ ও নূর তামিমিকে কারাগারে বন্দী অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করা উচিত।
নবী সালেহ গ্রামটির একাংশ দখল করে ১৯৭৭ সালে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী ইহুদিদের জন্য অবৈধ স্থাপনা ‘হালামিশ’ গড়ে তোলে। ইসরায়েলিদের ক্রমাগত ভূমি দখলের প্রতিবাদ করার জন্য নবী সালেহ গ্রামের ফিলিস্তিনিরা সংগঠিত হয় ও মিছিলের আয়োজন করে। এই নবী সালেহ গ্রামেরই ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী পরিবারের সন্তান আ’হদ আল-তামিমি। গ্রামের প্রতিবাদ-মিছিলগুলোর প্রধান সংগঠক ছিল আ’হদের বাবা বাসেম আল-তামিমি যাকে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়েছে। আ’হদের মা নারিমান তামিমিও গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৫ বার। এহেন পরিবারের সদস্য হয়ে আ’হদ বরাবরই ছোটবেলা থেকেই ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হওয়া আ’হদের মুখমণ্ডল রাস্তায় ম্যুরাল এবং পোস্টারে স্থান পেয়েছে। তার মুক্তির আহ্বানে তার বাবা কর্তৃক আয়োজিত একটি অনলাইন পিটিশন প্রায় ১৭ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
এদিকে আ’হদের মুক্তির আগেরদিন জেরুজালেম থেকে বেথেলহেমকে বিভক্তকারী দেওয়ালে তার প্রায় ১৩ ফুট একটি মুরাল আঁকার অভিযোগে দুই ইতালীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশ জানায়, বেথেলহেম এলাকার নিরাপত্তা বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত করার দায়ে সেই দুই ইতালীয় নাগরিক ও একজন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পূর্বে তারা গাড়িতে করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদের একজন নিজেকে ইটালীয় চিত্রশিল্পী জোরিট আগচ হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি শনিবার তার ইনস্টাগ্রাম থেকে সাহায্যের জন্য পোস্ট দিয়ে জানানা, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইসরায়েলি পুলিশ বলছে সীমান্ত পুলিশ গ্রেফতারকৃত দুই ইতালিয়ান শিল্পীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে যেতে হবে।
Featured Image Source: REUTERS/Mohamad Torokman