Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রস্তর যুগের হারিয়ে যাওয়া দানবেরা

ডাইনোসর বাদেও প্রাচীন পৃথিবীতে বিরাটকায় অদ্ভুত প্রাণীদের কোনো খামতি কোনোকালেই ছিল না। মানুষের উন্নতির সাথে সাথে, বিশেষ করে হোমো সেপিয়েন্স নামক মনুষ্য প্রজাতিটির কল্যাণে গোটা বিশ্বজুড়ে একে একে এই বিশাল প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মনে হতে পারে, অল্প কয়েক লাখ মানুষ আর এমন কী ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে! কিন্তু প্রাণীজগতের খাদ্যশৃংখল অত্যন্ত নাজুক এবং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া এই বিরাট প্রাণীগুলো প্রকৃতিগতভাবেই সংখ্যায় ছিল কম, জন্মহারও ছিল অত্যন্ত ধীরগতির। একটি তৃণভোজী প্রাণীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার মাংসের ওপরে নির্ভরশীল মাংসাশী শিকারীর জীবনেও প্রভাব পড়ে।

মানুষের কর্মকান্ডের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কিছু কারণেও অনেক বৈচিত্র্যময় প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু প্রাচীন প্রাণীর কথা, যারা সদর্পে একসময় এই পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়াতো। বর্তমানে অবশ্য সেই সময়কার শিকারীদের রেখে যাওয়া কয়েকটা গুহাচিত্র আর ফসিল ছাড়া আর কোনো নাম-নিশানা পাওয়া যায় না।

মেগাথেরিয়াম

প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগের পিলোসিন যুগ থেকে শুরু করে ১১ হাজার বছর আগের প্লেইস্টোসিন যুগ পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকা দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই বিশাল প্রাণীগুলো। ভূ-চারী এ শ্লথরা আজকের যুগের শ্লথদের পূর্বপুরুষ। পৃথিবীর অন্যতম বৃহদাকার স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল এরা। ১৭৮৮ সালে আর্জেনিটার লুজন নদীর তীরে প্রথম এদের ফসিল আবিষ্কৃত হয়।

মেগাথেরিয়াম; Image Source: Wikimedia Commons

মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ২০ ফুটের বেশি লম্বা মেগাথেরিয়ামের ওজন হতোো প্রায় ৪ টন! বর্তমানের একটি হাতির মতো দেখতে এই প্রাণীর ছিল লম্বা লম্বা নখ, সুবিপুল উদর, শক্তিশালী পেছনের পা এবং মোটা লেজ। এরা অনায়াসে দুই পা আর লেজে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। আহার ছিল গাছের পাতা আর ফলমূল।

মেগাথেরিয়ামের বিলুপ্তির পেছনে মূলত দায়ী করা হয় হোমো সেপিয়েন্সদেরকে। বেরিং প্রণালী দিয়ে সেপিয়েন্সদের দলগুলো আমেরিকায় এসে হাজির হয়। শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর অবারিত শিকার। আনুমানিক দশ হাজার বছর পুর্বে পৃথিবীর বুকের শেষ মহাকায় শ্লথটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

স্যাবর টুথড টাইগার

যেসব গণের প্রাণীর স্যাবর বা বাঁকা তলোয়ারের মতো মস্ত বড় ছেদন দন্ত থাকে, তাদেরকে একত্রে স্যাবর টুথড টাইগার বা স্যাবর টুথড ক্যাট বলা হয়। এই প্রাণীদের অনেকগুলো গণ আছে, তবে আমরা কার্টুনে বা সিনেমায় স্যাবর টুথড বাঘ বলে চিনি যাদেরকে তারা হচ্ছে স্মাইলোডন গণভূক্ত। এদের অনেকে আবার বর্তমানের বাঘ-সিঙ্গীর পূর্বপুরুষ বলে মনে করে, তবে সব স্যাবর টুথড বাঘেরা কিন্তু বর্তমানের মার্জারদের পূর্বপুরুষ নয়। প্রায় ৪ কোটি ২০ লক্ষ বছর ধরে এরা সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছে।

