২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারির বর্ষসেরা শব্দ ছিল পোস্ট-ট্রুথ। পোস্ট-ট্রুথ বলতে বোঝায় একটা ঘটনার পেছনে থাকা মূল কারণকে অগ্রাহ্য করে আবেগ ও ব্যক্তিগত মত দিয়ে ব্যাখ্যা করা। এই শব্দটা বহুল ব্যবহৃত হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সময়ে ও ব্রেক্সিট গণভোটের সময়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ২০১৭ সালের ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের কথা।
তিনি দাবি করেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শক-সমর্থক জড়ো হয়েছিল তার অভিষেক অনুষ্ঠানে। যদিও সেটা ছিল পুরো মিথ্যা কথা। তিনি চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে এরকম আরো হাজার হাজার মিথ্যা বলেছেন। প্রকৃত ব্যাখ্যা স্পষ্ট থাকা স্বত্ত্বেও মেনে নেননি। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি দাবি করেন, আমেরিকানদের ভোটে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।
কোনো ঘটনার স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও একে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর জন্য কিংবা মিডিয়াও খবরের কাটতি বাড়ানোর জন্য পোস্ট-ট্রুথের আশ্রয় নিতে পারে। এতে সুবিধাজনক জনমত তৈরি করা যায়, সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলা যায়, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রভাব রাখা যায়।
বর্তমান সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়ানো একটা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের কাছে আগে থেকে অবস্থান ঠিক করে রাখা তথ্যই প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকৃত তথ্য জানতে পারছে না। সম্প্রতি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর কোকাকোলা ইস্যুও পোস্ট-ট্রুথের আরেকটা নিদর্শন হয়ে থাকবে।
গত ১৪ জুন ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টে পর্তুগাল-হাঙ্গেরি গ্রুপ এফের ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি তার সামনে থাকা টেবিলে দুটি কোকাকোলার বোতল দেখেন। সেগুলো তিনি টেবিল থেকে সরিয়ে রাখেন এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে হেসে বলেন, ‘Água’, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ পানি। অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কোক না পান করে পানি পান করুন।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাথলেটদের একজন যখন বিশ্বের এক নাম্বার কোমল পানীয় নিয়ে এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই এটা হয়ে যায় বড় খবর। তার ওপর কোকাকোলা ছিল এবারের ইউরোর অন্যতম স্পন্সর। কিন্তু খবর রটে যায় রোনালদোর এই কাণ্ডে কোকাকোলার বাজারমূল্য নাকি ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গিয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, রোনালদোর বোতল সরানোর সাথে কোকাকোলার শেয়ারের তারতম্যের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং রোনালদো বোতল সরানোর আগে থেকেই কোকাকোলার শেয়ারের মূল্য কমছিল।
কিন্তু ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই অনলাইনে সয়লাব হয়ে যায়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অস্বাস্থ্যকর কোক পানে নিরুৎসাহিত করাতেই নাকি শেয়ার বাজারে প্রভাব পড়েছে। কিছু সংবাদমাধ্যম তথ্যসূত্র দিচ্ছিল, স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কাকে, যারা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখেছে কোকাকোলার শেয়ারের দাম কমে গেছে। কিছু সংবাদমাধ্যম কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই ঢালাওভাবে প্রচার করে গেছে। এটাকে যদি মিথ্যা সংবাদ না-ও বলা হয়, বিভ্রান্তিকর সংবাদ অবশ্যই বলা যায়।
কোকাকোলার শেয়ারের দরপতন বুঝতে হলে শেয়ার বাজারের কিছু টার্ম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে ডিভিডেন্ড, এক্স-ডিভিডেন্ড ডেট, রেকর্ড ডেট ইত্যাদি।
ডিভিডেন্ড (Dividend) বলতে বোঝায় একটা কোম্পানির লভ্যাংশ। এক বছরে একটা কোম্পানি তার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে লভ্যাংশ বুঝিয়ে দেয়, তাকেই ডিভিডেন্ড বলে। আর রেকর্ড ডেট (Record Date) হচ্ছে একটি তারিখ, যেদিন কোম্পানি ঠিক করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারা ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ পাবে।
এক্স-ডিভিডেন্ড ডেট হচ্ছে সেই তারিখ, যেদিনের পর শেয়ার কিনলে ওই বিনিয়োগকারী ডিভিডেন্ড পাওয়ার যোগ্য হবেন না। সাধারণত রেকর্ড ডেটের এক কার্য দিবস আগে হয়ে থাকে এক্স-ডিভিডেন্ড ডেট।
এবার কোকাকোলার ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকের রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের শেয়ারের সংখ্যা ৪৩০ কোটি। ১১ জুন শুক্রবার শেয়ারবাজার যখন ক্লোজ হয়, কোকাকোলার প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল ৫৬.১৬ মার্কিন ডলার। আর কোকাকোলার বাজারমূল্য ছিল ২৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ১৪ জুন সোমবার কোকাকোলার শেয়ার মূল্য শুরু হয় ৫৫.৬৯ মার্কিন ডলার দিয়ে।
