পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি শৈশবেই দেখেছেন রাজাদের অসীম ক্ষমতা চর্চার প্রাণান্তকর চেষ্টা, ক্ষমতার ঘন ঘন পরিবর্তন। ইউরোপের অন্যান্য অংশের মতো ইতালিতেও রাজা আর পোপদের মধ্যে চলছিল ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ছিল খোদ চার্চগুলোর মধ্যেও। সেই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে রাষ্ট্রীয় আমলা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তীতে তার আবির্ভাব ঘটে একজন রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে।
রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির যেসব কাজ রয়েছে, তার মধ্যে ‘দ্য প্রিন্স’ সবসময়ই একাডেমিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে। এই লেখায় ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্সের আলোকে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হবে, আলোচনা করা হবে যুবরাজ বিন সালমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে।
‘দ্য প্রিন্সের’ প্রথম অধ্যায়
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার বই, ‘দ্য প্রিন্সের’ প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পদ্ধতি সম্পর্কে। ‘দ্য পলিটিক্সে’ এরিস্টটল ছয় ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা দিলেও, ম্যাকিয়াভেলি ধারণা দিয়েছেন দুই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার। প্রথমত রাজতন্ত্র ও দ্বিতীয়ত সাধারণতন্ত্র। রাজতন্ত্রের আবার দুইটি ভাগ রয়েছে, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ও নব্য প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র।
ইবনে সউদ পরিবার, আবদুল আজিজ ইবনে সউদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর ভাগ্যের সহায়তায় সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠা করে প্রায় একশো বছর আগে। বর্তমান সময়ের বাদশাহ সালমান ইবনে আবদুল আজিজ সৌদি রাজবংশের দ্বিতীয় প্রজন্ম, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান উঠে এসেছেন রাজবংশের তৃতীয় প্রজন্ম থেকে। ফলে, সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।
‘দ্য প্রিন্সের’ দ্বিতীয় অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র কীভাবে শাসন করতে হয় ও রাজবংশকে কীভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়। নব্য প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের চাইতে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে শাসনকার্য চালিয়ে যাওয়া তুলনামূকভাবে সহজ। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে রাষ্ট্রনায়ক যদি প্রজন্ম ধরে চলা প্রথা আর রীতিনীতি অনুসরণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, প্রথা অনুসরণ করে কালোপযোগী কিছু নীতি নেন, তাহলে রাষ্ট্রনায়কের শাসন মোটামুটিভাবে মসৃণ হয়, আকস্মিক বড় কোনো বিপদ না আসলে শাসনকার্য চালিয়ে যেতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মধ্যে দিয়ে। একই বছর এপ্রিলে সৌদি আরবের ক্ষমতার শীর্ষপদে রদলবদল ঘটে, বয়স ত্রিশের কোঠায় থাকা মোহাম্মদ বিন সালমান অধিষ্ঠিত হন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে। দুই বছর পরেই দায়িত্ব নেন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে, পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ বাদশাহের পাশে আবির্ভূত হন সৌদি আরবের ডি ফেক্টো লিডার হিসেবে। সৌদি আরবের অভ্যন্তরীন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন যুবরাজ বিন সালমানের হাতে, তার ইচ্ছাতেই ঠিক হয় সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি। একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শাসনকাঠামোতে উপভোগ করছেন অসীম ক্ষমতা।
