দীর্ঘ এক বিরতি শেষে আবারও ক্লাব ফুটবল ফিরেছে দর্শকদের মাঝে। মাঝে ঘটে গেছে প্রীতি ম্যাচ সহ উয়েফা ন্যাশনস লিগের ম্যাচগুলো। তবে অধিকাংশ দর্শকের কাছে প্রিমিয়ার লিগ বা লা লিগা না থাকাটা যেমন হতাশার তেমনই বিরক্তির। কারণ ক্লাব ফুটবলের স্বাদ যেন দেশগুলোর খেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ক্লাব ফুটবলের শিরোপার লড়াই পুনরায় শুরু হলেও প্রিমিয়ার লিগের ৫ম সপ্তাহের খেলা শুরু হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর। এ সপ্তাহে হাই ভোল্টেজ ছিলো টটেনহ্যাম হটস্পার বনাম লিভারপুলের ম্যাচটি। এছাড়াও অধিকাংশ দর্শকের আগ্রহ ছিলো ওয়াটফোর্ড বনাম ম্যানচেস্টার সিটির ম্যাচটি ঘিরেও। সেসব ম্যাচের বিস্তারিত খবরাখবর ও বর্তমান প্রিমিয়ার লিগের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।
টটেনহাম হটস্পার ০-২ লিভারপুল
ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে দুর্দমনীয় লিভারপুল। প্রতিপক্ষ টটেনহাম হলেও নিজেদের মাঠে তারা মানসিকভাবে কিছুটা ভঙ্গুর ছিলো। স্পার্সের প্রধান গোলরক্ষক হুগো লরিস এ ম্যাচ খেলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তেমনই তারা এ ম্যাচে যে ডেলে আলিকে পাবে না তা নিশ্চিতই ছিলো। ডেলে আলির পরিবর্তে পচ্চেতিনো তিনজন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার খেলিয়েছেন। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে ছিলেন শুধু এরিকসেন। তাই গোল করার গুরুদায়িত্ব মূলত ছিলো মৌরা ও হ্যারি কেইনের কাঁধে। কিন্তু আদতে যাদের দিকে নজর ছিলো বেশি তারাই করলেন হতাশ। প্রিমিয়ার লিগে গত দুই মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা তারা। অথচ সেই আশার পারদ নিভিয়ে দিলেন সালাহ ও কেইন। গোল পাননি একজনও।
হ্যারি কেইন পুরো ম্যাচে তেমন সুযোগ করে নিতে পারেননি, মৌরাও করেছেন শিশুসুলভ ভুল। কিন্তু লিভারপুলের সেরা খেলোয়াড়ও হেঁটেছেন কেইনের পথে। টানা দুই ম্যাচ গোলহীন থাকতে হলো সালাহকে। ম্যাচে লিভারপুল আক্রমণাত্মক খেলেছে প্রথম থেকেই। স্পার্সও ছেড়ে কথা বলেনি। তবে কেইনদের আক্রমণ ততটা জোরালো ছিলো না বলে কখনোই কোনঠাসা হয়নি ক্লপের শিষ্যরা। ক্লপের দলের ইস্পাতের মতো দৃঢ় রক্ষণের দেখা মিললো এ ম্যাচেও, পাশাপাশি তাদের দ্রুতগতির ফুটবলও ছিলো দেখার মতো।
মিচেল ভ্রমের কিছু দুর্দান্ত সেভের কারণে গোল হজম করা থেকে বেঁচে গেছে স্পার্স। সচরাচর তিনজন ডিফেন্ডার নিয়ে খেলা স্পার্স এ ম্যাচে ডিফেন্ডার নামিয়েছিল চারজন। কোচের এই ট্যাকটিক্যাল পরিবর্তন স্পার্স যে ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারেনি, তা বোঝা গেছে তাদের খেলার ধরণ দেখেই। রক্ষণের সাথে মিডফিল্ডারদের বোঝাপড়ার বেশ ঘাটতি ছিলো। তবে স্পার্সের বিপরীতে শক্ত ম্যাচে জয়ের পরও ফিরমিনোকে নিয়ে অলরেডদের চিন্তা থেকে যাবে। কারণ তিনি মাঠ ছেড়েছেন চোখে আঘাত নিয়ে।