স্মাইলোডন; Image Source: Earth Archives

আমরা স্মাইলোডনদের নিয়েই কথা বলবো। আকারে এরা বর্তমানের বাঘ-সিংহদের মতোই। তবে এদের সামনের দুই পা তুলনামূলকভাবে অনেক শক্তিশালী হতো। ১১ ইঞ্চি লম্বা ছেদন দন্ত দিয়ে এরা খুন করতো মাস্টেডনের মতো বিশাল প্রাণীদের। অনেক গবেষক মনে করেন, স্মাইলোডনদের চোয়াল বিশেষ শক্তিশালী ছিল না।

স্মাইলোডনদের বিচরণ ছিল বর্তমানের আমেরিকা মহাদেশে। আফ্রিকা আর এশিয়ার স্যাবর টুথড বাঘেরা লোপ পেয়ে যাওয়ার বহুকাল পরে, অন্তত হাজার দশেক বছর আগে স্মাইলোডনরা হারিয়ে যায়। ধারণা করা হয়, মাস্টেডনদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার কারণেই এই দুর্গতি। স্বভাব চরিত্রে স্মাইলোডনরা নাকি ঠিক বর্তমানের সিংহদের মতো ছিল।  

ম্যামথ

ম্যামুথাস গণভূক্ত যেকোনো প্রজাতিকেই ম্যামথ বলে ডাকা হয়। আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া আর উত্তর আমেরিকার নানা অঞ্চলে এই প্রাণীগুলো ৫০ লক্ষ বছর আগে উদ্ভূত হয়। মাত্র ৪,০০০ বছর আগে লোপ পায় বর্তমানের হাতিদের এই পূর্বপুরুষরা। এদের মধ্যে লোমশ ম্যামথরাই সবার শেষে বিলুপ্ত হয়েছে বলে তাদের নিয়েই আলাপ করা হবে।

অনেকেই মনে করতে পারেন, ম্যামথ খুব বিশাল আকারের প্রাণী। আসলে কিন্তু তা নয়। কোনো কোনো ম্যামথের প্রজাতি ৮ থেকে ১২ টন ওজনের হতো। অর্থাৎ মেরে কেটে এশীয় আর আফ্রিকার হাতিদের থেকে সামান্য বড় আকারের হবে। বর্তমানের হাতিদের মতোই তারা দল বেঁধে থাকতো। আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত হয়ে পরে তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

ম্যামথ শিকার; Image Source: Business Insider Nordic

খুব সম্ভবত মানুষের অত্যাধিক শিকারের কারণেই ম্যামথের দল লোপ পেতে থাকে। তবে সাইবেরিয়া আর আলাস্কাতে তারা অনেকদিন টিকে ছিল। এসব অঞ্চলে সবথেকে বেশি দেখা যেত লোমশ ম্যামথ। অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য তাপমাত্রার পরিবর্তন এবং সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেন। সাইবেরিয়ার বিশাল তৃণভূমি ক্রমশ বনে ঢেকে যেতে থাকলে ম্যামথেরা আরো উত্তরে তুন্দ্রা অঞ্চলে চলে যায়। কিন্তু সেখানেও শিকারীরা বসে ছিল না। একসময় ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের মতো কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছাড়া অন্য কোথাও আর ম্যামথ টিকে রইলো না। সেখানেও আনুমানিক ৩,৫০০-৫,০০০ বছর পূর্বে তারা লুপ্ত হয়।

ম্যামথের শেষ ঘাঁটি ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ; Image Source: CruiseMapper

সাইবেরিয়ার বরফের নীচে অন্তত দেড় কোটি ম্যামথের মৃতদেহ জমাট বেঁধে আছে বলে ধারণা করা হয়। আলাস্কা আর সাইবেরিয়ার অধিবাসীরা ম্যামথের দাঁত দিয়ে নানা অলংকার বানায়। অনেকে ম্যামথের জমাট বাঁধা মাংসও নাকি খেয়ে থাকে। কিছু বিজ্ঞানী বর্তমানে ম্যামথের ক্লোন বানানো যায় কি না তা নিয়ে গবেষণায় মেতেছেন।

