মুখে পরপর তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ। আবেগের বশে নিমিষেই স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ। সোজাভাবে এটিই হলো আলোচ্য তিন তালাক (Triple Talaq)। সম্প্রতি আইনসভার কাছে এই তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণার সুপারিশ করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তানে ইসলামের তদারককারী সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইডিওলজি’ (CII)।
ক্ষণিকের ভুলে সংসার ভাঙা আর লৈঙ্গিক অমর্যাদার প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করতেই এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন কাউন্সিল চেয়ারম্যান ড. কিবলা আয়াজ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, কাউন্সিলের সুপারিশ দেখভাল করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে আইন মন্ত্রণালয়। তবে শাস্তি বিধানের আইনটির ব্যাপারে কাউন্সিল একমত। সেই সঙ্গে শাস্তির ধরন কীরুপ হবে, এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে দেশের অভিজ্ঞ মুফতিদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে কাউন্সিল।
উল্লেখ্য, তিন তালাক এমনিতেও ১৯৬১ সাল থেকে নিষিদ্ধ ছিলো পাকিস্তানে। তবে এ ব্যাপারে কোনো শাস্তির বিধান ছিলো না দেশটির সংবিধানে। আর এবারে শাস্তির দাবি এলো তো এলোই, একদম ইসলামপন্থীদের তরফ থেকেই এলো! আয়াজের যুক্তি, একে তো এটি ইসলামসম্মত নয়, দ্বিতীয়ত প্রথাটি নারীর অধিকার খর্ব করে, তাই যেকোনো মূল্যে একে আটকাতেই হবে।
‘কাউন্সিল ফর ইসলামিক আইডিওলজি’ হলো পাকিস্তানের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কাউন্সিলের কাজ হলো ইসলাম সম্পর্কিত বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ বা সুপারিশ প্রদান করা এবং প্রস্তাবিত কোনো আইনের যাচাইপূর্বক ছাড়পত্র দেওয়া। অভিজ্ঞ মুফতিদের (ফতোয়া প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতাধারী) সমন্বয়ে গঠিত এই কাউন্সিল। এটির গঠন কাঠামো অনেকটা বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধাঁচের। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় কাউন্সিল।
হানাফি মাজহাবী অনেক পাকিস্তানী আলেম এখনো তিন তালাকের বৈধতা চান। সেখানে আগ বেড়ে কাউন্সিলের শাস্তিবিধানের সুপারিশকে মন্দচোখেই দেখছেন তারা। ইতোপূর্বে খুলা’ (خلع) এর বিধানে সম্মতি প্রদান করে রক্ষণশীল আলেমদের একটা অংশের কাছে সমালোচিত হয়েছিলো কাউন্সিল। উল্লেখ্য, শর্তসাপেক্ষে স্ত্রীর স্বামীকে তালাক দিতে পারার অধিকারের বিধানটিই হলো খুলা’। এ বিধান প্রয়োগের জন্য পারস্পরিক সম্মতি অথবা আদালতের ফরমান আবশ্যক।
আজকালকার দিনেই তিন তালাকের শাস্তিবিধানের ব্যাপারটি নিয়ে যেভাবে ইতিবাচকের সাথে অসংখ্য নেতিবাচক প্রক্রিয়া আসছে, তাতে ১৯৬১ সালে কীভাবে এত সহজে (!) একত্রে তিন তালাককে শরীয়াহ বিরোধী ঘোষণা করলো পাকিস্তান? পাঠক মনের এ কৌতুহল মেটাবে একটি নাটকীয় প্রেক্ষাপট।
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পূর্ব বাংলার মোহাম্মদ আলী বগুড়া। এই ভদ্রলোক প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৫৫ সালে প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দিয়েই নতুন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন; পাত্রী তার ব্যক্তিগত সহকারি। মুসলিমদের জন্য প্রথম স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে হারাম নয়। কিন্তু তখন মুসলিমদের জন্য আলাদা পূর্ণাঙ্গ বিবাহ আইন ছিলো না পাকিস্তানে। প্রচলিত ব্রিটিশ আইনে স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে আইনত বিয়ে সিদ্ধ ছিলো না। ব্যস, বিতর্কের ঝড় উঠলো দেশে। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এলেন জেনারেল আইয়ুব খান। আলী সাহেবের বিবাহ বিতর্কের জের তখনো তরতাজা। ভাবলেন, বিয়েশাদি নিয়ে আর কোনো বালা-মুসিবত আসবার আগে ভালোয় ভালোয় একটি সংগঠিত-বিধিবদ্ধ মুসলিম পরিবার ও বিবাহ আইন তৈরি করে রাখা ভালো। আলী সাহেবের বিতর্কেও জল ঢালা হবে, ভবিষ্যতের জন্য একটা কাজের কাজ হবে এবং সর্বোপরি জনতাও খুশি থাকবে। ১৯৫৬ সালে মুসলিম বিবাহ সম্পর্কিত আইনের পুনর্নিরীক্ষার জন্য ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করলেন তিনি।
