দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির সাথে সাথে পতন হয় জার্মানির হিটলারের, ইতালির মুসোলিনির, সেইসাথে শাসনব্যবস্থা হিসেবে পতন হয় ফ্যাসিজমের। এরপরের অর্ধশতবর্ষ আদর্শিক দিক থেকে টিকে ছিল দু’টি মতাদর্শ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লকের উদার গণতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন ব্লকের কমিউনিজম। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে শাসনকাঠামো হিসেবে টিকে থাকে কেবল একটি মতাদর্শ, গণতন্ত্র।
নব্বইয়ের দশকের পরে মূলধারার একমাত্র মতাদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র চর্চিত হলেও, বিভিন্ন সময় আর স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ সামনে এসেছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকেই উত্থান ঘটেছে কর্তৃত্ববাদের, উত্থান ঘটেছে হাইব্রিড রেজিমের, উত্থান ঘটেছে অনুদার গণতন্ত্র আর জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের।
নব্বই পরবর্তী সময়ে দুটি বড় ধরনের উত্থান দেখা গেছে জনতুষ্টিবাদীদের। নব্বইয়ের দশকে এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের পরবর্তী সময়ে একটি বড় উত্থান দেখা গিয়েছিল জনতুষ্টিবাদীদের, আরেকটি উত্থান দেখা গেছে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মহামন্দার পরবর্তী সময়ে। জনতুষ্টিবাদের সর্বশেষ যে ঢেউটি এসেছে, তাতে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ, আক্রান্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও।
২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে পপুলার ভোটে হেরেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই জনতুষ্টিবাদী এই নেতা একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার হয়েছেন, হয়েছেন অভিশংসিতও। বিভাজন আর ডানপন্থার রাজনীতি করা এই প্রেসিডেন্ট হেরেছেন চার বছর পরে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে। নির্বাচনে পপুলার ভোট আর ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, দু’টিতেই হার নিশ্চিত করেছে, গত তিন দশকে সিনিয়র বুশের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পই হচ্ছেন প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি এক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেই বিদায় নিচ্ছেন।
কেমন ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির চারটি বছর? কী কী ব্যর্থতা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বানিয়েছে এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট? কোন কোন ব্যর্থতার জন্য পুনর্নির্বাচন জিততে ব্যর্থ হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
মহামারি ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা
গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারিতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুরু থেকেই ট্রাম্পের অগোছালো নেতৃত্বের কারণে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল আমেরিকার স্বাস্থ্যকাঠামো, ছিল না মহামারি মোকাবেলায় পরিকল্পিত কোনো পরিকল্পনাও। বরং, করোনার ভ্যাকসিন আর প্রতিকার নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য হাস্যরসের কারণ হয়েছে, ছড়িয়েছে বিভ্রান্তি। এ সংক্রান্ত বিতর্ককে কেন্দ্র করে তিনি বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হলেও, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুর প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যায় ১ লাখ ১৬ হাজার আমেরিকান, ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৮ হাজার আর কোরিয়া যুদ্ধে ৩৬ হাজার। এ শতাব্দীতে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লেও আমেরিকান সম্পদ আর নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমই হয়েছে। অথচ, শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ আমেরিকানের।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না, এড়াতে পারেন না করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক ধ্বস শুরুর দায়, এড়াতে পারেন না মিলিয়নের পর মিলিয়ন আমেরিকানের চাকরি হারানোর দায়ও। গত অর্ধ শতাব্দীতে তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রেসিডেন্সি ছাড়বেন নিট কোনো নতুন চাকরি তৈরি না করে। করোনাভাইরাস আক্রমণের শুরু থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষ নেতৃত্ব দিতে পারলে এই জীবন, সম্পদ আর অর্থনীতির ক্ষতি প্রশমিত হতো।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
জনতুষ্টিবাদী নেতারা ধর্ম, বর্ণের উপর ভিত্তি করে বিভাজন তৈরি করেন, বিভাজন তৈরি করেন শ্রেণি বা অবস্থানের উপর ভিত্তি করেও। জনতুষ্টিবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকে বিভাজনমূলক কথাবার্তা বলছেন, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনকে উস্কে দিয়েছেন, উস্কে দিয়েছেন বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজনকেও। ফলে, গণতন্ত্রের যে বহুত্ববাদের ধারণা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে আমেরিকাতে সেটি বারবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে, নির্বাচনে হেরে অসত্য দাবির মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকেও।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে বিশ্বব্যাপী উত্থান ঘটেছে কর্তৃত্ববাদের, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লঙ্ঘিত হয়েছে সংখ্যালঘুদের অধিকার। শতাব্দী ব্যাপী উদার গণতন্ত্রের চর্চা করা, লালন করা যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের সময়ে বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতনে চুপ থেকেছে, ট্রাম্পের দহরম-মহরম দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনতুষ্টিবাদী আর কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সাথে।
বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে সরে আসা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আবির্ভূত হয় একক পরাশক্তি হিসেবে। এই দীর্ঘ সময়ে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, নেতৃত্ব এসেছে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্টও। কিন্তু এদের কেউই আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেননি। ডেমোক্রেটরা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে কম হস্তক্ষেপের সাথে দক্ষ কূটনীতি দিয়ে, রিপাবলিকানরা সাধারণত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের যে আবেদন, তা কোনো দলের কাছেই ফিকে হয়ে যায়নি।
প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থেকে উঠে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানেও হেঁটেছেন অপ্রথাগত পথে। যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রমেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামো থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছেন, চেয়েছেন বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্থান ছেড়ে দিতে। যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, ইরানের সাথে ছয় জাতির চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ইউনিসেফ থেকে। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগে চূড়ান্ত অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন, জাতিসংঘেও চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল ম্লান। বিভিন্ন জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ বিব্রত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্রদের, বাধাগ্রস্ত করেছে নিরাপত্তার বৈশ্বিক ধারণাকে।
অভিবাসন নীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র যে বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসনে আছে, তার অন্যতম একটা কারণ, বিশ্বের সব প্রান্তের অভিবাসীদের গন্তব্য হয়ে উঠতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অভিবাসীদের উদ্যোগ নেওয়ার প্রবণতা সচল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে, স্কলারশিপ দিয়ে বাছাই করে নিয়ে আসা অভিবাসীরা সচল রাখে যুক্তরাষ্ট্রের ইনোভেশন ইঞ্জিন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব এই অভিবাসীদের স্রোত ঘুরিয়ে দিচ্ছে ইউরোপের দিকে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর দিকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম সাতটি দেশ থেকে পুরোপুরিভাবে বন্ধ করেছিলেন অভিবাসী গ্রহণ, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের দোহাই দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে চিন্তা করলেও এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়েছে, কেননা, সংঘাতকালে এসব দেশ থেকে দক্ষ পেশাজীবীদের অনেকেই অভিবাসী হতেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেটি লাভবান করত যুক্তরাষ্ট্রকেই।
এর বাইরে সীমান্তে আটক অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করে সমালোচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, সমালোচিত হয়েছেন তাদেরকে বন্দি শিবিরে প্রেরণ করে, শিশুদেরকে বাবা-মা থেকে আলাদা করে। বন্দি শিবিরের অসুস্থ পরিবেশ মৃত্যুর কারণ হয়েছে বেশ কিছু শিশুর, যেটি নিয়েও সমালোচিত হয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পিজম কি টিকে যাবে?
রাজনীতিতে আউটসাইডারের মতো প্রবেশ করা ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যিকার অর্থে একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছেন, শাসন কাঠামোতে রেখে যাচ্ছেন দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। তার আলোচিত ব্যর্থতাগুলোর পরও এ বছরের নির্বাচনে সাত কোটিরও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, দায়িত্বে থাকা প্রেসিডেন্ট হিসেবে যা সর্বোচ্চ। কট্টর ডানপন্থী, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এই নেতার লিগ্যাসি কি টিকে থাকবে? টিকে থাকবে ট্রাম্পিজম?
না, আপাতদৃষ্টিতে ট্রাম্পিজম টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, ভোটের ডেমোগ্রাফির কারণে ট্রাম্পিজম টিকবে না। গত কয়েক দশকে প্রচুর অভিবাসী গ্রহণ আর অভিবাসীদের উচ্চ প্রজনন হার ডেমোক্রেটিক শিবিরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তুলেছে। যার কারণে, গত আটটি প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের মধ্যে সাতটি নির্বাচনেই পপুলার ভোটে জয় হয়েছে ডেমোক্রেটদের। এ ধারা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে আরো বড় হবে ডেমোক্রেটিক শিবির, শ্বেত বৃদ্ধদের সংখ্যাহ্রাসের সাথে সাথে ক্ষুদ্র হবে রিপাবলিকান শিবির। ফলে, ভোটের সমীকরণে টিকে থাকতে হলে রাজনীতি বদলাতে হবে রিপালিকান পার্টি, চেষ্টা করতে হবে ভোটের স্টেক হোল্ডার গ্রুপগুলোকে কাছে আনার। রিপাবলিকান পার্টির এ পরিবর্তন হবে সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় এবং সেখানে ট্রাম্পের জায়গা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ট্রাম্পের পাগলাটে কার্যক্রম বিরক্তির কারণ হয়েছে অনেক শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান নেতার, ক্ষুব্ধ করেছে অনেক রিপাবলিকান সমর্থকদের। ফলে, ট্রাম্পের মেয়াদেই মিট রমনির মতো সিনিয়র নেতারা সরাসরি বিরোধিতা করেছেন ট্রাম্পের, বিরোধিতা এসেছে রিপাবলিকান থিংক ট্যাংকের পক্ষ থেকেও।
এবারের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের শেষদিকেই ফান্ডিং স্বল্পতায় ভুগেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, শেষদিকে বাতিল করতে হয়েছে অনেকগুলো জনসভা, পাবলিক র্যালি। এগুলো আসলে বার্তা দেয়, ট্রাম্পিজমের, ট্রাম্পের আবেদন কমছে, কমছে গ্রহণযোগ্যতা।
আরো দেখুন: প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাফল্য