Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নৈরাজ্যবাদ কি আদৌ সম্ভব?

নৈরাজ্যবাদ সত্যিই সম্ভব কিনা বা কতটুকু কাজ করবে তা জানতে হলে আগে আমাদের নৈরাজ্য আর নৈরাজ্যবাদের পার্থক্য বুঝতে হবে। আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, সকল প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে দিয়ে, আইনের শাসনের অবসান ঘটিয়ে এমন এক সমাজ সৃষ্টি করা যেখানে কাউকে তাদের করা কাজের ফলভোগ করতে হবে না, এমন কিছুর নামই হয়ত নৈরাজ্যবাদ। আসলে এটি হলো নৈরাজ্য।

নৈরাজ্যই নৈরাজ্যবাদ নয়; Image Source: www.rogerebert.com

আর নৈরাজ্যবাদের মূল কথা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানকার কয়েকজনকে দিয়ে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ না করে, জনগণ যদি সবাই মিলে নিজেদেরকে পরিচালনা করে, তবে তারা ভালো থাকবে। নৈরাজ্যবাদীদের মতে, মানুষের তৈরী কোনো কিছু যখন অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয়, তখন তা যা-ই হোক না কেন, অবশ্যই খারাপ। এই সকল প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকাশক্তিই হলো সহিংসতা বা জোর করে কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়া।

নৈরাজ্যবাদের সত্যিকার পরিচয়; Image Source: www.issuu.com

নৈরাজ্যবাদীদের মূল মন্ত্র হলো, কোনোকিছু পাবার আশায় সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের আশায় বসে না থেকে সেটা নিজে করে ফেলা।  কিছু উদাহরণ হলো ১৯৭০ সালের দিকে যুক্ত্ররাষ্ট্রে করা ‘রেপ ক্রাইসিস সেন্টার’গুলো। নৈরাজ্যবাদীরা যদি সরকারের কাছে সাহায্য চাইত, তবে তাদের পক্ষ থেকে সরকারের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা স্বীকার করা হয়ে যেতো। তাই তারা সরকারের আশায় বসে না থেকে নিজেরাই একটা ব্যবস্থা করে।

কমিউনিজম (সাম্যবাদ) এবং লিবারেলিজমের (উদারনীতি) সাথে নৈরাজ্যবাদের বেশ মিল আছে। লিবারেলিজম বলে, সবাই স্বাধীন এবং সমান। কমিউনিজম বলে সবাইকে সবকিছু সমানভাবে দেয়া হবে। আর নৈরাজ্যবাদ বলে, সবাই সমান এবং সবাই সমান সুযোগ পাবে, কিন্তু এই সাম্য নিশ্চিত করার নামে সরকার বা রাষ্ট্র নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানের দরকার নেই। এই মতবাদগুলোর মূলনীতি প্রায় কাছাকাছিই, কিন্তু নৈরাজ্যবাদের সাথে মূল পার্থক্য সরকার বা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে। নৈরাজ্যবাদ প্রতিনিধিত্বের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না বরং বিশ্বাস করে সরাসরি গণতন্ত্রে। কোনো একটি সিদ্ধান্ত সবাই মিলেমিশে নেয়ায় বিশ্বাস করে।

সামাজিক নৈরাজ্যবাদ বলে, যখন সমাজে কোনো প্রয়োজন সৃষ্টি হবে, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ক্রাইসিস সেন্টারগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্বের ব্যাপার নেই, প্রতিষ্ঠানের প্রধান কে হবে, তা  নির্বাচন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার মতো কোনো ব্যাপার নেই বলেই, অর্থ চুরি কিংবা ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়ারও সুযোগ নেই।

নৈরাজ্যবাদের বিপক্ষে যুক্তি; Image source: https://i.ytimg.com

কিন্তু বড় পরিসরে, অর্থাৎ কয়েক কোটি মানুষের পক্ষে এভাবে মিলেমিশে সবকিছু করা সম্ভব নয়। তখন ছোট ছোট সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক দলে সবাই ভাগ হয়ে যাবে। এবং আদৌ সেই দলগুলোর ভেতর সমন্বয় থাকবে কিনা, তাও একটি চিন্তার বিষয়।
মানুষকে যদি আমরা সহজাতভাবেই লোভী এবং খারাপ হিসেবে ধরে নিই তবে নৈরাজ্যবাদ সম্ভব নয়। যদি সবাই ভালো হয় কিন্তু দুই তিনজন খারাপ হয়, তারা আরও দুই তিনজনকে তাদের দলে টেনে নেয়, ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায়, তবে নৈরাজ্যবাদী সমাজের ঠিক কী হবে, তা কেউই বলতে পারে না। হয়ত সবাই মিলে সেই খারাপদের তাড়িয়ে দেবে অথবা পুরো সমাজব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।

নৈরাজ্যবাদের বিশ্বাস; Image Source: ageofism.weebly.com 

নৈরাজ্যবাদ ঠিক তখনই জনপ্রিয়তা পায়, যখন শাসকগোষ্ঠী সাধারণ জনগণকে চূড়ান্ত শোষণ করে। একদম প্রথমদিকে আমরা সরকার গঠন করেছিই এই ভেবে যে, সরকার আমাদের নিরাপত্তা আর এতসব সুবিধা দেবে তার বিনিময়ে আমার এতটুকু স্বাধীনতায় ছাড় দেয়াই যায়। যখন সরকার বা রাষ্ট্র লোভী হয়ে ওঠে, তখন নৈরাজ্যবাদীরা এসে বলে, সরকার ছাড়াও চাহিদা মেটাবার আরো উপায় আছে। আর তখনই সাধারণ মানুষ ঝুঁকে যায় নৈরাজ্যবাদের দিকে।

