সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বিদেশনীতি প্রণেতারা বেশ বিব্রত বোধ করছেন। এতদিন এই অঞ্চলে ভারত নিজেকে একপেশে শক্তিশালী মনে করলেও বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু ছোট দেশ নিজেদের আরও স্বাবলম্বী করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছে এবং তারা ভারতের ছায়া থেকে বেরিয়ে চীনের সঙ্গে সখ্যের মাধ্যমে এগোতে চাইছে। আর এতেই বাড়ছে নয়াদিল্লির বিড়ম্বনা।
অতি সম্প্রতি, ভারতের উত্তরে প্রতিবেশী নেপালকে নিয়ে নয়াদিল্লি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। হিমালয়ের কোলে এই ছোট্ট দেশটিতে গতবছর শেষের দিকে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পরে সেদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। বিভিন্ন বামপন্থী দল নির্বাচনে জিতে পরে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছে একটি সংযুক্ত নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি, যার পিছনে চীনের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য রকমের। আর এই সেপ্টেম্বর মাসে নেপাল এমন দুটি ঘটনা ঘটিয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে এটা পরিষ্কার যে, বর্তমান খড়গ প্রসাদ ওলি সরকারের নেতৃত্বে কাঠমান্ডু বেইজিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে বেশ ভালোরকম তৎপর।
একদিকে যেমন ২০১৬ সালের শুরুতে স্বাক্ষরিত হওয়া ট্রানজিট এন্ড ট্রান্সপোর্টেশন এগ্রিমেন্ট-এর মাধ্যমে চীন রাজি হয়েছে নেপালকে তাদের সাতটি বন্দর (জল ও স্থল মিলিয়ে) ব্যবহার করতে দিতে, অন্যদিকে নেপাল আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত বিমসটেক গোষ্ঠীর প্রথম সন্ত্রাস-বিরোধী সামরিক মহড়াতে অংশ না নেওয়ার। এবং নেপালের এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় তাদের নিজেদের দেশেই অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই। এই সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার বক্তব্যেও এই মহড়ার কথা উল্লিখিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, নেপালের এই বেঁকে বসার অবস্থান ভারতকে খুশি করেনি। তবে ভারতে না এলেও নেপালের নেতৃত্ব জানিয়েছে যে তারা চীনের সঙ্গে সেদেশের চেংদু শহরে একটি সন্ত্রাস-বিরোধী মহড়াতে যোগ দেবে এ মাসের পরের দিকে। ভারত সম্পর্কে কাঠমান্ডুর অবস্থান এর থেকে যথেষ্ঠই পরিষ্কার হয়।
এখানে উল্লেখ্য, গত জুন মাসে ওলির চীন সফর হওয়াকালীনও নেপাল এবং চীনের মধ্যে রেলপথ, পুনর্নির্মাণ, পরিকাঠামো, মানবসম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে ১৪টি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার নেপাল সফরে গিয়ে সেখানকার মানুষকে ভারতের চিরাচরিত ‘সফট পাওয়ার’-এর মাধ্যমে তুষ্ট করার চেষ্টা করলেও, আদতে যে ওলি সরকারের নেপাল তাদের বিদেশনীতিতে নতুন মাত্রা আনতে বদ্ধপরিকর, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
চীনের সঙ্গে নেপাল বন্ধুত্ব পাতাচ্ছে মানে এই নয় যে সে ভারতের শত্রু হয়ে গেল
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নেপাল কি তবে এবার থেকে ভারতকে উপেক্ষা করার নীতি নিয়ে চলবে? উত্তরটা কিন্তু সোজা হ্যাঁ নয়। ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও নেপাল সম্পর্কে মনে হচ্ছে, ভারতের তরফ থেকে ঠিক অবস্থানটি নেওয়া হচ্ছে না।
আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে, নেপাল এখন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। হতে পারে যে বিগত এক দশকের কিছু বেশি সময়তে তাদের গণতন্ত্রে অস্থিরতাই বেশি দেখা গিয়েছে, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রথম দিকে সেই অস্থিরতা খুব আশ্চর্যজনক কিছু নয়।
বিশেষ করে, গত বছরের শেষের দিকে নেপালে প্রথমবার একটি শক্তপোক্ত সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আর এসেই তারা ঠিক করেছে যে ভারতের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতা এবার তারা কাটাবে। নেপালের দিক থেকে দেখলে এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। যেকোনো সার্বভৌম দেশই সেটাই চাইবে। আর বিশেষ করে, নেপাল যেখানে দু’টি বিশাল প্রতিবেশী দেশের মধ্যখানে অবস্থিত, সেখানে তাদের নীতি বহুমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা যুক্তিযুক্ত।
ভারতকে বরং বুঝতে হবে, নেপালের এই নীতিগত পরিবর্তনের অর্থ এই নয় যে তারা ভারত-বিরোধী হয়ে যাচ্ছে। চীনের বন্দর ব্যবহার করার ছাড়পত্র পেলেও সেই বন্দরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকটতমটিও নেপালের চেয়ে কলকাতা বন্দরের দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব, অর্থনৈতিকভাবে, নেপাল এখনও চাইবে কলকাতা বন্দর থেকেই তাদের বাণিজ্য করতে। চীনের বন্দরগুলো তাদের কাছে এক বিকল্প পথ। আর বিকল্প পথ খোলা রাখার ব্যবস্থার মধ্যে ভুল কিছু নেই।