অর্থাৎ, ১১ জুনের ৫৬.১৬ মার্কিন ডলার থেকে কমে যায়। এর কারণ ১৪ জুন ছিল কোকাকোলার এক্স-ডিভিডেন্ড ডেট, যা তারা আরো আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। এক্স-ডিভিডেন্ড ডেট হওয়ায় তারা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড বুঝিয়ে দেয়, যার ফলে শেয়ারমূল্য কিছুটা কমে যায়। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
১৪ জুন শেয়ারের কার্যক্রম শুরু হয় ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা ইএসটি (EST) অনুযায়ী সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে। ৯টা ৪০ মিনিটে কোকাকোলার শেয়ারের দাম হয়ে যায় ৫৫.২৬ মার্কিন ডলার, যা ১১ জুনের তুলনায় ১.৬% কম। এতে কোকাকোলার বাজারমূল্য ২৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে। অর্থাৎ, এই সময়টাতেই তাদের মূল্যমান ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার কমে যায়।
অন্যদিকে, রোনালদোর ম্যাচ-পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলন ছিল মধ্য ইউরোপীয় সময় অনুযায়ী বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে, যা ইএসটি অনুযায়ী সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট। এতে দেখা যায়, রোনালদো কোকের বোতল সরানোর আগে থেকেই শেয়ারমূল্য কমছিল। শুধু কোকাকোলাই নয়, ওই সময়টাতে আমেরিকান স্টকগুলোতেই ট্রেডিং একটু ধীরগতির ছিল। ফোর্ড মোটর কোম্পানির বাজার মূল্যও তখন ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি কমে যায়। কোকাকোলার ৪০০ কোটি ডলার শেয়ার মূল্য কমে যাওয়া বিশাল অঙ্কের মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ছিল কোকাকোলার মোট বাজারমূল্যের ২ শতাংশেরও কম।
বাস্তবে শেয়ারবাজারের মূল্য উঠানামা এত জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে, এটাকে একটা নির্দিষ্ট ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। কোকাকোলার শেয়ারের চার্টটা দেখলে বোঝা যায় এখানে চাহিদা ও সরবরাহ উঠানামা করেছে। কোকাকোলার চার্টে দুটি সমান্তরাল রেখা দেখা যাচ্ছে, যার নিচেরটি ‘সাপোর্ট’ লাইন ও উপরেরটি ‘রেজিস্ট্যান্স’ লাইন।
যখনই শেয়ারের মূল্য সাপোর্ট লাইন স্পর্শ করে, তখন এটা হঠাৎ লাফিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আবার যখন রেজিস্ট্যান্স লাইন স্পর্শ করে, তখন ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। যদি রেজিস্ট্যান্স লাইন অতিক্রম করে ফেলে, তখন চেষ্টা করে নতুন সাপোর্ট লাইন খুঁজে বের করার। কোকাকোলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এটা নতুন কোনো সাপোর্ট লাইন পায়নি; ফলে শেয়ারমূল্য আবার নিচে নামা শুরু করেছে।
এই মূল্য ওঠানামাটা হয় চাহিদা ও যোগানের তারতম্যের ফলে। যখনই সাপোর্ট লাইনের দিকে শেয়ারের মূল্য আসতে থাকে, তখন ক্রেতাদের মধ্যে চাহিদা বেড়ে যায়। অন্যদিকে শেয়ারের মূল্য বাড়তে বাড়তে রেজিস্ট্যান্স লাইনে চলে আসলে বিক্রেতাদের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। প্রতিদিনই শেয়ার বাজারে এমন পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব খুব সামান্য। এটাকে বলে ‘মার্কেট নয়েজ’।
শেয়ারবাজারে খবরের শিরোনামের চেয়ে বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রমই বেশি প্রভাব রাখে। আর রোনালদোর কোকের বোতল সরানোর ঘটনায় যদি কোকাকোলার শেয়ারে কোনো প্রভাব থেকেও থাকে, সেটা শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াকেই নির্দেশ করে। কারণ দেখা যাচ্ছে বাজারমূল্য ৪০০ কোটি ডলার কমে গেলেও ওই ঘটনার পর কোকাকোলার শেয়ার ০.৩০ মার্কিন ডলার করে বাড়ে। ফলে কোকাকোলার বাজারমূল্য আরো ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার বেড়ে যায়। আর রোনালদো যে পানির বোতলের দিকে নির্দেশ করেছিলেন, সেটা ছিল কোকাকোলারই আরেকটা সাব-ব্র্যান্ড। অর্থাৎ, পুরো ঘটনায় কোকাকোলার বাজারমূল্য কমার চেয়ে প্রচারণাই পেয়েছে বেশি।
রোনালদোর ঘটনা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আমরা বাস করছি পোস্ট-ট্রুথ বিশ্বে। কারণ, বিষয়টা শুধু স্পোর্টস বা শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে ভুল তথ্য খুব দ্রুত ছড়ায়। বর্তমান সময়ে তথ্যের ভাণ্ডার থাকা মানেই প্রকৃত তথ্য না-ও হতে পারে। অনভিজ্ঞ কেউ একটা ঘটনাকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উপস্থাপন করতে পারে। সেটাই ছড়িয়ে পড়তে পারে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছে। এর ফল অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। পোস্ট-ট্রুথ বিশ্বে আমাদের সংবাদ মাধ্যম নিয়ে আরো একবার সতর্ক বার্তা দিয়ে গেল রোনালদোর কোকাকোলা কাণ্ড। তবে আশার কথা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের ভুল স্বীকার করছে এবং ভুল খবর মুছে ফেলছে।