রাজনৈতিক উত্থানের শুরু থেকেই বেয়াড়া রাজপুত্রের মতো সউদ রাজবংশের দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা প্রথা আর রীতিগুলোকে ভাংছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে সাধারণত দায়িত্ব নিতেন ষাটোর্ধ্ব কেউ, শাসনকার্য পরিচালনায় যার রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। অল্প বয়সে অভিজ্ঞতাহীন অবস্থায় বিন সালমানের উত্থানের শুরুতেই তাই জড়িয়ে যায় প্রথা ভাঙার ঘটনা। এরপর, মরুর গোষ্ঠীপ্রধানদের সাথে দ্বন্দ্ব জড়িয়েছেন তিনি, ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে তৈরি হয়েছে দূরত্ব, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন প্রথা ভেঙে।
দেশের বাইরে যুদ্ধে সরাসরি না জড়ানোর প্রথা ছিল সৌদি রাজপরিবারের, ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে যুবরাজ বিন সালমান ভেঙেছেন সেই প্রথাও। ফলে, শাসনকার্য পরিচালনায় একের পর এক দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন বিন সালমান। এই অবস্থায় আরব বসন্তের মতো আকস্মিক রাজনৈতিক উত্থান কিংবা সৌদি রাজপরিবারের তৈরি করা কোন দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ সংকটে ফেলে দেবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে, সংকটে ফেলবে ইবনে সউদ পরিবারকেও।
‘দ্য প্রিন্সের’ তৃতীয় থেকে সপ্তম অধ্যায়
দ্য প্রিন্সের তৃতীয় থেকে সপ্তম অধ্যায় পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে নবলব্ধ রাজ্য কীভাবে শাসন করতে হয়, সেই ব্যাপারে। সৌদি আরবে প্রায় একশো বছর আগে নিজেদের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সউদ পরিবার। সেই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের একজন শাসক হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমান উত্থানকে নবলব্ধ রাজ্য শাসনের আলোচনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা প্রাসঙ্গিক হতো না। কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতি নবলব্ধ রাজ্য শাসনের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক দুই কারণে। প্রথমত, গত দশকে মধ্যপ্রাচ্যে হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ সৌদি আরবেও লেগেছে, জোরালো হয়েছে রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি। ফলে, শাসক হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমান এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো সৌদি আরবের প্রথাগত রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় এসে নিজেকে সংস্কারপন্থী হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে ‘আউটারসাইডার’ বানিয়ে ফেলেছেন।
‘দ্য প্রিন্সের’ তৃতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায়ে ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন বিমিশ্র রাজতন্ত্র সম্পর্কে। একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে দেখা যায় যে, প্রজাগণ স্বেচ্ছায় নব রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত সুখ লাভের আশায় আনুগত্য স্বীকার করে নেয়, প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করে পূর্ববর্তী শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন শাসকের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত সুখলাভের স্বপ্ন সময়ের সাথে বিবর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। প্রজারা তখন তাদের দুঃখ-কষ্টের দায় চাঁপায় রাষ্ট্রনায়কের উপরে, নতুন রাজাকে মনে করে তাদের দূর্ভাগ্যের কারণ হিসেবে। ফলে, দ্রুত রাজার প্রতি প্রজাদের সমর্থন কমতে থাকে, প্রজারা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে, প্রয়োজনে রাজার বিরুদ্ধে হাত মেলায় বিদেশি শক্তির সাথে।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান শুরু থেকেই নিজেকে সংস্কারপন্থী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, সংস্কারপন্থী ভাবমূর্তির মাধ্যমে নিজেকে জনপ্রিয় করতে চেয়েছনে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ অংশের মন জয় করতে সময়ের সাথে সিনেমার থিয়েটার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, কনসার্ট আয়োজনের অনুমতি দিয়েছেন, নারীদের দিয়েছেন গাড়ি চালানোর অনুমতি। তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরির জন্য অর্থনীতিকে বহুমুখী করার পরিকল্পনা করেছিলেন। শুরুর দিকে সফল হয়েছিল তার এই পরিকল্পনা, বাড়ছিল তার প্রতি জনসমর্থন।
