আন্তর্জাতিক রাজনীতির ‘সিকিউরিটি ডেলিম্মা” তত্ত্ব অনুযায়ী প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে থাকে উদ্বিগ্ন, সর্বদা থাকে সজাগ। রাশিয়া, ইউক্রেন, উত্তর কোরিয়া, এমনকি একসময়ে দাপটে বিশ্ব শাসন করা ব্রিটেন, বর্তমানের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাশিয়া এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণ করে একসময়ের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ইউক্রেনে। রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকর্তা হয়ে নিজেদের পরাশক্তি হবার কথা জানান দেয়। শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। বিশ্বব্যবস্থা হয়ে যায় দুই-মেরুকেন্দ্রিক। ১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্বাচভের সময় পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের, জন্ম হয় ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে শেষ হয় স্নায়ুযুদ্ধ। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে রাশিয়া অনেকটা নীরব ছিল। বর্তমানে ইউক্রেনে যদি রাশিয়া নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, জয়ী বা পরাজিত হয়, তাহলে বিশ্বব্যবস্থায় নতুন করে কী ঘটবে? কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বিশ্বব্যবস্থা? আবারও কি শুরু হবে স্নায়ুযুদ্ধ? পৃথিবীকে কি দেখতে হবে আরেকটি কোরিয়া যুদ্ধ, কিউবা সংকট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিংবা বিচ্ছেদের সেই বার্লিন দেয়াল?
বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মূলত তিন ধরনের বিশ্ব ব্যবস্থা রয়েছে; এক-মেরু, দ্বিমেরু, এবং বহু-মেরু বিশ্বব্যবস্থা সেখানে নিয়ে আলোচনা করা হয়। এক-মেরু বিশ্বে প্রতিষ্ঠা হয় একটি সুপার-পাওয়ারের একক নেতৃত্ব, যার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই রয়েছে। দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থায় পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো দুই ব্লকে বিভক্ত থাকে, যার ফলে শক্তি-সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়। তাছাড়া রয়েছে বহু-মেরুর বিশ্ব যেখানে না থাকে কোনো একক নেতৃত্ব, না থাকে শক্তি-সাম্য। প্রতিটি বিশ্ব-ব্যবস্থায় রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা ও অসুবিধা। এই লেখায় তুলে ধরা হবে রাশিয়ার নতুন করে পূর্বের মতো শক্তি-সাম্যের দিকে যাওয়া বিশ্বে যেরকম পরিবর্তন নিয়ে আসবে তা নিয়ে।
পুনরায় স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতার জানান দেয়। এর কিছুদিন পর ১৯৪৯ সালে রাশিয়া নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা জানিয়ে দেয় গোটা বিশ্বকে। বিশ্বে অস্তিত্ব থাকে দুটি সুপার-পাওয়ারের, রূপ নেয় দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেয় সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই নিজেদের গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে লড়াই চালিয়ে যায়। দুই ব্লকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সামরিক, অর্থনৈতিক সংগঠন; জোটবদ্ধ হতে থাকে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো। এই ধরনের বিশ্বব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিতে দ্বিমেরু বিশ্ব বলে। এই ধরনের বিশ্বে শক্তি-সাম্য (Balance of power) প্রতিষ্ঠা হয়। এজন্য একটি রাষ্ট্র যে পরিমাণ শক্তি বা নিরাপত্তা বাড়ায়, অপর রাষ্ট্র ঠিক ততটুকু বৃদ্ধি করে। এভাবে একটি শক্তির খেলা চলতে থাকে সবসময়। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব ব্যবস্থা এর প্রকৃত উদাহরণ।
স্নায়ুযুদ্ধকালে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ইরান সংকট, বার্লিন দেয়াল, কোরিয়ান যুদ্ধ, কিউবা সংকট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন যুদ্ধ ও সংকট। বর্তমানে রাশিয়া চীনের সাথে সীমাহীন বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে রাশিয়ার রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সাথে রয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য শক্তি, যেমন- ভারত, ইরান ইত্যাদি। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ নিজেদের অধিকারে নিয়েছে। তারা যদি ইউক্রেনে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে বিশ্বে আবার স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হবে বলে অনেক বিশ্লেষকের অভিমত।
