Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আভিজাত্যের সাথে অভিজ্ঞতার লড়াই  

১.

কাজটা বোধহয় তাহলে ইংল্যান্ড ঠিকই করেছে? জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়াতে আর আর্জেন্টিনা গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে যাওয়াতে ফাইনালের পথে এক দিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল ছিল শুধুই স্পেন। ইংল্যান্ড আর বেলজিয়ামের মাঝে যে গ্রুপ রানার্স আপ হবে তার জন্যই রাস্তাটা তুলনামূলকভাবে সহজ মনে হচ্ছিল। বেলজিয়াম আর ইংল্যান্ড দুই দলেরই শেষ ম্যাচের আগে পরের পর্ব নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় দুই দলই নেমেছিল দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে। তাতে বেলজিয়াম জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় হেরেও লাভবান হয়েছে ইংল্যান্ডই। যদিও ইংল্যান্ড কখনোই স্বীকার করেনি যে তারা ভালো প্রতিপক্ষ এড়াতে ইচ্ছে করে হেরেছে, বরং তাদের দাবি ছিল খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেবার জন্যেই তাদের এই পন্থা অবলম্বন। কিন্তু মিডিয়া ঠিকই ধরে নিয়েছে, কাজটা ছিল ইংল্যান্ড ম্যানেজম্যান্টের ইচ্ছেকৃতই।

যদিও বিশ্বকাপে সহজ প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই, তবুও ‘কোয়ার্টারে ব্রাজিল আর সেমিফাইনালে ফ্রান্স’ সম্ভাব্য এই রাস্তার চাইতে ‘কোয়ার্টারে সুইডেন আর সেমিফাইনালে স্পেন’ এর রাস্তাটাই তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। এর আগের বিশ্বকাপগুলোতেও ইংল্যান্ড এর চাইতে ভালো স্কোয়াড নিয়েও তুলনামূলক ভালো দলের কাছে হেরেই বাদ পড়েছে। ২০০২ সালে বেকহাম, ওয়েনদের প্রজন্ম হারে ব্রাজিলের কাছে এবং ২০০৬ সালে জেরার্ড, ল্যাম্পার্ডদের প্রজন্ম হারে জার্মানির কাছে। সুযোগ থাকলে সেটা নেওয়াটা কখনোই দোষের কিছু নয়।

দুর্দান্ত প্রজন্ম পেয়েও ইংল্যান্ড মাঝে সফলতা পায়নি; Image Source: Cavalry Football

দ্বিতীয় পর্বেই স্পেন বাদ পড়ে যাওয়াতে ইংল্যান্ডের রাস্তাটা আরেকটু সহজ হয়ে গেল। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যদি কাউকে প্রশ্ন করা হতো যে নক আউটে স্পেন আর ক্রোয়েশিয়ার মাঝে কোন প্রতিপক্ষকে বেছে নিতে চায় তাহলে যে কেউই চোখ বন্ধ করে ক্রোয়েশিয়াকে বেছে নিত। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে শেষ পর্যায় পর্যন্ত যাবার জন্য ভালো খেলার সাথে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোনো পর্বেই ভুল না করা। স্পেন, ব্রাজিল কিংবা জার্মানির কিছু ভুলই তাদেরকে এই রাস্তা থেকে ছিটকে দিয়েছে। ইংল্যান্ড এখন পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের ভুল করেনি। আজকের ম্যাচেও সেই ধারাটা ধরে রাখতে পারলে আছে ৫২ বছর পর ফাইনাল খেলার হাতছানি। তবে সহজ প্রতিপক্ষ মানেই জেতার নিশ্চয়তা নয়, সেটা কেবলই একটা সুযোগ। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেই কোনো অর্জন হয়তো সম্ভব। ‘দক্ষিণ কোরিয়ার মতো তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জিতলেই জার্মানির জন্য দ্বিতীয় পর্ব’– এত সহজ সমীকরণ নিয়েও দিন শেষে তারা হেরে গেছে ২-০ গোলে।

নির্দিষ্ট দিনে কোনো দল ভালো কিংবা খারাপ- কেমন খেলল সেটার উপরেই জয়-পরাজয় নির্ভর করে। কাজেই ফাইনাল যেতে হলে আপাতত ইংল্যান্ডকে একটা কাজই করতে হবে– ভালো এবং কার্যকরী ফুটবল খেলা।

২.