১৯৬১ সালে কমিটি ফলাফল দিলো। মুসলিম পরিবার আইনের ৭ম ধারায় বলা হলো, একত্রে তিন তালাক দিলে সেটি কেবল এক তালাক হিসেবেই গণ্য হবে। তবে আলাদা আলাদাভাবে দুই তালাকের ইদ্দতকাল শেষ হবার পর যদি কেউ তৃতীয়বার স্ত্রীকে তালাক দেন, কেবল তখনই ইদ্দতকাল শেষসাপেক্ষে তিন তালাকের বিধান কার্যকর হবে। অর্থাৎ সেই ফতোয়া অনুযায়ী স্ত্রীকে তিনবার নিয়মানুগ তালাক দেওয়া গেলেও একত্রে তিন তালাক দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দিলেও তা কার্যকর হবে না (কেবল এক তালাক কার্যকর হবে)।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও এই ফতোয়াকেই অনুসরণ করেন অধিকাংশ আলেম-মুফতি। সৌদি আরব, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তানসহ কিছু মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে একত্রে তিন তালাক নিষিদ্ধ। তবে সবার আগে এ পথে হেঁটেছিলো যে দেশটি, তার নাম মিসর। ১৯২৯ সালের বিবাহ আইনে একত্রে তিন তালাককে অকার্যকর ঘোষণা করে তারা।
ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী ভারত আবার তিন তালাক বাতিলের রায় দিতে সময় নিয়েছে বহু দিন! ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত রায়ে একত্রে তিন তালাককে শরীয়াহ বিরোধী ও নারী অধিকারের লংঘন বলে রায় দেওয়া হয়। তিন তালাক অকার্যকর বলে রায় দেবার পর শাস্তিবিধানের পথে এগোতে আবার ভারত সময় নেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়েছে- শুধু নিষিদ্ধইই যথেষ্ট নয়, সাজাও চাই তিন তালাক প্রদানকারীর। জামিন-অযোগ্য মামলা, তিন বছরের কারাদণ্ড ও কিছু জরিমানা- খসড়া এমনটাই।
এদিকে এ বছরের মার্চে লক্ষ্ণৌতে নয়া আইনের বিরোধিতা করে তিন তালাকের পক্ষে মিছিল অবধি করেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম ল বোর্ডের নারী সদস্যরা! তাদের দাবি, এই আইনের রাজনীতিকরণ হয়েছে। তারা শরীয়াহ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই তারা বরং তিন তালাক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সরকারকে ধর্ষণ, ইভটিজিং নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানান। এর বাইরে আরো কিছু ইসলামপন্থী সংগঠন ‘তিন তালাক বিল’-এর বিরোধিতা করছে।
যা-ই হোক, খুব শীঘ্রই হয়তো তিন তালাক প্রদানে শাস্তিবিধানপূর্বক আইন পাস হতে চলেছে পাকিস্তানে। বহুকাল আগেই নিষিদ্ধ একটি বিষয়ের ওপর নতুন করে কেবল শাস্তিবিধান করা হচ্ছে। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, অতি-রক্ষণশীল পাকিস্তানে তার চেয়ে হাজার গুণ চ্যালেঞ্জিং কাজটি। সুতরাং একে আর দশটি স্বাভাবিক ঘটনার চেয়ে অধিক তাৎপর্যমণ্ডিত হিসেবেই ধরা যায়।
একই সঙ্গে আসতে চলেছে আরেকটি চমক। বাল্যবিবাহ নিয়েও ভাবছে কাউন্সিল। বাল্যবিবাহে বিশ্বে শীর্ষ পর্যায়ের একটি দেশ পাকিস্তান, যার গোড়ায় ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকেই খুঁজে পাওয়া যায়। সেই দেশে ষোলো বছরের কম বয়সীদের শিশু গণ্য করে বিবাহ নিষিদ্ধের সুপারিশ চূড়ান্ত করবার কথাও ভাবছে কাউন্সিল। তবে কি মৌলবাদ ছেড়ে খানিকটা উদারবাদের দিকে ঝুঁকছে পাকিস্তান? (সম্পূরক তথ্য: ২০১৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের এক যুগান্তকারী রুলের প্রেক্ষিতে এক ব্যক্তিকে ছয় মাসের জেল ও ২ লাখ পাকিস্তানি রুপি জরিমানা করেছিলেন পাকিস্তানের আদালত। অপরাধ- সে দ্বিতীয় বিয়ের আগে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়নি। ‘কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইডিওলজি’র অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন সুপারিশ ছিলো, তারা মনে করেন স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই। ওদিকে আদালতও কাউন্সিলের সুপারিশ আমলে নেননি)।
ফিচার ইমেজ: Scroll