এবারের স্নায়ুযুদ্ধ: গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধকালীন পৃথিবী দুটো ব্লকে বিভক্ত ছিল। সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে ১৯৮৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে। অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা পায় সমাজতন্ত্র। এর পতন ঘটে নব্বইয়ের দশকে। রাশিয়া আত্মপ্রকাশ করে একটি রিপাবলিক হিসেবে। বর্তমানের রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের রাশিয়া মূলত কোনো রিপাবলিক নয়, বরং একনায়কের অধীনে একটি সরকার। তারা কমিউনিস্ট বিশ্বের সরকারব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে অভিমত প্রকাশ করেন, দেশগুলোতে মূলত বিদ্যমান একনায়কতান্ত্রিক সরকার, যেখানে জনগণের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়, জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। জনগণ চাইলে সেসব দেশে নিজেদের ইচ্ছেমতো শাসককে ক্ষমতার চেয়ারে বসাতে পারে না। যেমনটি প্রত্যক্ষ করা যায় গণতন্ত্রে। সেজন্য বিশ্লেষকদের মত- বর্তমানে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ মূলত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নয়, বরং গণতন্ত্রের সাথে একনায়কতন্ত্রের।
একক নাকি বহু নেতৃত্বের দিকে বিশ্ব
দার্শনিক কার্ল মার্কসের উপলব্ধি ছিল, “ইতিহাসের শিক্ষা এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।” ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে পৃথিবীতে না ছিল একক কোনো সুপার-পাওয়ারের নেতৃত্ব, না ছিল শক্তি-সাম্যের উপস্থিতি। বরং তখন বিশ্বব্যবস্থায় বহু সমান সক্ষমতার রাষ্ট্র বা সুপার পাওয়ার বিদ্যমান ছিল, অর্থাৎ বহু-মেরুর বিশ্ব ছিল। বহু-মেরুর বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে, জোরদার করতে থাকে নিজেদের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে, তাই একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। এরকম বিশ্বে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে জোট গঠন করতে দেখা যায়। বহু-মেরুর বিশ্ব বেশিরভাগ সময় থাকে বিশৃঙ্খল, সম্ভাবনা থাকে যুদ্ধের। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক কিন্ডেলবার্গের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ বহু-মেরুর বিশ্ব ব্যবস্থা।
অন্যদিকে, এক-মেরুর বিশ্বে একটি সুপার পাওয়ার পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়। বিশ্বব্যবস্থা স্থির থাকে, যদিও হেজিমন রাষ্ট্রের জন্য উপকার বয়ে নিয়ে আসে বেশি। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে একাই প্রভাব খাটায় ও একা নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। রাষ্ট্রগুলো হেজিমনের দিকে ঝুঁকতে থাকে। হেজিমন রাষ্ট্রের চরম প্রভাব, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি নাক গলানো ইত্যাদি এক-মেরুর বিশ্বের হেজিমনের বিপরীতে নতুন হেজিমন গড়ে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের বিশ্ব স্থির থাকলেও হেজিমন রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায়।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকলেও তা দুই দশকের বেশি স্থায়ী হয়নি। বিশ্বব্যবস্থা আবারও চলে যায় ১০০ বছর আগের বহু মেরুর বিশ্বে। কিন্তু অনেক সুপার পাওয়ারের অস্তিত্ব থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাব অন্য রাষ্ট্রে যায় না। ইউরোপ মার্কিন মিত্র, চীন আঞ্চলিক হেজিমন হলেও বিশ্বব্যবস্থায় অতটা শক্তিশালী প্রভাব খাটাতে পারেনি। অন্যান্য সুপার পাওয়ার নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। রাশিয়া বর্তমানে মার্কিন সম্প্রসারণ রুখতে ইউক্রেন আক্রমণ করে নিজেকে আবার মার্কিন সমকক্ষ জাহির করতে চাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দখল করে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার উত্থান হলে পৃথিবী হয়তো আবার শক্তি-সাম্যের দিকে যাবে, যেখানে রাশিয়ার মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার সাথে জড়ো হবে, অপরদিকে মার্কিন মিত্ররা গণতান্ত্রিক বিশ্বের ছায়াতলে জড়ো হবে। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিরাট ভুল পদক্ষেপ। তারা যদি ইউক্রেনে হেরে বসে, তাহলে রাশিয়ার ব্যর্থতা প্রমাণ হবে। বিশ্বব্যবস্থা হয়তো বহু-মেরুর দিকে ধাবিত হবে। কারণ আমেরিকা, রাশিয়া ছাড়াও অন্য রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে, জোরদার করছে নিজেদের কৌশলগত নিরাপত্তা।
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, রাশিয়ার উত্থান বিশ্বব্যবস্থায় শক্তি-সাম্য প্রতিষ্ঠা করলেও পরিপূর্ণ শক্তি-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে না, যেমনটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়। কারণ বর্তমানে কমিউনিস্ট বিশ্বের মধ্যে সুপার পাওয়ার রয়েছে, যাদের প্রভাবও রাশিয়া খাটো করে দেখতে পারবে না। আবার রাশিয়ার পরাজয় বহু-মেরুর বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করলেও সেই বিশ্ব মূলত পরিপূর্ণ বহু-মেরু বিশ্ব হবে না। কারণ আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো অন্য কোনো সুপার পাওয়ার নিজেদের ক্ষমতা খাটাতে পারবে না।