হুয়াওয়ে (Huawei Technologies Co., Ltd.) বিশ্বের বৃহত্তম টেলিযোগাযোগ এবং ২য় বৃহত্তম স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যানুসারে, হুয়াওয়ে এখন বিশ্বের ৭৯তম মূল্যবান ব্রান্ড। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কর্মী!
এই টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটির অজানা সব তথ্য নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
রেন জেংফেই ৪২ বছর বয়সে হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন
৪২ বছর বয়সে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার মতো সাহস এবং উদ্যম আসলেই অবাক করার মতো। ঠিক এই কাজটিই করে দেখিয়েছেন হুয়াওয়ে’র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রেন জেংফেই।
চীনের লিবারেশন আর্মি থেকে রেন যখন অবসরে যান তখন তার বয়স চল্লিশের কোঠায়। পরবর্তীতে তিনি হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। রেনের বয়স এখন ৭৩ বছর। তিনি ৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক এবং চীনের ১৪১তম ধনী ব্যক্তি।
হুয়াওয়ে শব্দটি দ্বারা চীনের সাফল্য বা অর্জনকে বোঝানো হয়ে থাকে
হুয়াওয়ে শব্দটিতে ব্যবহৃত প্রথম অক্ষরটি দ্বারা চীনা ভাষায় প্রথমদিকে ফুলকে বোঝানো হলেও এখন কিন্তু একটি ভিন্ন অর্থেই ব্যবহার করা হয়। এই অক্ষরটি এখন ‘চীন দেশ বা চীন সংক্রান্ত’ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ২য় অক্ষরটি কৃতিত্ব, দক্ষতা বা স্বীকৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং, সমন্বিতভাবে হুয়াওয়ে শব্দের প্রথম দুটি অক্ষর দ্বারা চীন দেশের সাফল্য বা অর্জনকে বোঝানো হয়ে থাকে।
হুয়াওয়ে এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ টেলিযোগাযোগ পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান
অনেকেই হুয়াওয়েকে শুধুমাত্র একটি স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেনে থাকলেও এই বিষয়টি অনেকেই জানেন না যে, তারা এখন টেলিযোগাযোগ পণ্য তৈরি এবং বাজারজাতকরণের সবথেকে বড় প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালে আরেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এরিকসনকে টপকে হুয়াওয়ে এই স্থান দখল করে দিয়েছে। ফলে এখন শুধু স্মার্টফোনের উপকরণ তৈরি এবং সমন্বয় করাই হুয়াওয়ের অর্থোপার্জনের একমাত্র পথ নয়, বরং চুক্তি অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি কর্পোরেশন এবং টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের জন্য নানা যোগাযোগ উপকরণ প্রস্তুত করে তারা বড় ধরনের মুনাফা লাভ করে থাকে।
টেলিফোন সুইচ তৈরির পরিকল্পনা থেকেই হুয়াওয়ের জন্ম
পশ্চিমা বিশ্বে হুয়াওয়ে নামটি খুব বেশি পুরনো না হলেও প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু বেশ আগেই স্থাপিত হয়েছে। স্বনামধন্য এই স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৭ সালে চীনের শেঞ্জেন শহরে প্রথম কার্যক্রম শুরু করে। তখনকার রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের লিবারেশন আর্মির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য নিরাপদ টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থার দরকার ছিল। এই অবস্থায় রেন দেশের অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে দেশের সেনাবাহিনীর ব্যবহার করার জন্য টেলিফোন সুইচ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। এভাবেই হুয়াওয়ে নামের একটি কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন বলেন-
আমি দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। আমাদের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার জন্য দেশে তৈরি টেলিফোন যোগাযোগ সুইচের প্রচণ্ড প্রয়োজন ছিল। এ কথা চিন্তা করেই আমাদের নিজস্ব গবেষণা এবং প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে প্রথমে টেলিফোন সুইচ তৈরি করার জন্য হুয়াওয়ের যাত্রা শুরু হয়।
পৃথিবীর প্রধান সব টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সাথে হুয়াওয়ের চুক্তি রয়েছে
আপনি হয়তো জেনে একটু অবাকই হবেন যে, পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ প্রধান টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সাথে হুয়াওয়ের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভোডাফোন, মটোরোলা, টি-মোবাইলের মতো নামকরা সব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া শুধুমাত্র স্মার্টফোন ব্যবসার বাইরে নিজেদের প্রসার এবং পরিব্যপ্তির জন্য আর্সেনাল, পিএসজি, ঘানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মতো আরও বেশ কিছু ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সাথে হুয়াওয়ের অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক রয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হুয়াওয়ের বিনিয়োগ
