সুরের নয়জন দেবীর অন্যতম একজন ক্যালিওপি। তার পুত্র অরফিউস। অরফিউস ছোট থাকতেই তার চাচা তাকে উপহার দিয়েছিলেন সুরবাহার। মা সংগীতের দেবী, জন্মসূত্রে অরফিউস তাই গান ভালোবেসেছিল। তাকে সুরবাহার বাজাতে শিখিয়েছিল এপোলো স্বয়ং। শিষ্য গুরুকে অচিরেই ছাড়িয়ে গেল। অরফিউসের স্বর্গপ্রাপ্ত কণ্ঠ, আর সুরবাহারের আওয়াজ মিলেমিশে অমর নশ্বর সবকিছুকে তার পায়ের কাছে এনে ফেলতো। সে যখন সুরবাহার বাজাতো, ছুঁয়ে যাওয়া বাতাসেরা দাঁড়িয়ে পড়তো। গাছেরা শাখা দুলিয়ে তাল মেলাতো। বনের দেবীরা বিমূঢ় হয়ে থাকত, আর পাথরেরাও যেন ফিরে পেত প্রাণ।
তবে তাকে শুধু গানপাগল ভবঘুরে ভাবলে ভুল হবে। বরং সে মানুষকে কৃষির নতুন নতুন রাস্তা বাতলে দিত, ওষুধ আবিষ্কার করে রোগবালাই ঠেকাতো, ছিল ভাল জ্যোতির্বিদও। বন্ধুদের সাথে যখন তখন দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়ে পড়া তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। জেসন আর ৫৩ জন নাবিকের সেই বিখ্যাত গল্পে অরফিউসও ছিল। জেসনদের সাথে মিলে সে কোলচিস গিয়ে সোনার ঝালর চুরি করে আনে। গল্পে সোনার ঝালর চুরি করা সম্ভব হয়েছিল শুধু অরফিউসের জন্যই। কোলচিস এক দুর্গম জায়গা। সেখানে সাগরপথে পৌঁছাতে যত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়, তার একটা সাইরেনদের দ্বীপ। সাইরেনরা দ্বীপ থেকে নারীর বেশে মিষ্টি সুরে গান গায়। ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো নাবিকের কানে যদি এই সুর পৌঁছায় তবে কেল্লাফতে! সাইরেনরা তাদের ধরে মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে দেয়। জেসনদের জাহাজের নাবিকদের কানে যখন সাইরেনদের সুমধুর সুর গেল, তারা সব ভুলে পানিতে ঝাঁপ দিতে শুরু করলেন। অরফিউস আগে থেকেই তৈরি ছিল। সুরবাহারের তারে হাত বুলিয়ে সে বাতাসে তুললো সুরের মূর্ছনা। সেই সুর শুনে সাইরেনরাও গান গাইতে ভুলে গেল। তাদের জাদু গেল কেটে। নাবিকরা নিজেদের ভুল বুঝে জাহাজে ফিরে এলো।
ভয়ংকর বিপদ এড়িয়ে জাহাজ চললো কোলচিসের দিকে। কোলচিস পৌঁছেই তো শেষ না। সেখানে সোনার ঝালর পাহারা দিচ্ছে এক ড্রাগন, যে কি না জীবনে এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। তার সামনে গিয়ে অরফিউস সুরবাহার বাজানো আরম্ভ করল। ড্রাগন গেল ঘুমিয়ে, এই ফাঁকে জেসন আর তার সঙ্গীরা সোনার ঝালর চুরি করে নিয়ে এলো।
অরফিউস তার জীবন পার করছিল সুরের সাধনায়। ভালোবাসা তার জীবনে আসেনি তখনো। সেদিনও আর পাঁচটা দিনের মতো জঙ্গলে বসে সুরবাহার বাজাচ্ছিল সে। তাকে ঘিরে প্রাণী, মানুষ, দেবতা, আর পরীরা গান শুনছিল। চোখ খুলে অরফিউস দেখলেন সবাইকে। আর সবার ভেতর দেখলেন তাকে- সেই অপরূপ সুন্দর বনদেবী ইউরিডাইসকে, অরফিউসের গানের সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছুটে এসেছে। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে তাদের হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। এই বন্ধন বোঝানোর মতো কোনো ভাষা আজও আবিষ্কার হয়নি। সেই ভালোবাসা, সেই টান শুধু তারা দুজন বুঝতেন। শুভস্য শীঘ্রম, তাই দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।