টানা পাঁচ ম্যাচ জয়ে লিভারপুলের হয়ে প্রথম গোল করেন ভাইনালদুম। দ্বিতীয় গোলটি রবার্তো ফিরমিনোর। স্পার্সের হয়ে সান্ত্বনাসূচক একমাত্র গোলটি আর্জেন্টাইন উইঙ্গার এরিক লামেলার।
নিউক্যাসল ইউনাইটেড ১-২ আর্সেনাল
উনাই এমেরি আর্সেনালকে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। যদিও তার দল আক্রমণের সময় আদতে রূপ নিচ্ছে ৪-৩-৩ এ। এর আগে মেসুত ওজিল খেলেছিলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে। তিনি বর্তমানে চলে এসেছেন রাইট উইং পজিশনে। অবামেয়াংও খেলছেন উইংয়ে। শুধুমাত্র এত পরিবর্তনের ভিড়ে দলে জায়গা হচ্ছে না হেনরিখ মিখিতারিয়ানের। টানা দুই ম্যাচ বেঞ্চ থেকে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামলেন তিনি।
কাগজে-কলমে নিউক্যাসল কখনোই আর্সেনালের সমকক্ষ নয়। কিন্তু নিজেদের মাঠে তারা যেন বড় দলের বিপক্ষে একটু বেশিই নির্দয়। তবে আর্সেনালকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি। জয়টা তারা পেয়েছেই। বল পজেশন, পাসিং বা গোলমুখে শট; সবখানেই গানার্সরা নিউক্যাসলের থেকে এগিয়ে ছিলো। কিন্তু গোল যে আসছিলো না! নিউক্যাসল ডিফেন্ডারদের নৈপুণ্যে আর অবামেয়াং ও ল্যাকাজেডের ভুলে প্রথমার্ধে কোনো গোল পায়নি তারা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ফ্রি কিক পেলে সেখান থেকে দারুণ এক শটে গানার্সদের গোলের খাতা খুলে দেন গ্রানিত ঝাকা। প্রথম গোলের পর দ্বিতীয় গোল পেতেও সময় লাগেনি। ৫৮ মিনিটে ল্যাকাজেডের শট নিউক্যাসল ডিফেন্ডারদের গায়ে লেগে ফেরত আসলে ফিরতি শটে আর্সেনালের হয়ে মৌসুমের প্রথম গোল করেন মেসুত ওজিল।
আর্সেনাল এ ম্যাচে ক্লিনশিট সহ জয় নিয়ে ফিরতে পারতো যদি তাদের ডিফেন্সের ভুলগুলো না হতো। প্রতি ম্যাচেই আর্সেনালের রক্ষণের সেই পুরনো সমস্যা কোনো এক সময় ফিরে আসছে আর তাতেই গোল হজম করতে হয় তাদের। শেষমুহূর্তে ক্লার্কের গোল এমন কথাই বলে। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের উন্নতি লক্ষ্যণীয়। প্রথম দুই ম্যাচ বাজেভাবে হেরে তারা ক্রমশ জয়ের ধারার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
চেলসি ৪-১ কার্ডিফ সিটি
সারির খেলার ধরণের সাথে আলভারো মোরাতা ঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারলেনই না। কোচ তাকে টানা ৪ ম্যাচ সুযোগ দেবার পরও মোরাতা ব্যর্থ। তাই সারি বেছে নিলেন দ্বিতীয় পন্থা। অলিভিয়ে জিরুকে ব্যবহার করা। অথচ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে প্রথমেই অঘটন ঘটে গিয়েছিলো। খেলা শুরু হতে না হতেই কার্ডিফ সিটির ডিফেন্ডার সল বামবার গোল। তবে ধীরে ধীরে ম্যাচে ফিরেছে চেলসি। এবং ঘরের মাঠে ম্যাচটি জিতে নিয়েছে ৪ গোলের বড় ব্যবধানে।