সহিংস নৈরাজ্যবাদী ইতিহাসে ছিল, এখনও আছে, যারা নিজেদের নীতি অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেয়। তবে বেশিরভাগ নৈরাজ্যবাদীই শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন কিংবা বিভিন্ন ক্রাইসিস সেন্টার ও দাতব্য সংস্থা স্থাপনের মতো সরাসরি কাজে বিশ্বাসী। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীদের ঘৃণ্য সহিংসতার ইতিহাস ভুলে গেলেও চলবে না। দীর্ঘ সময় জুড়ে নির্বিচার বোমা হামলা ছাড়াও তারা শুধু দশ বছরের মধ্যেই যুক্ত্ররাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী, ইতালির রাজা এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞীকে হত্যা করে। 

সফল নৈরাজ্যবাদের বেশ ভালো উদাহরণ আছে। ‘স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার’ এর আগে স্পেনের অনেক গ্রাম ছিল যারা ছিল নৈরাজ্যবাদী এবং বেশ শান্তিপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যের সাথেই বসবাস করত। এছাড়া ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে,  ক্রিশ্চিয়ানা নামক এক স্থানে ১৯৭১ সালে, কিছু পরিত্যক্ত বিল্ডিং ও একটি অব্যবহৃত মিলিটারি বেজে কিছু মানুষ এসে থাকা শুরু করে, এবং ঘোষণা করে, তারা ডেনমার্কের অধীনে নয়। ডেনমার্কের সরকারও কখনই তাদেরকে কিছু বলারও প্রয়োজন মনে করেনি এবং আজও এত বছর পরেও সেখানে নৈরাজ্যবাদ বিদ্যমান। সম্প্রতি সরকার তাদেরকে একটি প্রস্তাব দেয়, কম খরচে ঐ জায়গাটুকু কিনে নেবার। তারাও রাজি হয়। কেউ যদি নৈরাজ্যবাদ কেমন জানতে চায়, সেক্ষেত্রে ক্রিশ্চিয়ানা একটি ভালো জায়গা।

যদি একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় একজন লোভী একনায়ক থাকেন বা এমন এক সরকার থাকে, যাদের কিনা জনগণের ভালোমন্দে কিছু যায় আসে না, সেক্ষেত্রে নৈরাজ্যবাদ কিছুটা সুফল বয়ে আনতে পারে। কিন্তু এছাড়া নৈরাজ্যবাদ খারাপ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনবে না। সার্বভৌমত্ব আর অন্য সবকিছুর কথা বাদ দিলেও দেশে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কিংবা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া হয়ে উঠবে অসম্ভব ব্যাপার।

সহিংস নৈরাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল যে বইটি; Image Source: cbldf.org

শেষ করব এমন একটি অসাধারণ উদাহরণ দিয়ে, যা নৈরাজ্যবাদের পক্ষে এবং একই সাথে বিপক্ষেও কথা বলে। উদাহরণটি হলো সোমালিয়া। সোমালিয়ায় সরকার পতন হয় ১৯৯১ সালে। এরপর আর কোনো সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। যারা নৈরাজ্যবাদের বিপক্ষে, তারা উদাহরণ টানেন এই বলে যে, সবকিছুর ব্যবস্থাপনায় সরকার না থাকলে অবস্থা সোমালিয়ার মতোই হয়। জলদস্যু, স্থানীয় যুদ্ধবাজ, সন্ত্রাস এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আস্তানা হয়। আবার সোমালিয়ায় কিন্তু বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি বজায় রেখে বসবাস করে। সরকার পতনের আগের চেয়ে এখন শিশু মৃত্যুহার কম, গড় আয়ু বেশি, আগের তুলনায় উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা হয়েছে। নৈরাজ্যবাদীদের মতে এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে জনগণের দেখাশোনার জন্য রাষ্ট্র বা সরকারের দরকার নেই, তারা নিজেরাই যথেষ্ট। কারণ সোমালিয়ার সর্বশেষ শাসক ছিলেন একজন লোভী একনায়ক। হ্যাঁ, সরকার পতনের আগের সময় থেকে তারা এখন হয়ত ভালো আছে, তার মানে এই না যে তারা এত ভালো আছে যে সবাই সবকিছু নিয়ে সোমালিয়া চলে যাচ্ছে। যদি এখানে জনগণের ভালো চায় এরকম সরকার থাকতো তবে, সোমালিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতো।

নৈরাজ্যবাদীদের প্রতীক; Image source: www.youtube.com

তথ্যসূত্র:
১. Josh Clark এবং  Charles W. Brayant এর পডকাস্ট

২.  Pyotr Kropotkin এর The Conquest of Bread বইটি, (প্রকাশকাল: ৯ নভেম্বর ২০০৭) এই লেখায় ব্যবহৃত অংশসমূহ-

Chapter I, Our Riches, Section II,

Chapter-III,  Article- Anarchist Communism

এবং

৩. Emma Goldman এর লেখা  Anarchism and Other Essays.(প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০০০).  এই লেখায় ব্যবহৃত অংশসমূহ-

Chapter Name: Anarchism: What It Really Stands For,  Article Name: Anarchy

ফিচার ইমেজ- dreamstime.com

Related Articles