দিনের পর দিন গিয়ে তাদের বিয়ের দিন চলে এল। অরফিউস আর ইউরিডাইসের খুশিতে প্রকৃতি আপ্লুত, দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন বর-কনের মাথায়। বিয়ের দেবতা স্বয়ং আশীর্বাদ দিলেন। বর-কনে আজীবন সুদিনে দুর্দিনে একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করল। খুশির জোয়ারে বেলা চলে যাচ্ছিল। গাছগুলোর ছায়া আরো দীর্ঘ হতে আরম্ভ করলে দেবতারা নবদম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যের পথ ধরলেন। অরফিউস আর ইউরিডাইসও বন ছেড়ে নিজেদের নতুন বাসার দিকে এগোল। ওদিকে বনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল আরিস্টেউস। এই মেষপালক আগে থেকেই পছন্দ করত ইউরিডাইসকে। অরফিউসের সাথে তার বিয়ের কথা শুনে সে বেজায় রেগে ছিল। ফন্দি এঁটেছিল যখন নবদম্পতি বনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে অরফিউসকে আক্রমণ করে খুন করবে সে। তারপর অপহরণ করবে ইউরিডাইসকে। পরিকল্পনামতো অরফিউস আর ইউরিডাইসকে দেখতে পেয়েই আরিস্টেউস আক্রমণ করলো। প্রাণ বাঁচাতে ইউরিডাইসের হাত ধরে ছুটতে লাগল অরফিউস। দৌড়াতে দৌড়াতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তারা। ওদিকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে তারা পাহাড়ের পথ বেছে নিল। ইউরিডাইস আর নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, বুক ফেটে যাচ্ছিল এতটুকু বাতাসের জন্য। পায়ের সাথে বোধহয় কেউ পাথর বেঁধে দিয়েছে। একসময় ফসকে গেল ইউরিডাইসের হাত। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে সে গিয়ে পড়ল এক সাপের বাসায়। অরফিউস গগনবিদারী আর্তনাদ করে ছুটে এলো নিচে। কিন্তু ততক্ষণে বিষাক্ত সাপের ছোবলে নীল হয়ে গেছে ইউরিডাইস। তাদের স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালজয়ী প্রেম পরিণতি পেল না। পৃথিবী কাঁদিয়ে ইউরিডাইস চলে গেল পাতালে, মৃত্যুপুরীতে।
ইউরিডাইসের বিরহে কাতর হয়ে অরফিউস মৃতের মতো হয়ে গেল। সুরবাহারের তারগুলো আর বাজত না। গানের অভাবে কাঁদত বনের পশুপাখি। অরফিউস ঠিক করলেন এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। যেভাবেই হোক তিনি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনবেন মৃত্যুপুরী থেকে। হয় ইউরিডাইস পৃথিবীতে ফিরে আসবে, নতুবা ইউরিডাইসহীন এই পৃথিবীর কোনো দাম নেই অরফিউসের কাছে। বাবা এপোলো তাকে পাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পাতালের দেবতা হেডিসের সাথে কথা বললে যদি কিছু হয়!
পাতালপুরীতে যাবে অরফিউস, সে তো সোজা কথা নয়। পদে পদে তার ভীষণ বাঁধা। অস্ত্রশস্ত্র কি নেবে সাথে? সে তার সেরা অস্ত্র দুটি নিয়ে রওনা দিল, তার সুরবাহার আর কণ্ঠস্বর। পাতালের পথে যেতে পড়ে এক নদী। সেই নদীতে নৌকা বায় পাতালপুরীর লোক। জীবিত কোনো মানুষ এ পথ মাড়ায় না। এই নৌকায় তাদের চড়ার প্রশ্নই আসে না। নৌকায় করে শুধু মৃতদের আত্মাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অরফিউস সুরবাহারে ঝংকার তুলল, গেয়ে শোনাল সেই দুঃখের গান। তার আর তার প্রিয়তম ইউরিডাইসের অকাল বিচ্ছেদের গাঁথা। এই গানে কাঁদল মাঝি, তাকে পৌঁছে দিল পাতালের দ্বারে। বলল, “শোনো হে অরফিউস, তোমায় আমি পৌঁছে দিচ্ছি পাতালের দ্বারে, কিন্তু এখান থেকে কেউ কখনো ফেরত যায় না। দরজাতেই তোমার সাথে দেখা হবে সারবেরাসের। সারবেরাসের নাম শোনোনি? পাহাড়ের মতো তিন মাথাওয়ালা কুকুর। সে-ই তোমায় শেষ করে দেবে। তোমার সাথে আবার যেন দেখা হয়, সেই কামনাই রইল”।
পাতালের দ্বারে গনগনে আগ্নেয়গিরির মতো চোখ নিয়ে ছিল পাহাড়সম কুকুর সারবেরাস। তার নিঃশ্বাসের ভাপে আশেপাশের ঘাস পুড়ে ছাই। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। যেদিন থেকে ইউরিডাইস চলে গেছে, অরফিউসের পৃথিবীতে একটাই অনুভূতি ছিল, তার নাম দুঃখ। তাই সারবেরাসকে দেখে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না সে। বরং তাকেও গেয়ে শোনাল করুণ গান। সারবেরাস পোষা কুকুরের মতো লুটিয়ে পড়ল, যেন মালিকের বেদনায় সে-ও ব্যথিত। প্রভুভক্ত সারমেয়র মতো রাস্তা ছেড়ে দিল সে।
