সত্যিই অবাক আমি! একদিকে যখন কেরালা রাজ্যজুড়ে চলছে এক প্রচণ্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবজীবন প্রভাবিত হয়েছে ভীষণভাবে, তখন ভারতের নানা মহলে চলছে এক অদ্ভুত বিতর্ক- কেরালার বন্যা বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলাতে ভারতের বিদেশী সাহায্য গ্রহণ করা উচিত কিনা।
অথচ যখন জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রথম দক্ষিণ ভারতের রাজ্যটিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন সেখানকার প্রশাসন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানায় ত্রাণের জন্য অন্ততপক্ষে ৮৩১.১০ কোটি টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) মঞ্জুর করতে। কিন্তু কেন্দ্র অনুমোদন করে মাত্র ৮০ কোটি টাকা। আমি নিজে গত ৩০ জুলাই লোকসভায় কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন জানাই অতিরিক্ত অর্থ সাহায্যের জন্য, কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করেনি।
এদিকে কেরালার বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে এগোতে থাকে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কেরালা সরকার ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ড (এনডিআরএফ) বা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার তহবিল থেকে ১,২০০ কোটি টাকা সাহায্য চাইলে কেন্দ্র অনুমোদন করে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। কেরালার অর্থমন্ত্রীও প্রকাশ্যে বলেন যে, বন্যাক্রান্ত রাজ্যটির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে আশু প্রয়োজন ৩,০০০ কোটি টাকার।
এরপর ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেরালায় যান এবং রাজ্যকে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকার সহযোগিতা প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, যা কেরালা সরকারের চাওয়া আশু অর্থসাহায্যের অর্ধেকেরও কম (দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় সাহায্যের কথা তো ছেড়েই দিলাম)।
আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের আর্থিক সাহায্য নিতে অস্বীকার করে ভারত সরকার
ইতিমধ্যে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের তরফ থেকে দুর্দশাগ্রস্ত কেরালার জন্য ৭০০ কোটি টাকার সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমকে টুইটারে এই বিষয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেও, ভারত সরকারের তরফ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয় যে আমিরাতের এই প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবে না। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি। শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্ররা জানান, তাদের সরকার আদতে বিদেশী সাহায্যের বিষয়ে তার পূর্বসূরি ইউপিএ সরকারের অবস্থানই নিয়েছে। ২০০৪ সালে বিধ্বংসী সুনামির পরে প্রথম ইউপিএ সরকার বিদেশী সাহায্য ফিরিয়ে দেওয়ার নীতি স্পষ্ট করেছিল।
২০০৫ সালের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-এর ১১ নম্বর ধারাতে ভারতে জাতীয় বিপর্যয়ের মোকাবেলার প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি জাতীয় নীতি তৈরির কথা বলা হয়েছে। ২০১৬ সালের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের ৯.২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নীতিগত বিচারে ভারত সরকার কোনো বিপর্যয়ের পরে বিদেশী সাহায্যের জন্যে আবেদন জানাবে না। কিন্তু যদি কোনো দেশের সরকার বিপর্যয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে তা গ্রহণ করতে পারে।
যেহেতু কেরালার ক্ষেত্রে আরব আমিরাতের সাহায্যের প্রস্তাব কোনো ভারত সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসেনি এবং তা ছিল সম্পূর্ণভাবেই মানবিকতার খাতিরে, তাই কেন্দ্র সরকার তার নিজের নীতির বিচারেই তা গ্রহণ করতে পারত।
আর শুধু আরব আমিরাত কেন, কাতারের বিদেশমন্ত্রকও ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মালদ্বীপ ৩৫ লক্ষ টাকার সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সে সমস্ত সাহায্যেরও বাস্তবায়ন হওয়ার আশা ক্ষীণ। এমনকি, বিদেশে অবস্থিত ভারতীয় মিশনগুলোকেও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কেরালার জন্য আসা বিভিন্ন সহযোগিতার আবেদন-নিবেদন যেন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডও আগ্রহী ছিল কেরালার দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু সেদেশের রাষ্ট্রদূত গত ২২ আগস্ট টুইট করে জানান যে, আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তাদের ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কেরালার বন্যাত্রাণের জন্যে বিদেশী অর্থসাহায্য গ্রহণ না করার কথা। থাইল্যান্ডের কূটনীতিক তাই কেরালার মানুষের জন্যে প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত থেকেছেন।
নিজেদের না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া যাবে না কেন?
ভারত সরকারের এই অবস্থান আপত্তিজনক। অতীতে বিপর্যয় ঘটলেও কেন্দ্র সরকার নিজের বলে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের যেখানে টাকার ঘাটতি রয়েছে; যেখানে সে নিজে রাজ্য সরকারের বন্যাত্রাণের সাহায্যের আবেদন মিটিয়ে উঠতে পারছে না এবং পুরো রাজ্যের পরিকাঠামোগত পুনর্নির্মাণের জন্যে প্রয়োজনীয় ২০,০০০ কোটি বা তারও বেশি টাকার যোগান দেওয়া যার কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ; সেখানে বিদেশী সাহায্য ফিরিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা বোঝা শক্ত।
ভারত সরকারের বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে বিদেশী সাহায্য নেওয়ার ভিত্তি হওয়া উচিত তার ২০১৬ সালের পরিকল্পনা। ২০০৪ বা ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডে হওয়া প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার পরে সরকারের অবস্থান যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন বন্ধু দেশ থেকে আসা বিদেশী সাহায্য ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটি মেনে নেওয়া কঠিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহাশক্তিধর দেশও যেখানে ২০০৫ সালের আগস্টে হওয়া হারিকেন ক্যাটরিনার পরে বিদেশী সাহায্য গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি, সেখানে আমাদের তা নিতে সমস্যা কোথায়?
