থাইল্যান্ডের থাম লুয়াং গুহা থেকে ১৭ দিন আটকে থাকার পর জুনিয়র ফুটবল দলের ১২ জন সদস্য ও তাদের কোচকে উদ্ধারের ঘটনা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। গত ২৩ জুন খুদে ফুটবলারদের এই দলটি তাদের কোচের সাথে গুহার ভেতরে ঘুরে দেখার সময় হঠাৎ করে আসা ঝড়-বৃষ্টির কারণে গুহার প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে পানি বাড়তে থাকলে ওয়াইল্ড বোরস ফুটবল দলের এই কোচ ও সদস্যরা আটকা পড়ে যায়। ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পরে গত ২ জুন তাদের সন্ধান পায় উদ্ধারকারী দল। তবে সন্ধান পেলেও তাদেরকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি তখনও। গুহার সরু পথ ও বন্যার কারণে তাদেরকে বের করা বেশ বিপজ্জক ছিল। উদ্ধারকারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে অক্সিজেন ও খাবার সরবরাহ করেন এরপর। অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে একজন থাই নেভি ডাইভার মৃত্যুবরণও করেন। এতেই ধারণা করা যায়, তাদের উদ্ধারকাজটি কতটা কঠিন ছিল। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে উদ্ধারযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন অসীম সাহসী উদ্ধারকর্মীরা।
তাদের কীভাবে উদ্ধার করা হলো?
পানিতে তলিয়ে যাওয়া সরু পথ দিয়ে উদ্ধারকারী ডুবুরীরা শ্বাসগ্রহণকারী বিশেষ সরঞ্জাম নিয়ে আটকা পড়া ছেলেদের কাছে পৌঁছায়। তাদেরকেও একই পথ দিয়ে বের করে নিয়ে আসতে হয়, যে কাজটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডুবুরি না হলে কারো পক্ষে প্রায় অসম্ভবই ছিল।
প্রতিটি ছেলেকে দুজন করে ডুবুরি বের করে নিয়ে আসেন। বের করে আনার সময় প্রতিটি ছেলেকে একজন ডুবুরি নিজের সাথে নিয়ে এবং অপরজন তাদের পেছনে পেছনে সাঁতার কেটে আসেন। সংকীর্ণ জায়গাগুলোতে তাদেরকে এয়ার ট্যাঙ্ক খুলে আগে ছেলেদেরকে সেই পথ দিয়ে বের করে দিতে হয় এবং তারপর এয়ার ট্যাঙ্ক বের করে দিতে হয়। বের করে আনার আগে কিশোরদের উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তদের প্রত্যেককেই পুরো মুখের জন্য মাস্ক দেওয়া হয়, কেননা শিক্ষানবীশ ডুবুরিদের জন্য এটিই সুবিধাজনক হবে বলে মনে করা হয়।
অনেকের মতেই, ডুবুরিদের মাধ্যমে খুদে ফুটবলারদের গুহা থেকে বের করে আনার পরিকল্পনাটি খুব বিপজ্জনক ছিল। তবে ব্রিটিশ ডুবুরির দল জানান, বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে গুহায় আরও পানি ও আবর্জনা ঢুকে যাওয়ার কারণে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই ছেলেদের বের করে আনতে চান তারা। কেভ ডাইভিং গ্রুপের চেয়ারম্যান মার্টিন গ্রাস বলেন, “এটি একটি বোনাস হতে পারে যে তারা ছিল তরুণ। তরুণরা নিজেদের অপরাজেয় বলে মনে করে এবং তারা এটিকে একটি সাহসী অভিযান হিসেবে দেখতে পারে।“
সরু পথের কতটুকু অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে তার উপর নির্ভর করে ছেলেরা ফেরার পথে একবারে প্রায় ১২-১৫ মিনিট পর্যন্ত পানির নিচে কাটিয়েছে। প্রবেশ পথে ফিরে আসার প্রতিটি যাত্রায় প্রায় কয়েক ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়।
৮ জুলাই স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় উদ্ধারকাজ শুরু হয়। এরপর আনুমানিক ৫টা ৪০ মিনিটে একজন বালক প্রথম গুহার বাইরে আসতে পারে। এরপর ৭টা ৪৭ মিনিট নাগাদ আরও তিনজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন ডুবুরিরা। এরপর চারজনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতের বেলা উদ্ধারকাজ বন্ধ করে পরদিন সোমবার আবার উদ্ধারকাজ শুরু করা হয়। সেদিন আরও ৪ জন ছেলেকে বের করে আনেন ডুবুরীরা।
বন্যা কমাতে পানির পাম্পিং অব্যাহত রাখা হয়। এই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারী চিয়াং রাইয়ের প্রাদেশিক গভর্নর নরোংসাক ওসটানাকর্ন তখন জানান, ভেতরের পানির উচ্চতা তখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। ওই সপ্তাহে গুহার ভেতরে আগের তুলনায় আরো বেশি অঞ্চলে হাঁটাচলা করা সম্ভব ছিল বলে জানা যায়। ডুবুরি কয়েকশত এয়ার ট্যাঙ্ককে গুহায় নিয়ে গিয়ে ভেতরে এক জায়গায় একটি বেস ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ ৪ জন ছেলে ও তাদের কোচকে মঙ্গলবার বের করে আনা হয়।
গুহার ভেতর ফাঁকা করার জন্য অনবরত পানি পাম্পিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। তবে যতই পানি বের করে আনা হচ্ছিল বিভিন্ন পথে ঝর্ণার পানি ততই ভেতরে প্রবেশ করছিল। কর্তৃপক্ষ বন্যার পানি নিষ্কাশন করতে সাহায্য করার জন্য গুহার দেয়ালে গর্ত করারও চেষ্টা করেছিল। তবে কঠিন ও পুরু শিলার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
সেখানে কী ধরনের বিপদের আশঙ্কা ছিল?