পাতালপুরীতে চারদিকে মৃতের আত্মাদের ছড়াছড়ি। কোথাও আনন্দের সুবাস, কোথাও যন্ত্রণার চিৎকার। অরফিউসের চোখ খুঁজছিল স্ত্রীকে। এর মাঝে কোথায় আছে ইউরিডাইস? কেমন আছে, কে জানে। ইউরিডাইস দেবী, তার তো মৃত্যুর পর সুখ। তবুও হয়তো তারই মতো সারাদিন কেঁদে বেড়ায়। এসব ভাবতে ভাবতে অরফিউস পৌঁছালো হেডিসের কাছে। মৃতদের সর্দার তিনি। পাশেই বসে ছিলেন তার স্ত্রী পার্সিফনি। অরফিউস গানে গানে শোনালো তার আবেদন। যদি ইউরিডাইস না থাকে, তবে কেন অরফিউস থাকবে? কেন গান গাইবে? পার্সিফনির চোখে পানি এল, হেডিসের মন গলল। তিনি আবেদন মঞ্জুর করলেন। বললেন, “অবুঝ অরফিউস, মৃত্যুর জগত থেকে কখনো কেউ ফিরে যায় না। তোমার সঙ্গীত আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে তার বিনিময়ে আমি তোমাকে তোমার স্ত্রী ফেরত দিলাম। কিন্তু একটা ছোট্ট কাজ। ধৈর্য ধরতে হবে তোমায়। তুমি পাতালের ঐ রাস্তা দিয়ে আলোকিত পৃথিবীর দিকে উঠে যাবে। পেছনে উঠবে ইউরিডাইস। পৃথিবীতে না পৌঁছানো পর্যন্ত পেছন ফিরে তাকাতে পারবে না তুমি। যদি তাকাও, তবে চিরদিনের জন্য ইউরিডাইস আবার মৃত্যুপুরীতে ফিরে আসবে। আর জীবিত অবস্থায় তুমিও এই পৃথিবীতে আর প্রবেশ করতে পারবেনা। অরফিউস শর্ত মেনে নিল।
ঢালু রাস্তার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে অরফিউস বুঝল তার পিছনে কোনো একটা ছায়া হেঁটে আসছে। কিন্তু সে পিছনে ফিরল না। হাঁটতে থাকল। কিন্তু রাস্তা যে শেষ হয় না। এদিকে অরফিউসের মনে সন্দেহ ঘনিয়ে উঠছে। পিছনের ছায়ামানব আসলেও কি ইউরিডাইস? হেডিস তাকে ঠকায়নি তো? সে জানে, জীবিত অবস্থায় আর মৃত্যুপুরীর কড়া নাড়তে পারবে না, এমনকি এই সুরবাহার দিয়েও। রাস্তা যত কমছিল অরফিউস তত অধীর হচ্ছিল। রাস্তার শেষ প্রান্তে আলোর মাঝে এসেই অরফিউস খুশিতে পেছনে ফিরে চাইল। কিন্তু হায় অরফিউস! হায়! এ তুমি কী করলে? ইউরিডাইস যে তখনো পাতালপুরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুলোকের অনিবার্য টান প্রায় শরীর পেয়ে যাওয়া ইউরিডাইসকে টেনে নিয়ে চলল গভীরে। অরফিউস চেষ্টা করল ইউরিডাইসকে আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু এ যেন হাতের মুঠোয় পানিকে চেপে ধরার চেষ্টা। ফিসফিস করে ইউরিডাইসের আত্মা বললো, “বিদায় প্রিয়তম!” পাতালের দরজা অরফিউসের মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল।
জিউস হার্মিসকে পাঠিয়েছিলেন, যেন অরফিউস আর পাতালে ঢোকার চেষ্টা না করে। অরফিউস জীবন্ত লাশ হয়ে গেল। সে কথা বলতো না, নড়তো না, পাশে পড়ে থাকতো সুরবাহার। জঙ্গলের মাঝে তাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে প্রকৃতিও বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিল। নারীরা অরফিউসে মুগ্ধ ছিল। ইউরিডাইসের প্রেম ভুলে অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সবাইকে ছেড়ে ইউরিডাইসকে বিয়ে করায় তাদের অপমান হয়েছিল বটে। একদল নারীভক্ত তার গান শুনতে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠছিল। অরফিউসের কাছে এসে তারা কাঠ আর পাথর ছুঁড়ে মারল। অরফিউস নির্বিকার ছিল, তার মন জুড়ে শুধু গভীর শোক। তারপর তারা অরফিউসকে কেটেকুটে খুন করে ফেলল। তার মাথা আর সুরবাহার ধরে ফেলে দিল নদীতে। সুরবাহারের সাথে অরফিউসের কাটা মাথা ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছাল গানের দেবীদের দ্বীপে। সেই দ্বীপে ক্যালিয়োপিও ছিলেন। তারা অরফিউসকে সসম্মানে সমাধিস্ত করল। অরফিউসের কবরে দিনরাত গান গাইল বুলবুলিরা। আর তার আত্মা খুশি নিয়ে পৌঁছাল মৃত্যুপুরীতে, সেখানে আছে তার প্রিয়তম ইউরিডাইস। দুবার হারিয়েছে তাকে, আর কখনো হারাতে দেবে না, মৃত্যুতেই অমর হয়েছে অরফিউস-ইউরিডাইসের প্রেমগাঁথা।
ফিচার ইমেজ সূত্র: Text Adventures