যদি নয়াদিল্লির সরকার ভাবে যে কেরালার যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির মেরামতির জন্যে তাদের কাছে যথেষ্ট অর্থ রয়েছে, তাহলে সেই অর্থ তারা রাজ্যের হাতে তুলে দিচ্ছে না কেন? কেরালার মানুষ যদি এর জবাবদিহিতা প্রত্যাশা করে থাকে আজকে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক বন্যায় ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’-এ যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে নষ্ট হয়ে যাওয়া ৮০,০০০ কিলোমিটার সড়কপথ, ৩৯টি সেতু এবং ৫০,০০০-এরও বেশি বাড়িঘর। পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত ১০ লক্ষ মানুষ তো রয়েছেনই।
২০০১ সালে ভূজের ভূমিকম্পের পরে ভারত সরকার বিদেশী সাহায্য নিয়েছিল
এখানে স্মরণ করা ভালো যে, ২০০১ সালে যখন গুজরাত রাজ্যের ভূজে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশী ত্রাণ গ্রহণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, ইউনিসেফ, আইএলও ইত্যাদির তরফ থেকে যে অর্থের আবেদন করা হয় ভূজের ত্রাণের জন্যে, তার পরিমাণ ৪২,৬৭০,৭০২ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের তরফ থেকে ভূজের ভূমিকম্পের পরের দিনই ১৫০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়।
ভূজের মানুষকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যে সাহায্য সেদিন দেওয়া হয়েছিল, আমি তার বিরুদ্ধে নই। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় ভারতের যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে, আর তাই তাদের তরফ থেকে কোনো সাহায্য নেওয়ার মধ্যে অসম্মানের কিছু নেই। আন্তর্জাতিক দুনিয়া সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিপদ-বিপর্যয়ের সময়ে ‘একের জন্যে সবাই এবং সবার জন্যে এক’- এই নীতিতেই বিশ্বাসী। ভারত নিজেও স্বেচ্ছায় নানা প্রতিবেশী দেশের দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তা নেপাল বা ইরান এমনকি পাকিস্তানে ভূমিকম্পই হোক কিংবা বাংলাদেশ বা মিয়ানমারে বন্যা- নয়াদিল্লি দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কোনোদিনই কার্পণ্য করেনি। তাহলে আমাদের দুর্দিনে অন্যান্য দেশ সাহায্যের হাত বাড়ালে তাতে সমস্যার কী আছে?
গত বছর সাইক্লোন ওকচির পরেও কেরালা যথেষ্ঠ সাহায্য পায়নি কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ বন্যার পরে কেরালার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসনের জন্যে প্রয়োজন বিশেষ আর্থিক সাহায্যের। এনডিআরএফ-এর পক্ষ থেকে যে অর্থ অনুমোদিত হয়, তা শুধুমাত্র বিপর্যয় তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দেওয়ার জন্য। গতবছরের শেষের দিকে যখন সাইক্লোন ওকচি কেরালাতে ক্ষয়ক্ষতি করে, তখন রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে ৭,৩০৪ কোটি টাকা সাহায্য চায় পুনর্বাসনের জন্য, কিন্তু হাতে পায় মাত্র ১৩৩ কোটি টাকা, তাও ত্রাণের জন্যে। আমি গত ২৪ জুলাই লোকসভায় যখন সরকারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করি, তখন গৃহমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কেন কেরালা বিশেষ আর্থিক সাহায্য পেল না, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এবছর যখন বন্যায় কেরালা দিশেহারা, তখনও ওকচির সময়ের সেই অপমানের জ্বালা সেই রাজ্যের মানুষ ভোলেননি।
ভারত যে আজকে আত্মনির্ভর সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আমাদের সরকার আজ এই ভেবে গর্বিত যে আমরা আজকে অন্যকে সাহায্য করি, কারও থেকে দান নিই না। আমার মতে, যখন আমাদের কাছে যথেষ্ঠ ক্ষমতা রয়েছে, তখন আমরা অবশ্যই আত্মনির্ভরতার পথ ধরব। কিন্তু যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একটি বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের নেই, তখন অন্যের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের নিজেদের দেশের নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশায় তাদের সাহায্য করতে না পারাটা কোনো নীতি দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না।
একজন ভারতীয় হিসেবে কখনোই চাইব না বাইরের দুনিয়ার সামনে আমার দেশ ভিক্ষার থালা নিয়ে দাঁড়াক। কিন্তু যখন আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী নিজে থেকে আমাদের দরজায় এসে একটুখানি চিনি দিতে আসে আমার ভাঁড়ারে নেই বলে, তখন তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটাও সমীচীন কাজ নয়। সময় এসেছে আমাদের বিদেশী সাহায্য নীতির প্রসঙ্গে এক সম্পূর্ণ নতুন অবস্থান নেওয়া, যাতে প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে আমরা আরও বেশি করে তৈরি থাকতে পারি।
Featured Image Source: AP PHOTO/TIBIN AUGUSTINE
শশী থারুর ভারতের একজন সংসদ সদস্য, এই লেখাটি তার ব্যক্তিগত মতামত।