ছেলেগুলোর বয়স ছিল ১১-১৭ বছর ও তাদের কোচের বয়স ২৫ বছর। তারা গুহার ভেতর একটি ছোট শিলার উপর নির্ভর করে অবস্থান করছিল। পরিবেশটি সম্পূর্ণ ভেজা থাকায় তাদের উষ্ণ এবং শুকনা রাখা দরকার ছিল। তাদের হাইপোথার্মিয়া হওয়ারও ঝুঁকি ছিল।
ছেলেগুলো যেখানে আটকা পড়েছিল, সে স্থানের বায়ুর অক্সিজেন স্তর সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন ছিল। কর্মকর্তারা এক সময় জানান, বায়ুতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে ১৫% দাঁড়িয়েছে যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা হলো ২১%। উদ্ধারকারীরা বায়ু সরবরাহের উন্নতিতে সহায়তা করতে গুহায় প্রায় ১০০টি অক্সিজেন ট্যাংক স্থানান্তর করেন।
থাই ডাইভার পি.ও. সামান ট্যাংকের স্থানান্তর করার জন্য সাহায্য করেছিলেন। তিনি ফিরে আসার পথে সমস্যার সম্মুখীন হন এবং তখন নিজের জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন ছিল না। ফলে পথের মধ্যে চেতনা হারিয়ে ফেলেন। তার সহকর্মীরা তার জ্ঞান ফেরাতে পারেননি। তিনি অক্সিজেন সরবরাহ করতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবেই মৃত্যুবরণ করেন।
গুহার ভেতরে তারা কী ধরনের সাহায্য পেয়েছিল?
বিশুদ্ধ পানি ও প্যারাসিটামলসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। থাই নৌবাহিনীর বিশেষ বাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল আর্পাকর্ন ইউকুংকাও বলেন, তাদেরকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সাথে সহজে হজম হয় এমন উচ্চশক্তির খাবার খাদ্য দেয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা বলছেন, বেশিরভাগ সদস্যই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে, যদিও কেউ কেউ দুর্বল বা ছোটখাট আঘাত পেয়েছিল।
ছেলেদের কাছে হয়তো মোবাইল ফোন বা টর্চ লাইট ছিল। তবুও তারা গুহার ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারে বসে ছিল। তখন উদ্ধারকারী দল ভেতরে আলোর ব্যবস্থা করে এবং তাদের সঙ্গ দিতে থাকে। ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ডুবুরিরা তাদের মানসিক অবস্থা শক্ত রাখতে সাহায্য করেছিল।
ফুটবল বিশ্বকাপ খেলোয়াড়দের অভিনন্দন
গুহায় আটকে পড়া ছেলেদের খবর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের খেলোয়াড়দের কাছে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা উদ্ধারের খবরটিকে স্বাগত জানান এবং টুইটারে ‘ওয়াইল্ড বোর’ ফুটবল দলের সদস্যদের শুভেচ্ছা জানান।
ফ্রান্সের ফুটবলার পল পগবা গত মঙ্গলবার বেলজিয়ামকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে যাওয়ার টুইটারে টুইট করে জানান, “এই বিজয় আজকের বীরদের জন্য, তোমরা খুব ভালো করেছো, তোমরা অনেক শক্তিশালী।”
ম্যানচেস্টার সিটি এবং ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার কাইল ওয়াকার জানান, তিনি ছেলেদের শার্ট পাঠাতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “দারুণ খবর যে থাই বাচ্চারা সব গুহা থেকে নিরাপদে বের হতে পেরেছে।”
জুনিয়র ফুটবল দলের সদস্যদের এই উদ্ধারে শুধু থাইল্যান্ডবাসীই নয়, পুরো বিশ্বের মানুষ খুশি হয়েছে। ‘থাই কেইভ রেসকিউ’ শব্দগুলোর জন্য মঙ্গলবার গুগল অনুসন্ধান ৩৫৯ মিলিয়ন ফলাফল প্রকাশ করে। এতেই অনুমান করা যায়, সারা বিশ্বের মানুষ তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।
ফিচার ইমেজ: Reuters/Soe Zeya Tun