কিন্তু, সময়ের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমানের এসব পরিকল্পনা ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে সৌদি আরবের মানুষদের কাছে। নারীদের গাড়ি চালানোর আইনি বাঁধাগুলো তুলে নিয়েছেন, কিন্তু একইসাথে বন্দী করেছেন অধিকারকর্মীদের, যারা নব্বইয়ের দশক থেকে নারীদের গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে দাবি জানাচ্ছিল। যুবরাজ বিন সালমানের অর্থনীতিকে বহুমুখী করার পরিকল্পনাও খুব একটা কাজে আসেনি, তৈরি হয়নি নতুন কর্মসংস্থান। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই, অর্থনৈতিক দুরাবস্থার দাঁয় চাপছে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাঁধে। কমছে তার প্রতি জনসমর্থন।
‘দ্য প্রিন্সের’ চতুর্থ অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বিজিত রাজ্যে বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়া আটকানোর ব্যাপারে। দুইটি পদ্ধতিতে যেকোনো ধরনের বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়া আটকানো যায়। প্রথমত, নিজের সহচরদের মন্ত্রী ও অন্যান্য পদে বসিয়ে রাজ্য শাসন করা, দ্বিতীয়ত, বিজিত রাজ্যের মধ্যে যারা সম্রান্ত সম্প্রদায়ের, যারা বংশানুক্রমে সেখানে অভিজাত সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃত, তাদেরকে দিয়ে দেশ শাসন করা। স্থানীয় জমিদার বা অভিজাত শ্রেণির মানুষদের নিজস্ব কিছু প্রভাব বলয় থাকে, নিজেদের থাকে সম্পদ বৃদ্ধির তাড়নাও। ফলে, কোনোরকম বিদ্রোহের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির চেয়ে তারা স্থিতিশীলতা রক্ষায় বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারাই স্থিতিশীল কাঠামো তৈরি করে সহযোগিতা করে নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী করতে।
২০১৫ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক উত্থান ঘটে মোহাম্মদ বিন সালমানের, বাবা বাদশাহ সালমানের সাহায্যে দুই বছরেই মধ্যেই হয়ে যান সৌদি আরবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ক্রাউন প্রিন্স। অনেকগুলো প্রথা ভেঙে ক্ষমতায় আসা মোহাম্মদ বিন সালমান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে স্থিতিশীল করতে বেঁছে নেন প্রথম পদ্ধতি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন শুরু করেন নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের। কিন্তু, সৌদি আরবের জন্য এই পদ্ধতি খুব একটা গ্রহণযোগ্য, এমন বিশ্লেষণ রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের কাছ থেকে উঠে আসেনি।
সৌদি রাজপরিবারকে বলা হয় হাজারো প্রিন্সের পরিবার, রাজপরিবারের সদস্য সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এই পুরো রাজপরিবার বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী অংশে বিভক্ত। এই প্রভাবশালী অংশগুলোর যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজস্ব প্রভাববলয় রয়েছে, রয়েছে অর্থনৈতিক সক্ষমতাও। ফলে, বাদশাহ সৌদি আরবে অসীম ক্ষমতা উপভোগ করলেও রাজপ্রিবারের বিভিন্ন প্রভাবশালী অংশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই শাসনকার্য চালাতে হয়। আবার, সৌদি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা আছে মরুর বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোর, সেসব গোষ্ঠীর শেখদের। ধর্মীয় অংশটি, বিশেষ করে আল-ওয়াহাব পরিবার, সৌদি আরবের রাজনীতিতে খুবই শক্তিশালী। নিজের একপেশে প্রভাববলয় তৈরি করতে গিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান রাজপরিবারের ভারসাম্য নষ্ট করেছেন, বেদুইন শেখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন, বিরোধ তৈরি হয়েছে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথেও।
‘দ্য প্রিন্সের’ পঞ্চম অধ্যায়
বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি, সভ্যতা ও সংগঠন আছে, এমন রাষ্ট্রকে শাসন করার ব্যাপারে। যেসব দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, রয়েছে সভ্যতার অগ্রগতির সুদীর্ঘ ইতিহাস, তাদেরকে শাসনে রাখা তুলনামূলক কঠিন, নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চাকে তারা ফিরিয়ে আনতে বারবার বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার জন্য। এ রকম দেশকে শাসন করতে হলে, হয় তাদের সংস্কৃতি, সভ্যতার অংশ হয়ে যেতে হবে, নতুবা তাদের সংস্কৃতি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে হবে।
সৌদি আরবের সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছে হাজারো বছর আগে, এই রাষ্ট্রের মক্কা-মদীনা থেকেই প্রচার শুরু হয় ইসলাম ধর্মের। সৌদি আরবের মানুষেরা এখনো নিজেদের সংস্কৃতিকে ধারণ করে, বিশ্বায়নের যুগেও সৌদ্র ঐতিহ্যবাহী পোশাক সগর্বেই টিকে আছে, ধর্মীয়ভাবেও দেশটি অত্যন্ত রক্ষণশীল। বর্তমান ডি ফেক্টো লিডার যুবরাজ বিন সালমান এই সংস্কৃতির মধ্যেই বড় হয়েছেন, তার পূর্বপুরুষদের আবাসভূমি ছিল এই ভূমিই। অর্থাৎ, সৌদিদের যে সংস্কৃতি, সভ্যতা, সচেতনভাবেই মোহাম্মদ বিন সালমান তা ধ্বংস করতে চাইবেন না।
তাহলে, মোহাম্মদ বিন সালমান কি এই সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছেন? চর্চা করছেন এই সংস্কৃতির? উত্তর হচ্ছে, না। দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করা রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে গিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান অনেকগুলো সংস্কার এনেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন ইসরায়েলের সাথে। ইসরায়েলের সাথে তার এই সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে দেশটির রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে, নেতিবাচক মূল্যায়ন করেছে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষণশীল অংশটিও। ধর্মীয় সম্প্রীতিকে পাশ কাঁটিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন সংখ্যালঘু শিয়াদের মৃত্যুদণ্ডের হার, সার্বিকভাবেও বেড়েছে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা।
প্রশ্ন আসতে পারে, ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল অংশের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও কি সৌদি আরবে সংস্কারগুলো আনা উচিত না? ম্যাকিয়াভেলির দর্শন থেকে উত্তর হচ্ছে, না, মোহাম্মদ বিন সালমানের এই কাজগুলো করা উচিত না। একজন শাসক শুধু সেই কাজগুলোই করবেন, যেগুলো তার শাসনের সহযোগী হবে, তার শাসনকে মসৃণ করবে। সংস্কারপন্থী কাজগুলো যুবরাজ বিন সালমানের শাসনকার্য পরিচালনাকে সহজ করছে না, অপ্রয়োজনীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে শত্রু, নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ঝুঁকির মুখে পড়ছে শাসনকাঠামোও।
‘দ্য প্রিন্সের’ ষষ্ঠ অধ্যায়
‘দ্য প্রিন্সের’ ষষ্ঠ অধ্যায়ে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি আলোচনা করেছেন নিজ ক্ষমতা ও সৈন্যবলে বিজিত রাজ্যের শাসনপ্রক্রিয়া নিয়ে। মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের রাজপরিবারের অংশ, দীর্ঘদিন ধরেই এই রাজপরিবার শাসন করছে সৌদি আরবকে। সৌদি রাজতন্ত্রে প্রিন্সদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রকাঠামোর শীর্ষপদে আরোহণের সংস্কৃতি রয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমান সেই পন্থাও অনুসরণ করেননি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের যাত্রাই শুরু হয় বিনা অভিজ্ঞতায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। এই অধ্যায়ের আলোচনায় তাই মোহাম্মদ বিন সালমান প্রাসঙ্গিক নন।
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রকাঠামোতে অসীম ক্ষমতা ভোগ করছেন যুবরাজ বিন সালমান, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিও। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা সৌদি আরবের এই শাসককে নিয়ে আলোচনা আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্সের’ আলোকে মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনীতি, রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আলোচনার অবশিষ্ঠ অংশটুকু থাকবে সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে।