Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা

মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকর করার আর রাজনৈতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে গণতন্ত্রকে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে চর্চা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চার ধরনের উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও পরোক্ষ গণতন্ত্র। পরোক্ষ গণতন্ত্র আবার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র হিসেবেও পরিচিত।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র কী?

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নাগরিকেরা সাধারণত নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করে, রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় দীর্ঘমেয়াদী নীতিগুলো প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে, ভোটের মাধ্যমে বা বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের মতামতকে উপস্থাপন করে। পরোক্ষ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই সুবিধাটি নেই। বরং, পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নাগরিকেরা ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।

বর্তমান সময়ে প্রচলিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র; Image Source: CFFAD

প্রত্যেক সংসদীয় আসন বা প্রতিনিধিত্বমূলক পদের জন্য সাধারণত একাধিক প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করেন, একাধিক প্রার্থীর মধ্যে থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সাধারণত তার মেয়াদের মধ্যে স্থানীয় নাগরিকদের বা তার সংসদীয় আসনের নাগরিকদের নাগরিক সুবিধাগুলো প্রদানের দায়িত্বে থাকেন, নাগরিক সুবিধাগুলোর প্রাপ্তিতে সুষম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সুবিধা

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি রয়েছে, রয়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোর কার্যকর উপস্থিতি। কিন্তু, প্রায় প্রতিটি দেশের গণতন্ত্রেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, আছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো চর্চার নিজস্ব কিছু ধরন। তাত্ত্বিক বিতর্কগুলোর পাশাপাশি তাই আমাদের সামনে প্রায়োগিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও অনেক ব্যতিক্রম উঠে আসে, অনেকগুলো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও তাদের রাজনৈতিক কৌশলের সাথে পরিচিত হই আমরা। এই বৈচিত্র্যের একটি দিক হলো, প্রাচীন নগররাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চা ছিল, বর্তমান সময়ের জাতিরাষ্ট্রগুলোতে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে থাকে। অনেকগুলো কারণেই বর্তমান জাতিরাষ্ট্রগুলো প্রতিনিধত্বমূলক শাসনব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছে।

প্রথমত, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামো হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রকৃতি আর গঠন বিবেচনায় বর্তমান সময়ের অধিকাংশ রাষ্ট্রই জাতিরাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতিরাষ্ট্রগুলোতে তুলনামূলকভাবে বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস থাকে। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১২৮ কোটি, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ কোটি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি, তুরস্কের জনসংখ্যা ৯ কোটির কাছাকাছি। অন্যান্য জাতিরাষ্ট্র, যেগুলোতে গণতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে, গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের চর্চা রয়েছে, অধিকাংশ দেশেরই জনসংখ্যা কোটির উপরে। এই বিপুল জনসংখ্যা বাহ্যিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করার মতো অবকাঠামো কোনো দেশেরই নেই, এ ধরনের অবকাঠামো তৈরি করাও কার্যত অসম্ভব। ফলে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে।

মালেশিয়ার সংসদ; Image Source: MalaysiaNow

দ্বিতীয়ত, একটি জাতিরাষ্ট্রে কয়েক কোটি মানুষ থাকে সাধারণত। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজের সাথে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সংযুক্ত করা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে এই ব্যয়ের বিপরীতে রাষ্ট্রের প্রাপ্তি সামান্যই। পাশাপাশি, সকল জনগণকে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজগুলোতে যুক্ত করার একটি বিশাল রাজনৈতিক ঝুঁকিও রয়েছে, যেটি প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজগুলোতে সময় দেওয়া বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোর রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব না। প্রায় প্রত্যেককেই বাধ্যতামূলকভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে হয়। দৈনিক সময়ের একটি বিশাল অংশ এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে নাগরিকেরা। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজের সাথে জড়িত হওয়া নাগরিকদের এই অংশের জন্য বিরক্তিকর, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৈরি করতে পারে মানসিক অগ্রহণযোগ্যতা।

চতুর্থত, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকেরা শাসনতন্ত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রের আইন তৈরি করে, রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক আদর্শ নির্ধারণ করে। জাতীয় পর্যায়ের বাইরে থাকে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যারা নাগরিক সুবিধাগুলো সরবারহের ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। ফলে, একজন নাগরিক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি ধাপে তার প্রতিনিধিত্ব থাকে। তার রাজনৈতিক পছন্দগুলো রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরে, নাগরিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে কাজ করে।

ভারতের পার্লামেন্ট; Image Source: News18 Hindi

প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা

বর্তমান সময়ের সাথে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো চলমান রাখার উপায় হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। রাজনৈতিক পছন্দের শীর্ষে থাকলেও, এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কিছু বাস্তবিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

প্রথমত, একজন জনপ্রতিনিধি সাধারণত চার বছর বা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। একবার ভোটের মাধ্যমে একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে ফেললে, একজন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে পরবর্তী চার বছর বা পাঁচ বছরের মধ্যে সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা একজন নাগরিকের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী কাজ না করলে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ না করলে, নৈতিক স্থলন ঘটলে বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও, একজন নাগরিকের পক্ষে সেই জনপ্রতিনিধিকে জবাবাদিহিতার আওতায় আনার কোনো উপায় নেই। উপায় নেই সমর্থন প্রত্যাহারের।

গুরুতর নৈতিক স্থলনজনিত বিষয়গুলোকে জবাবদিহিতার আনার জন্য তাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিছু রাজনৈতিক কাঠামো রয়েছে, রয়েছে কিছু রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও। কিন্তু, অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্রের চর্চা নতুন হওয়ায়, এসব প্রতিষ্ঠানের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। ফলে, রাজনৈতিক বা নৈতিক স্থলনগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম। আবার, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে নৈতিক স্থলনের অভিযোগও রয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই। জবাবদিহিতা তৈরির ক্ষেত্রে এটিও একটি অন্যতম বাঁধা।

একবার নির্বাচিত হয়ে গেলে সমর্থন প্রত্যাহারের সুযোগ নেই সাধারণ নাগরিকদের; Image Source: Global Times

দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত একটি শাসকশ্রেণি গড়ে উঠে, যারা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর সাথে যুক্ত থাকে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অধিকাংশ দেশেই দেখা যায়, এই প্রতিনিধিত্ব একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই আসে। ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি পরিচিতি পায় শাসকশ্রেণি হিসেবে। এই শাসকশ্রেণির উপস্থিতির কারণে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসার প্রক্রিয়া নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়, নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এই শাসকশ্রেণি।

তৃতীয়ত, সাধারণত প্রত্যেক দেশেই নাগরিকদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে নিয়ে একটি এলিট শ্রেণি গড়ে উঠে। এলিট রাজনীতিবিদ হতে পারেন, ব্যবসায়ী কমিউনিটির কেউ হতে পারেন, হতে পারেন বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকা প্রভাবশালী কেউ। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর সাথে দেশের অভিজাত ব্যবসায়ীদের সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। একটি সম্পর্ক বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিগুলোকে প্রভাবিত করে। বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলো শাসক আর ব্যবসায়ীদের এই আন্তঃসম্পর্ক নাগরিক সুবিধা আর অধিকারগুলোকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত না করলেও, বৈশ্বিক দক্ষিণের কোনো জাতিরাষ্ট্রে এই ধরনের সম্পর্ক রাষ্ট্রকে কতিপয়তন্ত্রের রাষ্ট্র বানিয়ে দিতে পারে। যেখানে রাষ্ট্র সামগ্রিক কল্যাণের জন্য কাজ না করে একটি ক্ষুদ্র অংশের কল্যাণের জন্য কাজ করে।

শাসকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন প্রভাবিত করে সরকারের সিদ্ধান্তকে; Image Source: Foreign Brief

বর্তমানে অনেক দেশেই আবার শাসকগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণি থেকে। ফলে, রাষ্ট্র কতিপয়তন্ত্রের অধীনে চলে যাওয়ার ঝুঁকি আরো বাড়ে।

চতুর্থত, প্রতিনিধত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে আসে। জনপ্রতিনিধির অধীনে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করে, রাষ্ট্রের সামরিক আর আধা-সামরিক বাহিনীগুলোও থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে। ফলে, সরকারপ্রধান বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা চলে আসে। আর, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই প্রক্রিয়ার একটি নগ্ন চর্চাই দেখা যায়। অপরিপক্ক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোতে সরকারপ্রধান চাইলে যেকোনো কাজ করতে পারেন, যেকোনো কাজ আটকে দিতে পারেন, দণ্ডিতের সাজা মওকুফ করে দিতে পারেন। সীমাহীন এই ক্ষমতার চর্চা রাজনৈতিক অবতারবাদকে উস্কে দেয় সাধারণত। রাজনৈতিক অবতারবাদের ফলে ব্যক্তির রাজনৈতিক গ্লোরিফিকেশন হয়, যেটি গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে এবং দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচকভাবে কাজ করে।

This article is written in Bangla, about the political necessity of representative democracy and governance. 

All the necessary links are hyperlinked inside. 

Feature Image: Middle East Monitor

Related Articles