সমস্যা হচ্ছে, ক্রোয়েশিয়াও একটি ঐতিহাসিক পটভুমির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা যে সোনালি প্রজন্মটা পেয়েছে, তাতে একটি বিশ্বকাপ পেলে অর্জনটা পূর্ণ হয়। তবে বিশ্বকাপ জেতার আগে তো আগে ফাইনালে যেতে হবে। এর আগেও ১৯৯৮ সালে ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনাল খেলেছে। তাতে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রথম ১ গোল করে এগিয়ে গেলেও পরপর ২ গোল করে ম্যাচটা ফ্রান্সই জিতে নেয়। পরে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জনটা করাটাই এই পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসের সেরা অর্জন। যে বিশ্বকাপে জার্মানির মতো দল প্রথম পর্বে, আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় পর্বে এবং ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়ে, সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা অবশ্যই একটি বিশাল অর্জন। তবে ক্রোয়েটরা অবশ্যই চাইবে, এখানেই সন্তুষ্ট না থেকে পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যেতে।

ডেভর সুকারের পারফর্মেন্সে ক্রোয়েশিয়া পৌছে গিয়েছিল স্বপ্নের খুব কাছে; Image Source: Fifa World Cup 2018

কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে বিশ্বকাপে ভাগ্যদেবী কেন যেন সবসময় অভিজাত দলদের দিকেই মুখ তুলে তাকায়। সেই হিসেবে ক্রোয়েটদের পারার কথা না ইংল্যান্ডদের বিপক্ষে। মুখোমুখি লড়াইয়েও ইংল্যান্ডরা বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে। ইংল্যান্ড এবং ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হওয়া ৮টি ম্যাচের মাঝে ইংল্যান্ডের জয় ৪টি, ক্রোয়েশিয়ার জয় ২টি এবং ২টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। বড় টুর্নামেন্টে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে একবার, ২০০৪ ইউরোতে। সেখানে ইংল্যান্ড জয় পেয়েছে ৪-২ গোলে।

তবে আভিজাত্য কিংবা ইতিহাসে ইংল্যান্ড এগিয়ে থাকলেও বিস্ময়করভাবে অভিজ্ঞতায় ইংল্যান্ডের এই দলের চেয়ে ক্রোয়েশিয়ার দলটাই এগিয়ে। ক্রোয়েশিয়ার স্কোয়াডের অন্তত ৬ জন খেলোয়াড়ের ৫০টির অধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেখানে ইংল্যান্ডের স্কোয়াডের এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা মাত্র ১ জন। এই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ৮ জন খেলোয়াড় গোল করতে পেরেছেন। একমাত্র বেলজিয়ামই এই ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে এগিয়ে আছে (৯ জন)। এছাড়া ইংল্যান্ডের এই দলের মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা আছে, যেখানে ক্রোয়েশিয়ার তিনজন খেলোয়াড়ের রয়েছে অন্তত ৬ বার ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা। বড় ম্যাচের অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকাটাই কি শেষপর্যন্ত কাল হবে ইংল্যান্ডের জন্য?

৩.

বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচগুলোতে জয় পাওয়ার জন্য খুব ভালো খেলার সাথে ভাগ্যেরও একটু সহায়তা প্রয়োজন। যে সহায়তাটা এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল কিংবা স্পেন পায়নি,  ফ্রান্সের এখন পর্যন্ত সেভাবে পাওয়ার প্রয়োজন হয়নি, ইংল্যান্ড কিছুটা পেয়েছে কিন্তু এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পেয়েছে ক্রোয়েটরাই। ১৯৯০ বিশ্বকাপের পর ক্রোয়েশিয়াই একমাত্র দল, যারা বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে দু’বার জিতেছে টাইব্রেকারে। প্রবাদে আছে, ‘ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে’। তবে সেই পক্ষপাতটা কতদিন করে সেটাই প্রশ্ন।

লুকা মদ্রিচের উপর অনেকখানিই নির্ভর করছে ক্রোয়েশিয়ার সাফল্য; Image Source: SPORTbible

দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে কিছু ব্যক্তিগত লড়াইও হবে। গোল্ডেন বল জয়ের লড়াইয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী লুকা মদ্রিচ, এদিকে হ্যারি কেইনেরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। যার দল ফাইনাল যাবে, তারই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

পরিসংখ্যানের বিচারে কেইনের ৬ গোলের বিপরীতে মদ্রিচের ২ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট থাকলেও অন্যান্য দিকে মদ্রিচ কিন্তু যথেষ্টই এগিয়ে। মদ্রিচের মোট পাসের ৮৬ শতাংশ সঠিক, যেখানে তার চেয়ে এগিয়ে মাত্র দুজন; টনি ক্রুস (৯৩%) এবং ডেভিড সিলভা (৮৭%)। এছাড়া প্রতিপক্ষের সাথে দ্বৈরথে মদ্রিচ জয়ী হয়েছেন ৩৫ বার, যেখানে তার চেয়ে এগিয়ে শুধুমাত্র ফ্রান্সের পগবা (৩৯ বার)।

তাছাড়া মদ্রিচের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, তিনি দলের চাহিদা অনুযায়ী নিজের খেলার স্টাইল পাল্টে ফেলতে পারেন। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে তিনি বল স্পর্শ করেছেন ৬২ বার আর ৪২টি পাস সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু রাশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি বল স্পর্শ করেছেন ১৩৯ বার এবং পাস সম্পন্ন করেছেন ১০২ টি। আজকের প্রয়োজনটা কীভাবে মেটান মদ্রিচ, সেটাই দেখার বিষয়।

হ্যারি কেইনের ফর্ম ধরে রাখতে হবে আরো দুইটি ম্যাচে; Image Source: The Independent

ইংল্যান্ডের আরেকটি শক্তির জায়গা হচ্ছে, তারা এই টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত সেটপিসে যথেষ্ট সফল। কিন্তু মিডফিল্ডে তুলনামূলক কিছুটা দুর্বল ক্রোয়েশিয়ার তুলনায়। সেই দুর্বলতা ঢাকার উপায় নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছেন ইংলিশ কোচ। 

ইংল্যান্ডের সম্ভাব্য স্কোয়াড: ৩-৫-২

পিকফোর্ড – ম্যাগুয়ার, স্টোনস, ওয়াকার – ইয়াং, লিংগার্ড, হ্যান্ডারসন, আলি, ট্রিপিয়ার – কেইন, স্টার্লিং   

ক্রোয়েশিয়ার সম্ভাব্য স্কোয়াড: ৪-২-৩-১

সুবাসিচ – ভ্রাসাইকা, লভরেন, ভিদা, স্ট্রিনিচ – রকিটিচ, ব্রোজোবিচ – রেবিচ, মদ্রিচ, পেরেসিচ – মান্দুকিচ 

দুই দলের সম্ভাব্য লাইন আপ; Image Source: Whoscored.com

৪.

৫২ বছর পর ইংল্যান্ড ফাইনালে উঠবে নাকি প্রথম বারের মতো ক্রোয়েশিয়া, সেটার উত্তর পাওয়া যাবে আর কয়েক ঘণ্টা পরেই। তবে যে দলই বাদ পড়ুক, তার জন্য হতাশার কিছুই নেই এই বিশ্বকাপে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউই শেষ চারের জন্য প্রথম ফেভারিট হিসেবে ইংল্যান্ড কিংবা ক্রোয়েশিয়াকে ভাবেনি। সেখানে অন্য সব ফেভারিট দলকে টপকে এই পর্যায়ে আসাটাও একটা সাফল্য। এই পর্যায়ে এসে নিয়মের কারণেই একটি দলকে বাদ পড়ে যেতে হবে আজ। হেরে যাওয়া দলকে স্বাভাবিকভাবেই সবাই মনে রাখে না, তবে আজ হেরে গেলেও ইংল্যান্ড অথবা ক্রোয়েশিয়াদের মানুষরা অবশ্যই তাদের চেষ্টাটাকে মনে রাখবে।

১৯৬৬ বিশ্বকাপের বিশ্বজয়ের মূহুর্তটাই ইংল্যান্ডের অনুপ্রেরণা; Image Source: targetgroup.co.uk

স্বপ্নের সিঁড়িতে আর মাত্র দুটো ধাপ বাকি তাদের, তবে এই দুটো ধাপই সবচেয়ে কঠিন। দেখা যাক, ইংল্যান্ড কিংবা ক্রোয়েশিয়া- কে পার হতে পারে সেই সিঁড়ি।

ফিচার ইমেজ: Goli Sports

Related Articles