খেলায় ফিরতে চেলসি সময় নিয়েছে ৩৭ মিনিট। জিরুর কাছ থেকে বল পেয়ে একক নৈপূণ্যে কার্ডিফ সিটির গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন হ্যাজার্ড। দ্বিতীয় গোলটিও মনে রাখার মতো। জিরুর কাছ থেকে পাস পেয়ে ডিবক্সের জটলার ভেতর থেকেই গোল করেন বেলজিয়ান উইঙ্গার এবং হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ৮০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে। চেলসির ৪র্থ গোলদাতা হলেন উইলিয়ান।
মৌসুমের প্রথম থেকে ইনজুরির কারণে নিয়মিত ছিলেন না হ্যাজার্ড। ফিরে এসে দেখিয়ে দিলেন কেন চেলসির সেরা খেলোয়াড় তিনি। সারি চেলসিকেও বদলে দিয়েছেন। ছোট ছোট পাসে করা গতিশীল ফুটবলের দারুণ নমুনা দেখাচ্ছেন তিনি। এই জয়ে এখন পর্যন্ত লিগে টানা ৫ ম্যাচ জিতলো মাউরিজিও সারির শিষ্যরা।
বোর্নমাউথ ৪-২ লেস্টার সিটি
এ মৌসুমের শুরু থেকেই বোর্নমাউথের পারফর্মেন্স নজরকাড়া। রায়ান ফ্রেজার নিয়মিত গোল পাচ্ছেন, সমানতালে গোল অ্যাসিস্ট পাচ্ছেন স্ট্রাইকার উইলসন। জশুয়া কিংও আছেন ভালো ফর্মে। ভরসা করার মতো রক্ষণের পাশাপাশি বোর্নমাউথ এবার ইউরোপ নিশ্চিত করার মতো দল। ভিটালিটি স্টেডিয়ামে এই দলটির সামনেই উড়ে গেল ক্লদিও পুয়েলের লেস্টার সিটি। বোর্নমাউথের কাছে তারা হেরেছে ৪-২ গোলের ব্যবধানে।
রিয়াদ মাহরেজ ম্যানচেস্টার সিটিতে পাড়ি জমানোর পর থেকেই লেস্টার সিটির বাজে খেলার প্রবণতা বেড়েছে। জেমস ম্যাডিনসন গোল পেতে শুরু করলেও এখনও দলের সাথে নিজে জুড়তে লড়ে যাচ্ছেন। বিপরীতে জেমি ভার্ড লড়ছেন নিষিদ্ধ হওয়া ও ইনজুরির সাথে।
নিজেদের মাঠে বোর্নমাউথের একতরফা আধিপত্য ছিলো। লেস্টার সিটি সুযোগ পেয়েছে খুব সামান্যই। মূলত রায়ান ফ্রেজার জোড়া গোল করলেই লেস্টার সিটি আরও বেশি মুষড়ে পড়ে। ওয়েস মরগ্যান তো ক্রোধ সামলাতে না পেয়ে লাল কার্ডই হজম করে বসলেন। যদিও শেষমুহূর্তে দুই মিনিটে পর পর দুই গোল করে লেস্টার সিটি ম্যাচে ফেরার একটি আভাস দিয়েছিলো। তবে শেষ মুহূর্তে তা শুধু ব্যবধানই কমিয়েছে, জয় নিশ্চিত করেনি। এ হারে সেরা ১০ থেকে ছিটকে যাবার সম্ভাবনা বেড়েছে লেস্টারের। কারণ তারা ৫ ম্যাচে হেরেছে ৩টিতে।
ম্যানচেস্টার সিটি ৩-০ ফুলহাম
পরিপূর্ণ একটি দল পেয়ে পেপ গার্দিওলা পছন্দমতো দল নির্বাচন করার স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। প্রতি ম্যাচে একই একাদশ তিনি নামাচ্ছেন না। প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ব্যবহার করছেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। হাতেনাতে ফলও পাচ্ছে সিটি। সাথে দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় বিশ্রাম। ফুলহামের সাথে যেমন বেনজামিন মেন্ডিকে বসিয়ে রাখলেন পুরোটা সময়। যে লিরয় সানে গত মৌসুমের অধিকাংশ ম্যাচে বেঞ্চে ছিলেন, তিনি থাকলেন প্রথম থেকেই।
নিজেদের মাঠে সবসময়ই ফেভারিট ম্যান সিটি। তবে প্রতিপক্ষ দল যখন এ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসা ফুলহাম, তখন গোলের অঙ্ক তো বড় হবারই কথা! প্রথম থেকে টানা আক্রমণ করে ম্যাচের ৮ মিনিটেই প্রথম গোলের খাতা খোলেন লিরয় সানে। ৯০ মিনিট লড়াইও হয়েছে এক তরফা। কারণ ম্যাচে ৬৪% সময়ে বল ধরে রেখে পেপ গার্দিওলার দল গোলমুখে শট নিয়েছে মোট ৯টি, যেখানে ফুলহাম মাত্র ৩টি।
সানে গোলের খাতা খুলে দেবার পর পরবর্তী গোল করেছেন ডেভিড সিলভা ও রহিম স্টার্লিং। এ সহজ জয়ে ১২ পয়েন্ট নিয়ে ম্যান সিটি আছে তালিকার ৩ নম্বরে। এবং ড্র করলেও এখন পর্যন্ত হারের দেখা পায়নি সিটিজেনরা।
ওয়াটফোর্ড ১-২ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
টানা ৪ ম্যাচ জেতা ওয়াটফোর্ডকে রেড ডেভিলরা খুব সহজেই হারিয়েছে তা কিন্তু নয়। যতটা আক্রমণ চালিয়েছে ম্যান ইউ, ততটাই তাদের প্রতিপক্ষ। প্রথম থেকেই আক্রমণ চালিয়েছে ওয়াটফোর্ড। ডেভিড ডে হিয়া কিছু অসামান্য সেভ না করলে আরও গোল পেতে পারতো ওয়াটফোর্ড। যদিও ওয়াটফোর্ড গোলরক্ষক বেন ফস্টারও দারুণ কিছু সেভ করেছেন।
তবে প্রথম ৪ ম্যাচ ও স্পার্সকে হারানোর ম্যাচে ওয়াটফোর্ড ডিফেন্ডারদের যেমন ভূমিকা ছিলো, এ ম্যাচে তা দেখা যায়নি। বেশ ভুল করেছেন তারা। অ্যাশলে ইয়ংয়ের বাড়ানো বল কখনোই ডিবক্সে রোমেলু লুকাকুর কাছে যায় না, যদি না ফস্টার আরও মনোযোগী থাকতেন। অথচ সেখানে ওয়াটফোর্ডের বড় ধরনের ভুলে প্রথম গোল পায় ম্যান ইউ। তবে কিছুক্ষণ পরে ক্রিস স্মেলিং এর গোল কোনোভাবেই থামানো সম্ভব ছিলো না ওয়াটফোর্ড ডিফেন্ডার বা গোলরক্ষকের। তার গোলটিও ছিলো দর্শনীয়। এই দুটো গোলই সম্বল ম্যান ইউয়ের। বিরতির পরে টানা আক্রমণ করেও দুর্বল ফিনিশিংয়ের কারণে গোল পায়নি মরিনহোর শিষ্যরা।
তবে ম্যাচ জিতলেও ম্যান ইউয়ের ডিফেন্সে যে অজস্র সমস্যা আছে তা আবারও স্পষ্ট হলো। যদিও মরিনহো যে কয়েক মৌসুম ধরেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। অান্দ্রে গ্রের গোলটি ছিলো তাদের রক্ষণের ভুলেই। ডিবক্সে তিনি ছিলেন একদমই ফাঁকা, গোল হতে পারে এমন মুহূর্তেও কোনো ম্যান ইউ ডিফেন্ডার তাকে মার্ক করেনি। ম্যানচেস্টার সিটির পরবর্তী ম্যাচ চ্যাম্পিয়নস লিগে। হয়তো লিগে টানা দুই ম্যাচ জয় তাদের ভরসা যোগাবে।
এছাড়াও হার্ডসনফিল্ড টাউনের মাঠে জয় পেয়েছে ক্রিস্ট্রাল প্যালেস। সেই ম্যাচে একমাত্র গোল পেয়েছেন জাহা। উলভারহ্যাম্পটনও জিতেছে বার্নলির মাঠে। কিন্তু নিজেদের মাঠে ওয়েস্ট হামের কাছে হেরে গেছে এভারটন। ওয়েস্ট হামের হয়ে জোড়া গোল করেছেন ইয়ামালেঙ্কো।
চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরুর আগে এটাই ছিলো প্রিমিয়ার লিগের শেষ রাউন্ড। বিরতি থেকে ফিরে এসে কোনো অঘটন না ঘটলেও ৫ম রাউন্ডে দেখা গেছে স্পার্স বনাম লিভারপুলের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ এবং চেলসি ও সিটির নান্দনিক ফুটবল। ৫ম রাউন্ড শেষে পয়েন্ট টেবিলে প্রথমে থাকলো কোনো পয়েন্ট না হারানো চেলসি। দ্বিতীয়তে থাকা লিভারপুলেরও একই পয়েন্ট। তাদের পার্থক্য শুধুমাত্র গোলের ক্ষেত্রে।
ফিচার ইমেজ: Getty Image