মাস্টোডন

মামুত গণভূক্ত সকল প্রজাতির প্রাণীকেই মাস্টোডন হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমেরিকায় বর্তমানে কোনো বন্য হাতি নেই। কিন্তু ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগেও উত্তর আর মধ্য আমেরিকার গহীন জঙ্গলগুলো চষে বেড়াতো এই হাতিসদৃশ প্রাণীগুলো। ১৭০৫ সালে প্রথম এদের কোনো হাড়গোড়ের অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। শুরুতে এদেরকে ম্যামথ গোত্রীয় মনে করা হলেও শ’খানেক বছর পরে বিজ্ঞানীরা মাস্টোডনকে ম্যামথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে অভিহিত করেন।

মাস্টোডন; Image Source: Extinct Animals

মাস্টোডনরা বর্তমান যুগের হাতিদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আকার আকৃতিতেও তারা হাতির মতোই। দলবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত মাস্টোডনদের বেশ কয়েকটি প্রজাতি ছিল। গাছের পাতা ছিল তাদের মূল খাদ্য। আনুমানিক ১৩ হাজার বছর আগে আমেরিকাতে বেরিং প্রণালী দিয়ে মানুষ প্রবেশ করে। মাস্টোডনরা এই নতুন প্রজাতির শিকারীদের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানতো না বিধায় কাতারে কাতারে মারা পড়তে থাকে। এগারো থেকে সাড়ে দশ হাজার বছর পূর্বে তারা পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয়।

ডিপ্রোটোডন

আদিম অস্ট্রেলিয়ার লোকগাথা অনুসারে, জলা আর নদীতে থাকে বুনিপ নামের এক ভয়ংকর প্রাণী। জলহস্তীর মত আকৃতির এই বুনিপকে নিয়ে আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের ভয়ের শেষ ছিল না। পরে ইউরোপীয়রা অস্ট্রেলিয়া দখল করে নিলে তারাও বুনিপ সংক্রান্ত গল্পগাথার খোঁজ পায় এবং যথারীতি বুনিপ আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে পাওয়া যায় ডিপ্রোটোডনদের ফসিল।

শিল্পীর কল্পনায় বুনিপ; Image Source: historicmysteries.com

ডিপ্রোটোডনরা হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে বড় মারসুপিয়াল। মারসুপিয়াল হচ্ছে সেসব স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা মায়ের পেটের কাছে চামড়ার থলিসদৃশ স্থানে জন্মগ্রহণ করে ও সেখানেই বড় হয়। ক্যাঙ্গারু, ওয়ালাবি, ওমব্যাট প্রভৃতি হচ্ছে বর্তমান যুগের মারসুপিয়ালদের উদাহরণ।

শিংবিহীন গণ্ডারের মতো দেখতে ডিপ্রোটোডনরা ১৬ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে উদ্ভূত হয়। দশ ফুট লম্বা, সাড়ে ছয় ফুট উঁচু এই প্রাণীগুলোর ওজন হতো আড়াই হাজার কেজির বেশি। বিজ্ঞানীরা ঠিক নিশ্চিত না ডিপ্রোটোডনদের কয়টি প্রজাতি ছিল। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে আটটি। তৃণভোজী এই প্রাণীরা দেখতে অনেকটা বর্তমান যুগের কোয়ালার মতো ছিল।

ডিপ্রোটোডন; Image Source: sciencemag.org

প্রায় ৫০ হাজার বছর পূর্বে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি অস্ট্রেলিয়ার ভূখন্ডে এসে হাজির হয়। এই নতুন ঘরানার শিকারীদের ব্যাপারে ডিপ্রোটোডনদের কোনো ধারণাই ছিল না। মানুষ আগমনের মাত্র হাজার তিনেক বছরের মধ্যে আরো অনেক বিশালকায় অস্ট্রেলীয় দানবদের মতো ডিপ্রোটোডনরাও পৃথিবীর সাথে তাদের শেষ যোগসূত্র হারিয়ে ফেলে।

ফিচার ইমেজ – National Geographic

Related Articles