আইডেন্টিটি একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে একজন আরেকজনের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা অনুভব করেন। আইডেন্টিটির সাদৃশ্য প্রতিবেশীদের সাথে তৈরি হতে পারে, একই কমিউনিটিতে বসবাস করার কারণে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, আবার ‘আমরা’ অনুভূতি তৈরি হতে পারে একই ধর্মের মানুষের মধ্যেও। আইডেন্টিটি একদিকে যেমন উষ্ণতা আর শক্তির জায়গা, আবার এর কারণেই তৈরি হয় সংঘাত ও সহিংসতা।
স্বার্থের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংঘাত দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করা যায়, কিন্তু আইডেন্টিটির কারণে তৈরি হওয়া সংঘাত দীর্ঘদিন চলে। বিবাদমান আইডেন্টিটিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় একটি আইডেন্টিটির বিরুদ্ধে আরেকটি আইডেন্টিটির সংঘাত উৎপাদনের ক্ষমতা। আইডেন্টিটি এমন একটি ধারণা, যা কিছু মানুষকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে দেয়, বাকি সবার থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তুলে ধরে। সংঘাত উৎপাদনের কারণে আইডেন্টিটিকে অনেক সময় একটি ‘জেনারেল এভিল’ হিসেবে দেখা হয়।
ইউক্রেন সংকট
সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিপাবলিক ছিল ইউক্রেন, ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতখানা আর কৃষিপণ্যের বৃহত্তম উৎস। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন। তবে, স্বাধীনতার পরেও ইউক্রেনের ক্ষমতার বলয়ে ছিল রাশিয়ার প্রভাব, ইউক্রেনকে রাশিয়া ঘনিষ্ঠ মিত্রের পাশাপাশি দেখতে চেয়েছে স্যাটেলাইট স্টেট হিসেবেও।
স্বাধীনতার পর থেকেই ইউরোপের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর নাগরিক অধিকারের ধারণার বিকাশ শুরু হয় ইউক্রেনে, রুশ ঘরানার কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রো-ডেমোক্রেটিক একটি নাগরিক সমাজ তৈরি হয়। সাধারণত, রুশভাষী ৮ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় রাজনৈতিক সংযোগ অনুভব করতে শুরু করে রাশিয়ার প্রতি, ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলা ইউক্রেনীয়রা রাজনৈতিক সংযোগ অনুভব করে ইউরোপের প্রতি। দুই ধরনের রাজনৈতিক সংযোগ দুটি ভিন্ন আইডেন্টিটি তৈরি করে, যে দুটি আইডেন্টিটি বৃহৎ পরিসরে মুখোমুখি দাঁড়ায় ২০১৩-১৪ সালের সংকটে। পরবর্তীতে, ভাষা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য আর আইডেন্টিটির ভিত্তিতে বৈষম্যকে কেন্দ্র করে বদলেছে সংঘাতের প্রকৃতি, বেড়েছে সংঘাত আর হতাহতের সংখ্যা।
সাম্প্রতিক সংঘাতের সূচনা হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রুশভাষী নাগরিকদের রক্ষার যুক্তি তুলে ধরে নির্দেশ দেন ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনার। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে, তাতেও পক্ষ নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে আইডেন্টিটির ধারণা, ভূমিকা রেখেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত সংহতি সমাবেশ ও রাজনৈতিক সমাবেশ।
তুলনামূলক আইডেন্টিটির ধারণা
আইডেন্টিটির ব্যাপারে অমর্ত্য সেন দুটি প্রধান ধারণা উল্লেখ করেছেন।
প্রথমত, একজন মানুষের বহু আইডেন্টিটি থাকতে পারে। যেমন, একজন মানুষ একইসাথে ইউক্রেনীয়, খ্রিষ্টান, রুশভাষী, প্রো-রাশিয়ান, নারী, ছাত্রী, ফেমিনিস্ট হতে পারেন। আবার আরেকজন ইউক্রেনীয় মুসলিম, তাতার, প্রো-ডেমোক্রেটিক, লিবারেল, সেক্যুলার, ক্যাপিটালিজমে বিশ্বাসী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ হতে পারেন। বহু আইডেন্টিটি আসলে একজন মানুষকে অনেকগুলো আইডেন্টিটি গ্রুপের সদস্য করে, তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ দেয়।
দ্বিতীয়ত, একজন মানুষ অবস্থা আর পারিপার্শ্বিকের বিবেচনায় যেকোনো আইডেন্টিটিকে পছন্দ করতে পারেন। যেমন, চার্চে গেলে খ্রিষ্টান পরিচয় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে ছাত্রী পরিচয়, নারী অধিকারের ইস্যুতে আসতে পারে ফেমিনিস্ট আইডেন্টি। একজন মানুষ এভাবে আইডেন্টিটি পছন্দের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করবেন, নিজের পছন্দ অনুযায়ী যুক্ত হবেন আইডেন্টিটি গ্রুপে। অর্থাৎ, এখানে ‘Role of Choice’ থাকবে।
আইডেন্টিটির স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা
আইডেন্টিটির স্বাধীনতা হচ্ছে, একজন মানুষের বহু আইডেন্টিটি ধারণ করতে পারেন, অবস্থান ও পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে নিজের প্রাসঙ্গিক আইডেন্টিটি পছন্দ করতে পারেন। একজন মানুষ অগ্রাধিকার, অনুরাগ, সংযুক্তি আর আনুগত্যের ভিত্তিতে আইডেন্টিটি পছন্দ করবেন।
কিন্তু, আইডেন্টিটির এই স্বাধীনতা সবাই উপভোগ করতে পারেন না। কিছু মানুষ যেমন যুক্তি দেয়, প্রধান কমিউনাল আইডেন্টিটি আত্মোপলব্ধির ব্যাপার, এটি পছন্দ করার ব্যাপার নয়। এটি বিশ্বাস করা কঠিন হলেও, পৃথিবীর অধিকাংশ কর্তৃত্ববাদী শাসকই এভাবে আইডেন্টিটি মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, একই আইডেন্টিটির ধারণায় তৈরি করেছেন সর্বাত্মকবাদ।
ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রেও একক আইডেন্টিটি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায় দুই পক্ষের দিক থেকেই। ইউক্রেনীয়দের প্রো-ইউরোপ হওয়া রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি, দনবাস অঞ্চলে রুশভাষীদের প্রো-রাশিয়ান হওয়া মেনে নিতে পারেনি ইউক্রেন।
আইডেন্টিটির ব্যাপারে অন্যদের সন্তুষ্ট করা
একজন মানুষ নিজে হয়তো বহু আইডেন্টিটি ধারণ করেন, প্রয়োজনের সাপেক্ষে তিনি বিদ্যমান আইডেন্টিটিগুলোর মধ্যে থেকে যেকোনো একটি প্রাসঙ্গিক আইডেন্টিটি বেছে নেন। কিন্তু, আইডেন্টিটি পছন্দের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, বিশেষ করে অন্যরা সেই ব্যক্তিকে কোন আইডেন্টিটির আলোকে মূল্যায়ন করছেন সেটি। একজন ব্যক্তি হয়তো অন্যরা তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে, সেটি কখনোই জানতে পারেন না, নিয়ন্ত্রণ করেন না সেই মূল্যায়নের ব্যাকগ্রাউন্ড ফ্যাক্টরগুলো।
চলমান ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষেত্রেও আইডেন্টিটির ব্যাপারে অন্যদের সন্তুষ্ট করতে পারার ব্যর্থতা একইভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনীয়রা ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি যে মস্কোর সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারেন, সেই বাস্তবতা সামনে আনতে পারেননি। আবার, কিয়েভ প্রশাসন আবার দনবাস অঞ্চলের নাগরিকদের স্বায়ত্বশাসনের পাশাপাশি ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে পারে, সেই বহুমাত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারেনি।
সভ্যতার সংঘাতের অবতারবাদ
স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ধর্মীয় পরিচয় আর সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীকে আটটি প্রধান সভ্যতায় ভাগ করেছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল ক্রীড়ানক হিসেবে তুলে ধরেছেন এই সভ্যতাগুলোকে। হান্টিংটনের এই আইডেন্টিটির ধারণা অনেকটা চাপিয়ে দেওয়া আইডেন্টিটির মতো, কারণ এই কাঠামোকে একজন মানুষের সভ্যতাকেন্দ্রিক পরিচয়ের বাইরে অন্য পরিচয়কে প্রাসঙ্গিক করার সুযোগ নেই। হান্টিংটন এই একক পরিচয়ের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মীয় পরিচয়ের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইডেন্টিটিগুলো।
অর্থাৎ, হান্টিংটনের দর্শনানুযায়ী, একজন হিন্দুকে কেবলই হিন্দু পরিচয়ের আলোকে বিবেচনা করতে হবে। তিনি অন্য যেসকল আইডেন্টিটি ধারণ করেন, সেগুলোকে মূল্যায়নের সুযোগ থাকে না। যেমন, সেই ব্যক্তি লিবারেলিজম, সেক্যুলারিজমের মতো পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দর্শনগুলোর সমর্থন করতে পারেন, কিন্তু হান্টিংটনের দর্শনে তিনি কেবলই হিন্দু।
হান্টিংটন সভ্যতার সংঘাতের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সভ্যতার অভ্যন্তরীণ বিভাজনগুলোকে এড়িয়ে গেছেন, এড়িয়ে গেছেন মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগের ফলে তৈরি হওয়া পারস্পরিক আত্মোপলব্ধি। মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগ ছাড়িয়ে যেতে পারে সভ্যতার সীমানা।
হান্টিংটনের এই আইডেন্টিটির ধারণা চলমান ইউক্রেন আর রাশিয়ার সংকটকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া আর ইউক্রেন হান্টিংটনের ব্যাখ্যানুযায়ী অর্থোডক্স সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। হান্টিংটন সভ্যতার অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাত প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু সেটি সভ্যতার অভ্যন্তরেই থাকার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। চলমান ইউক্রেন আর রাশিয়ার সংকট অর্থোডক্স সভ্যতার সীমানা পেরিয়েছে। এই সংকটে বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ, তৈরি হয়েছে একটি বাইপোলার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামো।
ধর্মীয় পরিচয়ের সম্মিলন
পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় আইডেন্টিটি থাকার পরও, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি বাধ্যবাধকতার সংস্কৃতি রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। ফলে পৃথিবীকে মানুষের সম্মিলন হিসেবে দেখার চেয়ে দেখা হয় ধর্মীয় আইডেন্টিটির সম্মিলন হিসেবে। এই পরিচয় তৈরির প্রক্রিয়ায় ধর্মের মধ্যে থাকা বৈচিত্র্যকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়।
রাশিয়া আর ইউক্রেন, দুই দেশের ক্ষেত্রেই প্রায় আশি শতাংশ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান। কিন্তু, সংঘাতের সময় দেখা গেছে, দুই দেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দর্শন, সার্বভৌমত্বের ধারণা, এবং জাতীয়তাবাদ।