নেপালের এই ‘বিকল্প পথ’ খোঁজার চেষ্টায় ভারতের অবদান কম নয়
নেপালের এই বিকল্প পথ খোঁজার প্রচেষ্টার পিছনে ভারতেরও কিছুটা অবদান রয়েছে পরোক্ষভাবে। ২০১৫ সালে নেপালের নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নকে কেন্দ্র করে ভারতের অত্যাধিক মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সেই সময়ে নেপালে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দেখা দেয়; ভারতকেও অভিযুক্ত করা হয় সীমান্তে অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরি করে নেপালকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার অভিযোগে। আর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব নেপালের জনমানসে পড়ে। নেপালে একটি জাতীয়তাবাদী আবহাওয়া তৈরি হয়, যেটাকে কাজে লাগায় সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
কিন্তু তখন যেহেতু নেপাল আমাদের উপরে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তাই এখন আবার তাদের গদগদ চিত্তে তুষ্ট করতে হবে, নয়াদিল্লির এই সাদা-কালো নীতি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। নেপালে চীনের বিনিয়োগ এখন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি, আর তাই ভারত যেন আরও বিব্রত বোধ করছে চীনের কাছে ‘প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার’ প্রশ্নে। কিন্তু বিনিয়োগকে আদৌ প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। চীনের অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয় আর তাই ওই প্রতিযোগিতা নিয়ে হা-হুতাশ করাও অর্থহীন।
নেপালকে তাদের পথ তৈরি করতে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়
ভারতের উচিত নেপালকে তাদের মতো করে এগোতে দেওয়া। নেপাল ইতিমধ্যেই বুঝতে শুরু করেছে যে চীন বড় কঠিন ঠাঁই। তারা সাহায্য করলেও কড়া সুদে তা আদায়ও করবে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্পে অনেক দেশই প্রথম থেকে অত্যুৎসাহী হলেও পরে অনেকেই বুঝছে যে পথটি খুব সুগম নয়, কারণ চীনের প্রসাদ নিয়ে চীনেরই ঋণের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেরকম হলে এই গরিব দেশগুলির পক্ষে সেই ফাঁদ থেকে বেরোনো কঠিন। শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। মালয়েশিয়া সময় থাকতে থাকতে বুঝেছে চীনের বন্ধুত্ব কতটা বিপজ্জনকও হতে পারে। নেপালও সেকথা সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করবে (ইতিমধ্যে করতে শুরু করেছেও) আর তা তাদের গণতন্ত্রকেই সাবালক হতে সাহায্য করবে। ভারতের উচিত নেপালকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে দেওয়া। শুধু শুধু উদ্বেগ বাড়িয়ে চীনের মনস্তাত্ত্বিক জয়ের পথ প্রশস্ত করে তোলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। মানে হয় না নেপালের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করারও। তাতে হিতে বিপরীতই হবে।
ভারতীয়দের বদলাতে হবে চিন্তাধারা
অনেক পণ্ডিত মনে করছেন, নেপালে রাজতন্ত্র খর্ব করার পিছনে অবদান রেখে ভারত ঠিক কাজ করেনি। কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে অগণতান্ত্রিক শক্তি পৃথিবীর সিংহভাগ দেশেই কোনো না কোনো সময়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ভারত মদদ দিক বা না দিক, নেপালের রাজতন্ত্র একদিন না একদিন শেষ হতোই আর তারপরে সেখানে যতদিন না প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতই। এই চিন্তার গতিধারাটির মধ্যেই রয়েছে সমস্যা। নেপালের নিজস্বতাকে খর্ব করার মধ্যে রয়েছে এক নীতিগত ব্যর্থতা; বড়দাসুলভ আচরণ যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।
ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ
ভারতের উচিত নেপালের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারে আরও যত্নশীল হওয়া। ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা তৈরি করেনি; তা প্রকৃতিগতভাবে চলে এসেছে বহুযুগ ধরে। এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক বন্ধন বহু পুরোনো আর সেটা কাঠমান্ডু-বেইজিং-এর নতুন সমীকরণের জন্যে ধুলিসাৎ হবে না কখনোই। আর নেপালের কমিউনিস্টরা চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাইছেন বলে যে সেদেশের সার্বিক জনমত এই প্রবণতার পক্ষে, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তাই ভারতের নীতিপ্রণয়নকারীরা রাজনীতি-কূটনীতির উপরেই সম্পূর্ণ ভরসা না করে নেপালের সঙ্গে ভারতের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্কটির উপরে আলোকপাত করলেই ভালো। নেপালের পাহাড়ি মানুষরা ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে জানেন। তাদের বিশ্বাস যাতে আহত না হয়, সেই বিষয়েই ভারতের সজাগ থাকতে হবে।
Featured Image Source: Xinhua/Tashi Tsering via Getty Images (The mountainous border between Nepal and China)