আমরা অনেকেই যে বিষয়টি জানি না তা হচ্ছে, শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনই নয়, বরং গবেষণা কাজকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবার জন্য হুয়াওয়ে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা এবং প্রযুক্তি খাতে উন্নততর গবেষণার জন্য একটি আধুনিক ল্যাব তৈরিতে হুয়াওয়ে এই বিনিয়োগ করেছে। যদিও এই বিনিয়োগ থেকে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘমেয়াদে বেশ লাভবান হচ্ছে, কিন্তু একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগের বিষয়টি অবশ্যই একটি আশাপ্রদ বিষয়।
হুয়াওয়ে একটি কর্মী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান
হুয়াওয়ে মূলত একটি কর্মী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে থাকতে প্রতিষ্ঠানটি এই কৌশল ব্যবহার করেছে। হুয়াওয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক মূলত এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। সুনির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে কর্মীদের মধ্যে মুনাফার বিষয়টি বন্টন করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কর্মীদের অবসর, কর্মদক্ষতাসহ বেশ কিছু বিষয় মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মীদের মালিকানার বিষয়টি থাকলেও যেকোনো সিদ্ধান্তে চেয়ারম্যান রেন জেংফেই ভেটো দেবার ক্ষমতা রাখেন। ইউনিয়ন ভোটের মাধ্যমে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ৫১ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি প্যানেল নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীতে এই প্যানেল ১৭ সদস্যের ডিরেক্টর বোর্ড নির্বাচন করে থাকে।
মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগ এবং হুয়াওয়ের সম্পর্ক
মার্কিন সরকারের নিরাপত্তা বিভাগ এবং হুয়াওয়ের মধ্যে প্রাচীন এক বৈরি সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগ থেকে বেশ কয়েকবার প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে চীনা সরকারের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। হুয়াওয়ে থেকে বারবার এই ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগ থেকে বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে তদন্ত করা হলেও শক্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি।
২০১২ সালে মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগের এক রিপোর্টে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। চীন সরকারের সাথে প্রতিষ্ঠানটির কাজের পুরনো সম্পর্কের কারণে যেকোনো নতুন হুয়াওয়ে পণ্য কড়া যাচাই বাছাইয়ের পরেই মার্কিন বাজারে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা রিপোর্টে নাসার তরফ থেকে প্রতিষ্ঠানটির উপরে বড় ধরনের গুপ্ত তদন্তের কথা প্রকাশিত হয়। এমনকি হুয়াওয়ের চেয়ারম্যানের টেলিফোন যোগাযোগের উপরেও নজরদারির বিষয়টি এই তথ্যে উঠে আসে।
গবেষণা এবং নকশা বিভাগে প্রায় ৮০ হাজার কর্মী
হুয়াওয়ের বার্ষিক আয়ের প্রায় ১০ শতাংশই নতুন পণ্যের উপরে গবেষণা এবং নকশা প্রস্তুত করার জন্য ব্যয় করা হয়। প্রায় ৮০ হাজার কর্মী প্রতিষ্ঠানটির আরএন্ডডি বিভাগে কাজ করেন । কোনো প্রযুক্তি এবং টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা এবং নকশা বিভাগের জন্য এই কর্মীসংখ্যা বেশ বড়!
এই বিভাগে বড় ধরনের বিনিয়োগই হুয়াওয়ের সাম্প্রতিক সাফল্যের অন্যতম কারণ। ঠিক এই কারণেই হুয়াওয়ে নিত্যনতুন গুণগত মানসম্মত পণ্য এনে আমাদের চমকে দিচ্ছে।
মুনাফা বা লাভ
হুয়াওয়ে থেকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১০ সালটি প্রতিষ্ঠানটির জন্য ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ একটি বছর ছিল। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যবসার উপরে ভিত্তি করে ২০১০ সালের মধ্যে হুয়াওয়ের বার্ষিক মুনাফা আগের থেকে অন্ততপক্ষে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
চীনের বাইরে মার্কিন এবং ইউরোপের বাজারে হুয়াওয়ের পণ্যের এক বিশাল বাজার রয়েছে। তাদের পণ্যসম্ভারের মধ্যে স্মার্টফোনের বাইরেও নানা ধরনের টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি রয়েছে। ২০১০ সালেই ৭৮.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর অন্ততপক্ষে ১৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানটির দখলে ছিল। তাহলে একবার ২০১৮ সালের কথা চিন্তা করা যাক। হুয়াওয়ের ব্রান্ড মূল্য এখন ৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!
ফিচার ইমেজ: Meinhardt Thailand